ডা. মৃত্যুঞ্জয় কুমার সরদার
রেসিডেন্ট, ফেজ বি, মনোরোগবিদ্যাবিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
সামিনা (ছদ্মনাম) এসএসসি পরীক্ষার্থী। ইদানীং স্কুলে অনিয়মিত, ঘুম থেকে উঠে বেশ দেরিতে, অল্পতেই রেগে যায়, পড়াশুনায় আজকাল বেশ অমনোযোগী। টেস্ট পরীক্ষার ফলাফল ও সন্তোষজনক নয়। এরকম সে আগে ছিল না। পরিবর্তনটা এই আট-নয় মাস যাবৎ দেখা যাচ্ছে। বাবা-মা সন্দেহ করলেন মেয়ে হয়ত ড্রাগ আসক্ত, নিয়ে গেলেন একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে।
চিকিৎসক সামিনার সাথে বিস্তারিত কথা বললেন এবং নির্ণয় করলেন যে সামিনা অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে। সেই সাথে সে দুশ্চিন্তাজনিত সমস্যায় (Anxiety Disorder) ভুগছে। এরকম চিত্র আজকাল প্রায়শই দেখা যায়। শুধুমাত্র শিশু-কিশোর নয় প্রাপ্তবয়স্ক মানুষজনও আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি বেশ আকৃষ্ট।
ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে বিভিন্ন রকমের সোশ্যাল মিডিয়ার অতি ব্যবহার বেড়েই চলেছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সকল বয়সের মানুষ এর ব্যবহারকারী। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এ যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হয়েছে, সবাই সবার সাথে খুব সহজেই মত বিনিময় করতে পারছে।
তথ্য, বিনোদন, শিক্ষা, যোগাযোগ অনেক ভালো কিছু উপহার দিচ্ছে এই সোশ্যাল মিডিয়া। কিন্তু এর অতিরিক্ত ব্যবহার ডেকে আনছে বিভিন্ন মনোসামাজিক সমস্যা যেমন, ঘুমের ব্যাঘাত, দুশ্চিন্তা, অসুখী জীবনযাপন, কাজকর্মে অনীহা এমনকি বিষণ্ণতা ও আত্মহত্যা।
আমেরিকার একটা জরিপে দেখা গেছে কিশোর- কিশোরীদের মাঝে ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার ১২% থেকে বেড়ে ৯০% হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার সবচেয়ে বেশি বেড়ে যায় ২০১৯ সালের কোভিড মহামারির সময়।
২০২০ সালে এপ্রিল মাসে বেলজিয়ামে এক গবেষণায় দেখা যায় বেশি বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের বেশ কিছু ভালো দিক আছে যেমন তা একাকিত্ব ও দুশ্চিন্তা কমায়। শুধু তাই নয় পারস্পরিক যোগাযোগ, স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ, সহজে অনেক মানুষের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ, এসব কারণে আজ সোশ্যাল মিডিয়া এত জনপ্রিয়। কিন্তু এর অতিরিক্ত ব্যবহার ডেকে আনছে ভয়াবহ পরিণাম।
ভালো থাকার অসুস্থ প্রতিযোগিতা, লোক দেখানো সামাজিকতার জালে পড়ে আমাদের সুখ, শান্তি, রাতের ঘুম এমনকি নিজের ক্যারিয়ার পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সম্পর্কগুলো কেন জানি আজকাল বিভিন্ন আকারের ও দামের ডিভাইসে আটকা পড়েছে। আমরা সবাই যেন ছোটো-বড়ো বিভিন্ন আকারের বোকা বাক্সে বন্দি, আমরা সবাই খুব ব্যস্ত, কারও দিকে দেখার সময় ও আমাদের নেই।
নরওয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৬ থেকে ৮৮ বছর বয়সি যারা দুশ্চিন্তাজনিত রোগে (Anxiety Disorder) ভুগছেন তাদের প্রায় সবাই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী। শুধু তাই নয়, অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার আমাদের আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দিচ্ছে, সেই সাথে ভালো থাকার প্রবণতাও কমে যাচ্ছে যা গবেষণায় প্রমাণিত। কিশোর-কিশোরীদের উপরও আছে এর নেতিবাচক প্রভাব।
ভারতে এক গবেষণায় দেখা গেছে সোশ্যাল মিডিয়ার অতি ব্যবহার তাদেরকে সহজেই কাজের প্রতি অনীহা ও ক্লান্তিবোধ বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমেরিকায় এক গবেষণায় দেখা গেছে যারা যত কম সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন তাদের মধ্যে উদ্বিগ্নতা, বিষণ্ণতা ও আত্মহত্যার হার অনেক কম। এখন আর কেউ স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ছবি তোলেন না, মিডিয়ায় পোস্ট করা, লাইক পাওয়া এসব যেন আজ মুখ্য বিষয়। যুব সমাজ এখন নিজেদের চেহারা ও শারীরিক গঠন নিয়ে খুব চিন্তিত, এই ছবি ভালো ওটা কেমন জানি, এই ভিডিওতে এত লাইক এসব তাদের নিত্যদিনের গবেষণার বিষয়। অতিরিক্ত চেহারা সচেতনতা তাই এখন খাবার গ্রহণের প্রতি অনীহার
সৃষ্টি করছে, আবার কেউ কেউ অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণে অভ্যস্ত হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে Anorexia Nervosa, Bulimia Nervosa, Binge Eating Disorder, Social Phobia এর মতো মানসিক রোগ। অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে অনেকে
পর্নগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, নানারকম বিপজ্জনক যৌন আচরণ ও নানারকম যৌন সমস্যা (Sexual Dysfunctions)।
আজকাল পরিবারের সদস্যরা আর একসাথে কথা বলার সময় পান না, সবাই যে যার ফোন নিয়ে ব্যস্ত, এমনকি ছোট্ট শিশু সেও ব্যস্ত কার্টুন দেখতে, এর ফলাফল হচ্ছে ভয়াবহ। পারিবারিক সম্প্রীতি তো নষ্ট হচ্ছেই সেই সাথে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। শিশুর অতি চঞ্চলতা (ADHD), কথা দেরিতে বলা (Speech Delay) এমনকি কথা না বলতে পারার মতো সমস্যা দেখা যাচ্ছে অহরহ।
সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন বিজ্ঞাপন গ্রুপ ইত্যাদির মাধ্যমে মাদকদ্রব্য ব্যবহার ও প্রাপ্তি সহজ হচ্ছে। সেই সাথে জুয়ার আসক্তি ও ইন্টারনেট গেম আসক্তি দিন দিন বেড়েই চলেছে যা সমাজকে আজ ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আজকাল খেলার মাঠে কেউ খেলে না, শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম সবাই ফোনে ব্যস্ত, যুব সমাজের সাথে বয়স্করাও এখন এর বাইরে নয় ফলে দেখা যাচ্ছে ঘুমের সমস্যা, দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতাসহ আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েই চলেছে দিন দিন।
প্রযুক্তির কল্যাণে মানব সভ্যতা আজ অনেক এগিয়ে গেছে। ইন্টারনেটের উন্নতি ও তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন অবশ্যই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক যদি তা হয় নিয়ন্ত্রিত। এটি যেন আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি না হয়। সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার হতে হবে তাই পরিমিত ও যথাযথ। তা না হলে প্রযুক্তির এই উন্নয়ন একদিন সভ্যতা ধ্বংসের কারণ হতে পারে, তাই নয় কি?
আরও পড়ুনঃ