অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান সেকশন পরিহার করা উচিত: অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার

[int-intro] স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি-বিদ্যার অধ্যাপক তিনি। খুব সাধারণ, সুলভ ও সহজে ব্যবহারযোগ্য একটি পদ্ধতিকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায় যা বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মায়ের জীবন রক্ষা করে চলেছে। এই উদ্ভাবন তাঁকে এনে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি ও সম্মাননা। ঢাকায় নিজ উদ্যোগে খুলেছেন একটি দাতব্য ফিস্টুলা সেন্টার। নিয়েছেন মেয়েদের কর্মমুখী শিক্ষার উদ্যোগ। তিনি অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার। মনের খবর পাঠকের মুখোমুখি এবার তিনি জানাচ্ছেন তাঁর কাজের কথা, ভাবনার কথা, ইচ্ছার কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মদ মামুন। [/int-intro]
[int-qs]আপনার মেথডটি বিশ্বব্যাপী অনেক প্রসূতি মায়েদের জীবন রক্ষা করছে। আপনার অনুভূতি কেমন?[/int-qs]
[int-ans name=”সায়েবা আক্তার”]এটা আমার জন্য অনেক তৃপ্তির ব্যাপার। যখনই মনে পড়ে পৃথিবীর এতগুলো মায়ের জীবন বাঁচাতে ও প্রজনন স্বাস্থ্যে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে আমার অতি সাধারণ এই মেথডটি এত বড় ভূমিকা রাখছে তখন নিজের মায়ের মুখটি মনে পড়ে যায়। আল্লাহ্‌র কাছে এ ব্যাপারে আমি অসম্ভব কৃতজ্ঞ এবং এ কাজে পরবর্তীতে যারা সহযোগিতা করেছে তাদের কাছেও।[/int-ans]
[int-quote]স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যার ডাক্তার যারা আছেন তারা প্রায় সবাই মেথডটি ব্যবহার করে। কিন্তু সবাই সব ধাপগুলো হয়তো সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না। আমার ইচ্ছে আছে গাইনী ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিকস যারা আছেন তাদের সবাইকে ট্রেনিং এর মাধ্যমে পদ্ধতিটি সঠিকভাবে প্রয়োগের শিক্ষা দেয়া। যেহেতু পদ্ধতিটির ব্যবহার খুবই খুব সহজ সেহেতু এটি শিখতে কারোই খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা না। এখন শুধু প্রয়োজন সবাইকে জানানো এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া। এজন্য আমি নিজেও কাজ করতে রাজি আছি, প্রয়োজনে দেশের যেকোনো প্রান্তে যেতে আমি প্রস্তুত।[/int-quote]
[int-qs]বিশ্বব্যাপী ‘সায়েবা’স মেথড’ এর পরিচিতিটা কীভাবে আসলো?[/int-qs]
[int-ans name=”সায়েবা আক্তার”]এটা আমি করেছি অনেক আগে। ডাক্তাররা বা অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মীরা যদিও এটাও ব্যবহার করতো কিন্তু এরপর বিবিসি কেনিয়ার একজন নার্সের উপর একটি প্রতিবেদন তৈরি করলো যেটাতে অনেকের কাছেই মনে হলো এটা তার আবিষ্কার। এই প্রতিবেদন দেখে আমার ছাত্র/ছাত্রীরা এর প্রতিবাদ করেছিলো। মূলত এর থেকেই এটার বিশ্বব্যাপী পরিচিতি। [/int-ans]
[int-qs]আপনার মেথডটি কীভাবে কাজ করে বলবেন কি?[/int-qs]
[int-ans name=”সায়েবা আক্তার”]প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণের অন্যতম প্রধান কারণ হলো জরায়ুর সংকোচন না হওয়া। জরায়ু যখন সংকোচিত হতে পারে না তখন সেখানকার রক্তনালীর খোলা মুখ থেকে অনবরত রক্তক্ষরণ হতে থাকে। এমতাবস্থায় একটি কনডম ক্যাথেডারে ভরে জরায়ুর ভেতর দিয়ে স্যালাইন ঢুকিয়ে দেয়া হয়। স্যালাইনের কারণে কনডমটি যখন ভেতরে ফুলে উঠে তখন সেটি জরায়ুর গায়ে চাপ সৃষ্টি করে এবং রক্তনালীর মুখগুলো বন্ধ করে দেয়। এভাবে চব্বিশ ঘণ্টা রাখার পর রক্ত বন্ধে শরীরের যে প্রাকৃতিক পদ্ধতি রয়েছে তার মাধ্যমে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়।  [/int-ans]
[int-qs]একটি সাধারণ জিনিষকে এতটা কার্যকরী করার ধারণাটা কীভাবে আসলো?[/int-qs]
[int-ans name=”সায়েবা আক্তার”]এদেশে মাতৃ মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ জরায়ুর রক্তক্ষরণ। বিদেশে একটি প্রযুক্তি রয়েছে যার মূল্য তিনশো ডলার বা তারও বেশি এবং একবার ব্যবহারের উপযোগী। সেটির একটি কপি ঢাকা মেডিকেলের একটি ট্রেনিং প্রোগ্রামে আনা হয়েছিলো। যদিও একবার ব্যবহারের কথা ছিলো তবুও সেটি কয়েকবার ব্যবহার করা হয় এবং একদিন হারিয়ে যায়। পরেরদিন একজন মায়ের রক্তক্ষরণের কারণে মা’কে বাঁচাতে ডাক্তাররা জরায়ু ফেলে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন প্রথম আমি মেথডটা ব্যবহার করি এবং মা’টি বেঁচে যায় ও তার জরায়ু রক্ষা পায়।  [/int-ans]
[int-qs]এই মেথডটি বাংলাদেশে কেমন ব্যবহার হচ্ছে?[/int-qs]
[int-ans name=”সায়েবা আক্তার”]স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যার ডাক্তার যারা আছেন তারা প্রায় সবাই মেথডটি ব্যবহার করে। কিন্তু সবাই সব ধাপগুলো হয়তো সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে না। আমার ইচ্ছে আছে গাইনী ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিকস যারা আছেন তাদের সবাইকে ট্রেনিং এর মাধ্যমে পদ্ধতিটি সঠিকভাবে প্রয়োগের শিক্ষা দেয়া। যেহেতু পদ্ধতিটির ব্যবহার খুবই খুব সহজ সেহেতু এটি শিখতে কারোই খুব বেশি সমস্যা হওয়ার কথা না। এখন শুধু প্রয়োজন সবাইকে জানানো এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া। এজন্য আমি নিজেও কাজ করতে রাজি আছি, প্রয়োজনে দেশের যেকোনো প্রান্তে যেতে আমি প্রস্তুত। [/int-ans]
[int-qs]আপনি ঢাকায় একটি ফিস্টুলা সেন্টার খুলেছেন। এটির ব্যাপারে কিছু বলবেন কি?[/int-qs]
[int-ans name=”সায়েবা আক্তার”]আমার ফিস্টুলা সেন্টারটি সম্পূর্ণ দাতব্য চিকিৎসালয়। এখানে ফিস্টুলার চিকিৎসা, থাকা, খাওয়া সব বিনামূল্যে। এছাড়া কারো যদি প্রয়োজন হয় তাহলে যাতায়াতের খরচটাও আমরা বহন করি। রোগীদের জন্য এটি ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে। রোগীরা চাইলে যেকোনো সময় এখানে ভর্তি হতে পারে। শুধু ফিস্টুলা নয় মায়েদের প্রসব পরবর্তী অন্যান্য সমস্যা যেমন জরায়ু নেমে যাওয়া, যোনিপথ ছিঁড়ে যাওয়া ও যোনিপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার চিকিৎসাও এখানে হয়ে থাকে। [/int-ans]
[int-qs]ফিস্টুলা সেন্টার খোলার ধারণা এলো কীভাবে?[/int-qs]
[int-ans name=”সায়েবা আক্তার”]আমি যখন প্রশিক্ষণার্থী ছিলাম তখন থেকে ফিস্টুলা রোগীদের দুঃখ কষ্টগুলো কাছে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা হয়। এটি এমন একটি রোগ যে রোগের কারণে দেখা যায় অনেক সময় স্বামী তাকে ত্যাগ করেছে, সমাজ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। একই সাথে শারীরিক কষ্ট তো আছেই। সেই থেকেই আমার ইচ্ছা জাগে ফিস্টুলা রোগীদের জন্য কিছু করার। এরপর বরিশাল মেডিকেল কলেজে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে জয়েন করার পর সেই সুযোগটি আমার আসে। ফিস্টুলা রোগীদের জন্য আমি আটটি বেড আলাদা করে দেই। এভাবেই আমার ফিস্টুলা নিজে কাজ করা শুরু। এরপর ফিস্টুলার উপর বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য ইথিওপিয়া যাই বিশ্বের একমাত্র ফিস্টুলা হাসপাতালে। সেখান থেকে দেশে এসে ন্যাশনাল ফিস্টুলা সেন্টার খোলার উদ্যোগ নেই এবং অনেক চেষ্টার পর সফল হই। সরকার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ন্যাশনাল ফিস্টুলা সেন্টার খোলে। সেখানে অত্যন্ত তৃপ্তি নিয়ে অনেকদিন কাজ করেছি। এরপর যখন অবসরে যাই তখনও ফিস্টুলা নিয়ে কাজ করার ইচ্ছাটা আমাকে তাড়িত করে। সেই তাড়না থেকেই “মাম’স ইন্সটিটিউট অব ফিস্টুলা অ্যান্ড ওম্যান হেলথ” নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলি। [/int-ans]
[int-qs]এখানে রোগীরা কীভাবে চিকিৎসা সেবা নিবে?[/int-qs]
[int-ans name=”সায়েবা আক্তার”]আগেই বলেছি এখানে চিকিৎসা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। কোন রোগী বা রোগীর স্বজন চাইলে ১৫ নিউ ইস্কাটন রোড, ঢাক এর ৭ম তলায় সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে বা রোগী ভর্তি করাতে পারে। দেশে অনেক ফিস্টুলা ও প্রসব পরবর্তী জরায়ু নেমে যাওয়া, যোনিপথ ছিঁড়ে যাওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়া রোগী রয়েছে যারা টাকার সমস্যা বা কোথায় চিকিৎসা পাবে সে ব্যাপারে সচেতনতার অভাব থেকে চিকিৎসা নিতে পারে না। এক্ষেত্রে আমরা যদি একটু সচেতন হই তাহলে তাদের চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব। এজন্য রোগী, রোগীর স্বজন, সামাজিক ব্যক্তিবর্গ এবং গণমাধ্যমকে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। [/int-ans]
[int-qs]এখন একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। দেশে সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে বাচ্চা প্রসবের প্রবণতা খুব বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটার কারণ কি?[/int-qs]
[int-ans name=”সায়েবা আক্তার”] এর কারণটা আমি বলবো প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে আমাদের সবার (ডাক্তার ও রোগী) ধৈর্য কমে গেছে। সিজারিয়ান সেকশন পশ্চিমা বিশ্বে চালু হয় প্রসবকালীন মাতৃ মৃত্যু কমাতে। অনেক সময় যখন দেখা যায় স্বাভাবিকভাবে বাচ্চা প্রসব সম্ভব নয় তখন সেখানে সিজারিয়ান করানো হয়। কিন্তু এরপর দেখা গেলো কারণে অকারণে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেকে প্রসবকালীন ঝুঁকিটা নিতে চাচ্ছে না, তাছাড়া রাস্তায় চলাচলের একটা সমস্যা আছে সেজন্য অনেকে ভয় করে যে ব্যথা উঠলে সঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছাতে পারবে কিনা। অনেকে আবার ব্যথা শুরু হওয়ার আগে সাধারণ প্রসবের কথা বললেও ব্যথা উঠলে আর ধৈর্য রাখতে পারে না। এছাড়া চাকুরীজীবী মহিলারা যারা পরিকল্পনা করে প্রসব করাতে চায় তাদের জন্য সিজারিয়ান সেকশনটা সুবিধাজনক। স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব অবশ্যই ভালো, অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান সেকশন পরিহার করা উচিত সবার। দেশে এত বেশি সিজারিয়ান সেকশন কেন হচ্ছে সেটি আমাদের গুরুত্বের সাথে পুনরায় চিন্তা করতে হবে এবং দেখতে হবে অপ্রয়োজনীয় সিজারের মাত্রাটা যাতে কমে আসে।[/int-ans]
[int-qs]ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসি। ডাক্তার না হলে কি হতেন?[/int-qs]
[int-ans name=”সায়েবা আক্তার”]সত্যি বলতে কি আমি ডাক্তার হতে চাইনি। আমার ইচ্ছে ছিলো আমার বাবার মতো শিক্ষক হওয়ার। আমার বাবা সরকারী সাদত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই আমার মনে হতো আমিও বড় হয়ে বাবা মতো শিক্ষক হবো। কিন্তু বাবার ইচ্ছা ছিলো আমি যাতে ডাক্তার হই। বাবা মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তো যাওয়া যেতো না, তাই মেডিকেলেই ভর্তি হই। আসলে কি, তখন আমি জানতাম না যে ডাক্তারি পড়লে সেখানেও শিক্ষকতা করা যায়। মেডিকেলে ভর্তির পর অনেক কেঁদেছিলাম। বাবা তখন সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, ডাক্তারি এমন একটি পেশা যেখানে মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ অনেক বেশি। এই পেশায় নিজের ভালোর জন্য চাইলেও সেটা মানুষের উপকার করেই করতে হবে। বাবার এই কথাটি আমার পরবর্তী জীবনকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। [/int-ans]
[int-qs]চিকিৎসা ও শিক্ষকতা এই দুটিতে আপনার সাফল্যের অনুপ্রেরণা কি?[/int-qs]
[int-ans name=”সায়েবা আক্তার”]বাবা, মা, ভাই-বোনেরা, আমার স্বামী-সন্তানেরা সবাই আমাকে প্রতিটা মুহূর্তে সহযোগিতা করেছে। এছাড়া আমার আরেকটি বড় অনুপ্রেরণা হলো আমার ছাত্র/ছাত্রীরা ও রোগীরা। রোগীদের আনন্দ অশ্রু আমাকে ভীষণরকম অনুপ্রাণিত করে। আমার স্বামী অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর কবির অত্যন্ত সহযোগী মনোভাবের। যখনই কোন সমস্যায় পড়েছি বা ব্যস্ততার চাপে থেকেছি তখন আমার স্বামী আমাকে পারিবারিক চাপ থেকে নির্ভার রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন।   [/int-ans]
[int-qs]কাজ নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?[/int-qs]
[int-ans name=”সায়েবা আক্তার”]সায়েবা’স মেথডটির সঠিক প্রয়োগ সারা দেশে তথা সারা বিশ্ব ছড়িয়ে দিতে কাজ করার ইচ্ছা আছে যাতে আরও বেশি মায়ের মৃত্যু রোধ করা যায়। তাছাড়া নারী স্বাস্থ্যের অন্যসব সমস্যা ও মেয়েদের কর্মমুখী শিক্ষার যে উদ্যোগ নিয়েছি সেটিকে আরও কার্যকর করা এবং এ বিষয়ে একটি প্রকাশনা বের করার ইচ্ছা আছে। [/int-ans]
[int-qs]অনেক ধন্যবাদ ম্যাডাম মনের খবরে সময় দেয়ার জন্য।[/int-qs]
[int-ans name=”সায়েবা আক্তার”]ধন্যবাদ মনের খবরকেও।[/int-ans]

Previous articleসিলেটের বিয়ানীবাজারে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত
Next articleনারীদের মস্তিষ্ক পুরুষদের তুলনায় উদার!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here