ডা. রেজওয়ানা হাবীবা
সহকারী অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব সাইকিয়াট্রি,
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ, সিলেট।
“জানেন, আমার চার বছরের বাচ্চা কীভাবে যেন আইফোনের সব অ্যাপ্লিকেশন বুঝে, কি যে ট্যালেন্ট! আজকালকার বাচ্চা কি না!”…”আমার মেয়ে তো সারাদিন মোবাইল দেখে, হাত থেকে নিলে বিরক্ত হয়”…
“ছেলে তো সারারাতই ঘুমায় না, মোবাইলে গেইম খেলে, কি যে করি!”,
আজকালকার মায়েদের কথোপকথনের অংশ এগুলো। আসলে মোবাইল, সোশ্যাল মিডিয়া বর্তমানে আমাদের জীবনের একটা বড়ো অংশ হয়ে গেছে। স্মার্টফোন ছাড়া চলা এ যুগে বড়ো কি ছোটো সবার জন্যই অসম্ভব ব্যাপার।
অনেক সাইকিয়াট্রিস্টরা বলেন, “কয়েক বছর আগেও তার সাথে এ্যাপয়েন্টমেন্টের মাঝখানে কোনো বাচ্চা তাদের ফোন ব্যবহার করছে, বা টেক্সট করছে-এমন ঘটনা ছিল খুবই অস্বাভাবিক। কিন্তু এখন এটা খুব সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে।
“বাচ্চারা তাদের ফোন নিয়ে খুব বেশি সময় কাটাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে শিশু-কিশোররা বিষন্নতা, দুশ্চিন্তা বা অন্য মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে-এমন কেসের সংখ্যা বেড়ে গেছে।” কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া সব সময়ই কি খারাপ প্রভাব ফেলছে? তা কিন্তু নয়।
এখন প্রযুক্তির যুগ। আজকালকার আলফা জেনারেশন প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগের সন্তান। আপনি, আমি চাইলেও তাদের প্রযুক্তি থেকে, সোশ্যাল মিডিয়া, গেইম থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবো না। দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার করা হলে, সোশ্যাল মিডিয়া অনেক উপায়ে শিশু-কিশোরদের উপকারে আসতে পারে।
কমিউনিটি বিল্ডিংয়ের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম একটি দুর্দান্ত হাতিয়ার। সোশ্যাল মিডিয়া শিশুদের জন্য তাদের মনকে প্রসারিত করার, জানার দিগন্ত উন্মোচিত করার একটি অন্যতম মাধ্যম। কারণ এই মাধ্যমে পুরো পৃথিবী থাকে তাদের হাতের মুঠোয়। তারা বিভিন্ন মানুষ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ভৌগোলিক, রাজনীতি এবং আরও অনেক বিষয় জানতে পারে।
সোশ্যাল মিডিয়া সব বয়সের মানুষের জন্য একটি সৃজনশীল আউটলেটও। শিশুরা নতুন দক্ষতা অর্জন করতে পারে এবং তাদের প্রাকৃতিক প্রতিভা অন্বেষণ করতে পারে। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী হিসাবে তারা তাদের প্রতিভাগুলো শেয়ার করতে পারে। তারা বুঝতে পারে যে পৃথিবী কত বিশাল এবং বৈচিত্র্যময়, বিশ্বব্যাপী তাদের সমবয়সিদের সাথেও নিজের সৃজনশীলতাকে মেলাতে পারে এবং তুলে ধরতে পারে।
কিন্তু সবকিছুরই একটা সীমা আছে। সেই সীমা লঙ্ঘন করলে সেটার খারাপ প্রভাবে যে কেউ পড়তে পারে। সোশ্যাল মিডিয়ার অত্যধিক ব্যবহারেরও খারাপ দিক আছে, যা শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে।
বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে, এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহারের প্রভাবে বিপথগামী হচ্ছে অল্পবয়সিরা। তারা নানারকম মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে, পড়াশোনায় মনোযোগ হারাচ্ছে, খেলাধুলা ছেড়ে দিয়ে দিনরাত ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। আপনি কি জানেন, বিশ্বব্যাপী সাড়ে পাঁচ বিলিয়ন মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে, আর এর মধ্যে গড়ে সাত ভাগ মানুষ ইন্টারনেট অ্যাডিকশন বা আসক্তিতে ভুগছে।
শিশু-কিশোররা মোবাইলে ছোটো ছোটো রিলস, শর্টস, ইউটিউব ভিডিওর মতো এসব কনটেন্ট নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকে। এই মাত্রাতিরিক্ত সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট দেখা অ্যাডিকশন বা আসক্তির সমপর্যায়।
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ব্যবহারকারী মোট জনসংখ্যার ২৭ ভাগ, যার একটা বড়ো একটি অংশই বয়সে শিশু-কিশোর। ফলে অনেক সময় তাদের সাইবার অপরাধীদের ফাঁদে পড়ে অপরিসীম ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নেট আসক্তিকে তুলনা করা হচ্ছে জীবনগ্রাসী মাদকাসক্তির সঙ্গে।
এই সোশ্যাল মিডিয়াগুলো শিশু থেকে তরুণ সমাজের যেমন উপকার করছে, তেমনি তাদের নিজেদের অজান্তে তাদের ঠেলে দিচ্ছে অন্ধকারে। শিক্ষাগ্রহণের এই বয়সে সারাক্ষণ ইন্সটা, ইউটিউব, ফেসবুকের নেশায় পড়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে নতুন প্রজন্ম।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, “১৩ বছরের কম বয়সিদের এই প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করতে উৎসাহিত করাটা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা।” তারা তথ্য প্রমাণ পেয়েছেন, সামাজিক মাধ্যমের কারণে কিশোর-কিশোরীদের মানসিকতায় অস্বাভাবিক সব পরিবর্তন হচ্ছে। ২০১৭ সালে ‘রয়াল সোসাইটি অব পাবলিক হেলথ’ ১১ থেকে ১৫ বছর বয়স্ক দেড় হাজার কিশোর- কিশোরীর ওপর একটি জরিপ চালায়।
এতে দেখা যায়, স্ন্যাপচ্যাট ও ইনস্টাগ্রাম তাদের মনে সবচেয়ে বেশি হীনম্মন্যতা ও দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করে। ১০ জনের মধ্যে ৭ জন বলেছে, ইনস্টাগ্রামের কারণে তাদের নিজেদের দেহ নিয়ে মন খারাপ হয়েছে।
১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সের তরুণ-তরুণীদের অর্ধেকই বলেছে, ফেসবুকের কারণে তাদের মানসিক দুশ্চিন্তা ও অশান্তি বেড়ে গেছে। দুই-তৃতীয়াংশ উত্তরদাতা বলেছে, ফেসবুকের কারণে সাইবার বুলিং বা অনলাইনে অপমান-হয়রানি করার প্রবণতা গুরুতর আকার নিয়েছে।
লম্বা সময় নেটওয়ার্কিং সাইটে থাকার ফলে তাদের মধ্যে মানসিক সমস্যা বদমেজাজ, অস্থিরতা, রাগ, ইম্পালসিভিটি, বাবা-মায়ের কথা না শোনার প্রবণতা, পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়া, নিদ্রাহীনতা দেখা দিচ্ছে। শিশু থেকে কৈশোরে বয়স বাড়ার সাথে সাথে দেখা দিচ্ছে মাদকাসক্তি, গেইমিং অ্যাডিকশন এবং জুয়া খেলারও প্রবণতা।
তাই আর অপেক্ষা নয়। আপনার সন্তানের সোশ্যাল মিডিয়ার সঠিক মাত্রার ব্যবহার নিশ্চিত করার সময় এখনই। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা অস্বীকার করা কোনো উপায় নেই। আধুনিক ডিজিটালের এ যুগে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার করা থেকেও বিরত থাকা যায় না। ছেলে-মেয়েদের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ও পরিবারের সবার খোঁজ রাখতে হয় এর ব্যবহারের মাধ্যমেই।
অনুভূতি প্রকাশের এই মাধ্যমটির উপকারিতার কথা সর্বজনবিদিত। তবে এই স্মার্টফোন আর সোশ্যাল মিডিয়ার মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেদিকে মনোযোগ রাখা জরুরি।
আরও পড়ুনঃ