দুর্ঘটনা: রানা প্লাজা ও একটি গল্প

২৪ এপ্রিল ২০১৩ইং, সাভারের রানা প্লাজার ঘটনাটি ঘটার পর থেকে বিভিন্ন টেলিভিশন এবং প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে অনেক গল্প আমরা দেখেছি, শুনেছি পড়েছি। ব্যক্তির গল্প, আহত মানুষের গল্প, মৃত মানুষটির গল্প, উদ্ধার কর্মীদের গল্প, বিল্ডিং ভাঙ্গার গল্প, ভাঙ্গা বিল্ডিংটি থেকে মানুষ উদ্ধারের গল্প। দিনরাত খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে উদ্বিগ্ন চোখে সারাক্ষন কেউ কেউ তাকিয়ে ছিলেন টিভির পর্দায়। সকালে ঘুম ভাংগার সাথে সাথে পেপারের সবগুলি পাতা কুঁড়ে কুঁড়ে দেখেছি নতুন কোন আশার কথা লেখা আছে কিনা সেখানে। বুকের ভিতর ভীষণ ভার নিয়ে সারাদেশ থেকে ছুটে আসা স্বজনরা দাঁড়িয়ে থেকেছেন, কেঁদেছেন আর অপেক্ষা করেছেন কখন আসবে আমার মানুষটি। আমার বোনটি ভাইটি ছেলেটি মেয়েটি, স্ত্রী কিংবা স্বামীটি। কেউ পেয়েছেন সত্যিই পেয়েছেন, সবাইকে অবাক করে দিয়ে আত্মার আত্মীয়টিকে জীবিতই পেয়েছেন। চোখের কান্না বুকের হাহাকার, ফুৎকার করে উড়ে গেছে দূর আকাশে, জলের বান যেন ভেসে গেছে আলোর জোয়াড়ে। জীবন নামক অদ্ভুত বিষয়টিকে তখন আঁচ করেছে সারাদেশ, সারা পৃথিবীর মানুষ। জীবনের অর্থ বুঝি এমনি হয়। বেঁচে থাকার মানে বোধ হয় এতোই মধুর!
রানা প্লাজার ঘটনার আটদিন পর, ৩ মে, শুক্রবার সন্ধ্যায় এমনি এক বেঁচে থাকা মানুষের সাথে কথা হলো, সরাসারি। বেঁচে থাকর পূর্ণ অর্থ তখনো তাঁর চোখে মুখে, কথার ভাষায়, গল্পে, সবখানে। দুই রাত আর আধাবেলা অন্ধকার কোটরে আটকে থাকার পর, নতুন এ জীবনের গল্প আবার শুরু। আহা!! জীবন। এর অর্থই বুঝি অন্যরকম, অন্যকিছু। মেয়েটি কথা বলছিলো অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায়। কোনো ভয় নেই, টেনশন নেই। এতটুকু ক্লান্তি নেই তার গলায়, যেন সকালের ঘুম কেবল ভাঙলো তার কেবল।
গল্পের শুরু করলো একেবারে শুরুর গল্প দিয়ে। অর্থাৎ ঘটনার সকালটা যেভাবে শুরু হলো তাঁর। সাড়ে আটটায় যখন উপরে উঠলো, কয়েকটা মেয়ে ছুটে এসে তাকে বললো- ‘আপা আজ কেন এসেছেন, একটু পরইতো ছুটি হয়ে যাবে। আপনি জানেন না। তিন তলায় বিল্ডিংএ ফাটল ধরেছে’! মেয়েটি তখন পাঁচ তলায়। অন্যদের সাথে তখনও কথা চলছে, এসব আলাপ চলতে চলতেই হঠাৎ শুরু হলো ছুটাছুটি। মেয়েটি কোথাও যেতে পারলো না। দাঁড়িয়ে থাকলো। তার পাশে দাঁড়ানো আরো দুটি মেয়ের হাত ধরে অর্থাৎ তারা তিনজন হাত ধরাধরি করে সেখানেই দাড়িয়ে থাকলো। অন্য দুজন মেয়ের একজন নার্স, অন্যজন সাধারন কর্মী। মেয়েটি নিজেও একজন নার্স। তাঁর নিজের শিক্ষা কিংবা ইনটিউশনের বলে বুঝে নিল, এখন সিড়িতে যাওয়া ও সম্ভব নয়। তা’হলে হয়তো সিড়ির নীচেই চাপা পরে মরতে হবে। ভয় কিনা জানি না, হয়তো মৃত্যুকে পরাহত করার উদ্দেশ্যে, তিনজন হাত ধরাধরি করে দাড়িয়ে থাকলো। আর তখনই হঠাৎ টের পেলো, তারা নীচে নেমে যাচ্ছে। দ্রুত দ্রুতই নামছে। বিল্ডিংটাই নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। তারপর আর কিছু মনে করতে পারল না।
যখন টের পেলো, তখনই বুঝতে পারলো সে বেঁচেই আছে। বা হাতটা নাড়াতে পারছেনা। বেশ কিছুক্ষন বোঝার চেষ্টা করলো কি হলো! কেন হাত নাড়াতে পারছেনা? ও আছেইবা কোথায়! টের পেলো বা হাতের উপর একটা পিলার পরে আছে। ডান হাতটা মুক্ত। অদ্ভূতভাবে সে হাতে তখনো মোবাইলটা ধরে আছে, মোবাইলে সময় দেখলো। পরবর্তী সময়ে একইভাবে শুয়ে থেকে বারবার মোবাইলে সময় দেখেছে, একদিন, দুদিন কেটে যাচ্ছে। অন্ধকার, শব্দহীন। মোবাইলের ক্ষীন আলোর মতো জীবনের আলোও নিভছে, জ্বলছে। ব্যাটারীর মতোই জীবনের চার্জ কমে আসেছে।
জ্ঞান ফিরে পাওয়ার কিছুক্ষন পর মেয়েটি টের পেয়েছিলো, তার কপাল দিয়ে রক্ত পরছে। মুক্ত ডান হাত দিয়ে সে রক্ত বারবার মুছার চেষ্টা করে যাচ্ছে। নার্সিং পেশায় থাকার কারনে মনে ভয় ঢুকলো, এভাবে রক্তক্ষরন হতে হতেই হয়তো মরে যাবো! কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে একসময় রক্ত পরা এমনিতেই বন্ধ হয়ে গেলো।
নিজের সাথে কথা বলা শুরু করলো সে। কিছুক্ষন পরপর নিজে নিজেই কথা বলে যাচ্ছে। বলতে বলতে যখন নিজেকে একটু সামলে নিলো, তখন মেয়েটি শব্দ করতে লাগলো, আশে পাশের কেউ জীবিত থাকলে হয়তো শব্দ শুনতে পাবে। জবাবও পেয়ে গেলো একজনের। হাতধরা তিনজনের মধ্যে যে মেয়েটি সাধারন কর্মী, সেই শব্দ করলো। ‘আপা আমিও জীবিত আছি, একটা পিলারের নীচে, কিন্তু নড়তে পারছিনা’। সেখান থেকেই দুজনের বেঁচে থাকার নতুন গল্প শুরু হলো। দুজন কথা বলছে, দোয়া পড়ছে আর অপেক্ষা করছে। যদি কেউ আসে!!
মেয়েটি হিসাব করতে লাগলো। যেখানে আছি বা যেভাবে আছি, কেউ উদ্ধার করতে আসতেও বেশ কয়েক ঘন্টা সময় লাগবেই। সুতুরাং অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। অপেক্ষা করতে লাগলো। দুজন মাঝে মাঝে কথা বলা ছাড়া কি আর করবে!! এরই মাঝে ঘটলো আরেকটি ঘটনা। মুক্ত ডান হাতটা একটু সরাতেই টের পেলো, রক্তে ভেজা একটা শরীর পাশেই পরে আছে। টের পেলো এটা শরীর নয়, শরীরের অংশ। অন্য নার্স মেয়েটির শরীরের খন্ডিত অংশ। বাকি অংশ কোথায় ছিটকে পরেছে জানা নেই। রক্ত আর মাংসের গন্ধ নাকে আসছে। এক সময় শরীরের সে খন্ডিত অংশ থেকে দুর্গন্ধ ছড়াতে লাগলো। একদিন একরাত যাবার পর যখন, দ্বিতীয় রাত নেমে আসছে। মেয়েটি নিজেই নিজের মৃত্যুর গন্ধ অনুভব করতে শুর করলো। আর বোধহয় বাঁচা হবে না। কিন্তু দুদিন পর সকালে উদ্ধার কর্মীরা পৌঁছে গেলো তার কাছে। দুপুরের দিকেই মেয়েটিকে এবং সন্ধ্যার পর অপর মেয়েটিকে জীবিত উদ্ধার করা হলো।কিন্তু মেয়েটির বা হাতটি কনুয়ের উপর থেকে পিলারের নীচেই রয়ে গেলো। কাটা হাতটি নিয়ে মেয়েটি বেঁচে আছে।
গল্প বলতে বলতে মেয়েটির চোখ সত্যিই চক্ চক্ করছিলো। এক নিমিষেই যেন গল্প শেষ করলো। কোথাও আটকে যায়নি। আমি তাকে বাধা দেয়নি, শুনেছি। নিজে থেকেই বললো, বিশ্বাস করেন স্যার, ‘দুদিনে একবারও ক্ষুধা লাগার কথা মনে হয়নি। এমনকি গলা পর্যন্ত শুকায়নি’। অদ্ভুত! অদ্ভুত কথা!!
উপরের গল্পটি সত্যি গল্প, নিজে গিয়ে সাভার এনাম মেডিকেলের বিছানায় শুয়ে থাকা মেয়েটির গল্প শুনেছি। উদ্দেশ্য এমন ছিলোনা যে, একটি গল্প শুনবো। চেয়েছিলাম বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর মানসিক অবস্থা সম্বন্ধে জানতে। তাঁদের মানসিক অবস্থা কি, একটু যদি বোঝা যেতো!! যদি আমার দিক থেকে কাউকে সামান্যতম সাহায্য করার সুযোগ পাই !!
হাসপাতালের ডাক্তারের সহায়তায় এই গল্পটি শুনা হলো।
ঘটনাটির আংশিক বিশ্লেষন
মেয়েটি যখন নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে, সেটা তাঁর মনে ছিলো। ঠিক তার পরের কথা সে মনে করতে পারেনি। হয়তো জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো, হয়তো নয়। বিজ্ঞান বলে, অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনার আকস্মিকতায় এমনি হয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ সেসব মনে করতে পারে না। পরে যখন সস্বিত ফিরে পায় ধীরে ধীরে সে ঘটনার অনেক কিছুই মনে হতে থাকে। তবে ঘটনার সিভিয়ারিটির উপরও নির্ভর করে অনেক কিছু। এঘটনার ভয়বহতা সম্বন্ধে নিশ্চয়ই বর্ণনার কিছু নেই।
আমাদের শরীর এক অদ্ভুত যাদুর খেলা। কখন কি যে করে, কীভাবে করে ভাবা যায়না। বিজ্ঞান অনেক কিছু আবিষ্কার করেছে। আবার অনেক কিছুতেই অন্ধকারেই রয়ে গেছে। আবিষ্কৃত একটু অংশ এখানে শেয়ার করতে চাই। মেয়েটি বলছিলো, দুদিনে তার একবারও ক্ষুধা লাগেনি, এমন কি গলা পর্যন্ত শুকায়নি। বিজ্ঞান বলে মানুষ যখন কোন রকম ইমার্জেন্সি কন্ডিশনে পরে (অতিরিক্ত চাপে থাকে) তখন নিজের ভিতর নিজস্ব সমস্ত মেকানিজম এলার্ট হয়ে আসে। নিজের ভিতরের এক সিস্টেম অন্য সিস্টেমগুলোকে সহায়তা করতে থাকে, যতক্ষন পারা যায়। মেয়েটির এমন অবস্থায় শরীরের মেটাবলিজম নিশ্চিত প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে এসেছিলো। স্টেরয়েড সিক্রেশন হয়েছিলো প্রচুর পরিমানে। শরীরে জমে থাকা খাদ্য নিজস্ব পদ্ধতিতে কাজে লাগিয়েছে শরীর, তাই ক্ষুধা কিংবা পানির প্রয়োজন পড়েনি। এসব বেঁচে থাকার জন্য শরীরের নিজস্ব পদ্ধতি, জরুরী অবস্থায় শরীর নিজে নিজেই এমন ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।
যখন উদ্ধার কারীরা তাকে খুঁজে পেয়েছে, জীবনকে সে নতুন করে ফিরে পেয়েছে। সে আনন্দে অন্য বেদনা তার কাজ করেনি। হাত না থাকা বা চোখের সামনে ঘটা এতো এত্তো ঘটনা কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারছেনা। সবকিছুর বিনিময়ে তার কাছে চলে এসেছে জীবন। অনেকে বেঁচে থাকার এ তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়াটিকে ‘হানিমুন স্টেজ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যার স্থায়িত্ব অনেক সময় ধরে নাও থাকতে পারে। অর্থাৎ যখন মেয়েটি তার চারদিকের অবস্থা সমন্ধে আবার সচেতন হবে, যখন চারদিকের ক্ষয়ক্ষতি বা ধ্বংসযজ্ঞ সমন্ধে জানতে পারবে তখনই হয়তো মন নতুন করে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। মেয়েটির ক্ষেত্রে এটি ঘটার সম্ভাবনা প্রচুর। তবে আমাদের আকাঙ্খা নিশ্চয়ই এমন নয়, বরং চাইবো তাকে যেনো আর কোন দুঃখ বোধের ভিতর দিয়ে না যেতে হয়। পাশাপাশি বাস্তবাতার কথাও মনে রাখতে হবে। যা ঘটতে পারে, যা করতে হবে।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleফেসবুক ও মানসিক স্বাস্থ্য
Next articleএডিএইচডি বিষয়ে বিএসএমএমইউতে আলোচনা সভা
অধ্যাপক ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব
চেয়ারম্যান, মনোরোগবিদ্যাি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here