দৃশ্যপট -১
ডিউটি রুমে রোগী নিয়ে আলাপ হচ্ছে একজন মনোরোগ চিকিৎসক এবং একজন রোগীর বড়ভাইয়ের মধ্যে।
চিকিৎসকঃ আপনার ছোটভাই সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। এবং এ ব্যাপারে আমাদের কোনো সন্দেহ নাই।
রোগীর ভাইঃ Sorry Doctor. আপনার এই কথা আমি মানতে নারাজ। দেখুন আমি যথেষ্ট শিক্ষিত এবং নিজেকে একজন সচেতন ব্যক্তি হিসেবেই মনে করি। আমি নিজে ইন্টারনেট-পত্রপত্রিকা-বই সব ঘেঁটে দেখেছি। সে থেকে আমি বেশ ভাল ভাবেই বুঝতে পারছি, আমার ভাইয়ের লক্ষণ সমূহ বিষণ্ণতা রোগের কারণেই।
– দেখুন আমরা তো যথেষ্ট দায়িত্ব নিয়েই কথাগুলো বলছি। তাই না?
– বলছেন, তা অস্বীকার করছিনা। কিন্তু, এও ভাল ভাবে জানি, আপনারা সব সময় এক ধারায় চিন্তা করতে করতে স্বাভাবিকতার মাঝেও রোগ খুঁজে নেন। আমি নিশ্চিত রবীন্দ্রনাথকে যদি আপনাদের কাছে নিয়ে আসত তাহলে আপনারা তাকেও সিজোফ্রেনিয়া রোগী বানিয়ে দিতেন।
– এ রকম ভাবার কারণ কি?
– কারণ, তিনিও তো কল্পনা করতেন। নতুন নতুন শব্দ বানাতেন, আপন জগতে থাকতেন। একা থাকতেন। এ সবই তো সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ।
– আর তাই, আপনার ভাইও রবীন্দ্রনাথের মত?
– আমার ভাই যে রবীন্দ্রনাথ নয়, তা জানি। কিন্তু, আপনারা খেয়াল করছেন না তার রোগের উৎপত্তি হচ্ছে প্রেমে ব্যর্থ হবার পর থেকেই। সে থেকেই বিষণ্ণতা। আর তাই, নিজেই বুঝতে পারছি ওর দরকার শুধু সাইকোথেরাপি।
– তাহলে এর আগেও তো আপনার ভাই আমাদের এখানে ভর্তি হয়েছিলেন, সিজোফ্রেনিয়া হিসেবে চিকিৎসা পেয়ে অনেকটা ভালো হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু, ওষুধ বন্ধ করাতে আবার তা ফিরে এসেছে। সেটা নিয়ে কেন ভাবছেন না?
– ভাল হয়ে উঠছিল সে কথা সত্যি। তবে সেটার সামান্য অংশ ঔষধের কারণে। ডায়াগনোসিস তখনও ভুল ছিল। কিন্তু আপনাদের ঔষধ তো সব একই কাজ করে, একটা দিলেই হল- রোগ কিছুটা দমিয়ে রাখা যায়। আর ওর ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে। আর বাকিটা ঘটেছে, সাইকোথেরাপির মাধ্যমে, পরিবারের সবাই তাকে সময় দিয়েছে সে কারণে, কক্সবাজারে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছি, বিষণ্ণতা আসতে দেই নি সেই কারণে। এসবেই আসল কাজটা হয়েছে।
– তাহলে এখন কেন নিয়ে আসলেন?
– কারণ, বাসায় সমস্যা করছে।
– কেন সমস্যা করছে?
– ওর আসলে মনের জোর কমে গেছে। আপনারা মনের জোর বাড়ানোর চেষ্টা করেন, সে অনুযায়ী দুয়েকটা ঔষধ দেন। আমি জানি এতেই সে ভালো থাকবে।
দৃশ্যপট -২
বহির্বিভাগে রোগী নিয়ে আলাপ করছেন আরেক মনোরোগ চিকিৎসক। এবার রোগীর অভিভাবক একজন মা। থাকেন গ্রামে। মেয়ের সমস্যা নিয়ে এসেছেন। জানালেন, মেয়েকে জ্বীনে আছর করেছিল। স্থানীয় গুণিন লাঠিপেটা, ঝাড়ুপেটা এবং অন্যান্য চিকিৎসা(!!) করেছেন এবং বলেছেন জ্বীনের আছর কাটিয়ে দিয়েছেন। এখন, বাকি কাজ মনোরোগের চিকিৎসকের। মাস দুয়েক ঔষধ খেলেই ভাল হয়ে যাবে। তার কথা শুনেই এখানে নিয়ে আসা। কিন্তু গোল বাঁধল যখন চিকিৎসক বললেন এটা মানসিক রোগ। জ্বীন –ভুতের আছর নয়। তাই, দীর্ঘ দিন ঔষধ খেতে হবে।
চিকিৎসকঃ আপনার মেয়ের রোগ আছে এটাই যদি না মানেন তাহলে চিকিৎসা করাবেন কেন?
রোগীর ভাইঃ আসছি (অমুক) বৈদ্য বলছেন তাই। উনি অনেক বড় বৈদ্য, তার কথা কখনো মিথ্যা হয় না। আপনে ভাল দেইখা ওষুধ দেন।
– দেখেন, চিকিৎসা তো কারো ইচ্ছে মত হয় না। সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে আগাতে হয়।
– আমি মুকখু মানুষ, আমারে ওইসব বইলা কোনো লাভ আছে বাজান। শক্ত করে তিন মাসের ওষুধ দেন, ইনশাল্লাহ ভাল হয়া যাইব।
আপনার মেয়ের এই রোগ তো তিন মাসে ভাল হবার রোগ নয়।
– আরে বাবা, জ্বিনের আছর তো কাটাইয়া দিছে। এখন আর কি সমস্যা। ভালো দেইখা ওষুধ দেন। আর না পারলে বলেন, অন্য খানে যাইয়া দেখামু।
– ঠিক আছে, অন্য খানেই দেখান। আমার ওষুধ লেখার দরকার নাই।
– ডাক্তার সাব, রাগ করেন কেন? আপনারা রাগ করলে আমরা কই যামু।
– আমার কথা না শুনলে, না মানলে ওষুধ লিখে লাভ কি?
– আচ্ছা ঠিক আছে, আপনে ভাল কইরা ওষুধ লেইখা দেন। খাওয়ায়ে দেখি। ভাল হইলে তো ভালই, নইলে পরে বৈদ্যের লগে বুইঝা দেখমুনে কি কয়।
উপরের দুটি ঘটনাই শতভাগ সত্য। আমাদের দেশের সকল মনোরোগ চিকিৎসকের জীবনে এসব খুবই নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এ থেকেই বুঝা যায়, মানসিক রোগ নিয়ে কত ধরনের অজ্ঞতা আমাদের সমাজে আসন গেঁড়ে আছে। এটা শুধু গ্রামের নিরক্ষর জনগণের মধ্যেই নয়, শহুরে শিক্ষিত সমাজেও বিদ্যমান। তবে, প্রকাশভঙ্গী কিংবা মাত্রাতে যা কিছু তারতম্য।
সত্যি কথা বলতে, এসব যে আপনি-আমি-সবাই কমবেশি জানিনা তা নয়। তবু, নতুন করে বাস্তব চিত্রটা আবারো তুলে ধরা একটাই কারণে- নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়া। আর নিজের মধ্যে যথাযথ সচেতনতা গড়ে তোলার আগ্রহ সৃষ্টি করা।
যথাযথ সচেতনতা বলতে কি বুঝায় তার ধারণা পাওয়া যাবে প্রথম উদাহরণ থেকে। ভদ্রলোকের জানার আগ্রহ এবং চেষ্টা যথেষ্ট প্রশংসনীয়। কিন্তু, সেটা থেকে যে ফলাফল বেরিয়ে এল – তা দুঃখজনক। যেমন, একটা ওষুধের মোড়ক দেখে সেই ওষুধ সম্পর্কে যাবতীয় জ্ঞান লাভ করা যায় না। মোড়কে যা থাকে তা হল কিছু সাধারণ কথা, খুব বিস্তারিত কিছুই নয়। কিন্তু, একজন চিকিৎসকই জানেন, সেটা কোন ক্ষেত্রে ঠিক কিভাবে প্রয়োগ করতে হবে। Risk-Benefit Ratio হিসাব করে তিনি নিজ দায়িত্বে এমন অনেক ক্ষেত্রেও সেটা প্রয়োগ করতে পারেন, যা আপাত ধারণায় দেয়া উচিত নয় বলেই মনে হবে। তেমনি, একই লক্ষণ অনেক ধরনের রোগীর মাঝেও থাকতে পারে, রোগের পিছনে কারণ একই হতেও পারে। কিন্তু, মানসিক রোগ নির্ণয় শুধু লক্ষণ আছে কি নেই –এ রকম টিক চিহ্ন দিয়ে হয় না। এর পিছনে অনেক ব্যাখ্যা, অনেক চিন্তা লাগে। সেই সাথে এই ধারণা পোষণ করাও ভুল যে, মানসিক রোগের চিকিৎসকের কাছে গেলেই তাঁরা একটা না একটা রোগ বানিয়ে দিবেনই।
একই ভাবে, মনোরোগের ক্ষেত্রে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কথার চেয়েও প্রচলিত ধারণা বা স্থানীয় বিশ্বাসভাজন ব্যক্তির কথায় বেশী ভরসা করা ভুল। এতে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণে আগ্রহ নষ্ট হয় এবং ফলশ্রুতিতে রোগী কষ্ট পায়।
সবশেষে, একটা কথাই জানাতে চাই- আমাদের জনগণের মধ্যে চিকিৎসার ব্যাপারে, বিশেষতঃ মানসিক রোগের চিকিৎসার ব্যাপারে প্রচলিত ধারণায় বা অন্য ব্যক্তিদের কথার উপর বেশী ভরসা করার প্রবণতা দেখা যায়। অনেক সময় তা এমন পর্যায়ে পৌঁছে- যেখানে চিকিৎসকের কথা কোনো গুরুত্বই পায় না-ওষুধ লিখে দেয়া ছাড়া। এ প্রবণতা থেকে আমাদের সবার বেরিয়ে আসতে হবে। বুঝতে হবে, ওষুধের মতই কিংবা সাইকোথেরাপির মতই মনোরোগ চিকিৎসকের অন্যান্য কথাও সমান গুরুত্বপুর্ণ। কারণ, এই কথাগুলো চিকিৎসকের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা আর বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সত্য – সব কিছুর নির্যাস।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।