মা এবং সন্তানের সম্পর্কই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর, স্বাভাবিক, স্থিতিশীল এবং গভীরতম সম্পর্ক, সন্দেহ নেই। মায়ের স্তনে শিশুর মুখ, মা পাখির ঠোঁটে শিশুপাখিটির ঠোঁট, মা বানরের পিঠে চড়া শিশু-বানর, ক্যাঙারুর পেটের থলিতে আটকে থাকা শিশুটির ছবি কিংবা মা কুমিরের মুখের ভেতর নিরাপদে থাকা কুমিরছানাগুলোর কথা ভাবলে এই সম্পর্কের শক্তির কথা স্বীকার করতে কার সন্দেহ হতে পারে!
সন্তানের সাথে মা আর মায়ের সাথে সন্তানের এই সম্পর্কের তীব্র যে প্রভাব পরস্পরের ওপর পড়ে, পৃথিবীতে আর কোনো সম্পর্কের ভেতর সেটা ভাবাও যায় না। সাধারণ দৃষ্টি দিয়েই এই সম্পর্কটিকে অনুভব করা যায়। তবুও এই সম্পর্কের পেছনের শক্তিকে আবিষ্কার করতে আজ অব্দি গবেষণাও কম হয়নি। জিনগত ব্যাখ্যা, বায়োলজিক্যাল বা শারীরিক ব্যাখ্যা, সামাজিক ব্যাখ্যা, মানসিক বা সাইকোলজিক্যাল ব্যাখ্যাসহ বিভিন্ন রকমের যুক্তি বা ব্যাখ্যাও মা-সন্তানের এ-সম্পর্কটির বিষয়ে সাধারণ ধারণাটিকেই বারবার প্রমাণ করেছে, আরো স্পষ্ট করেছে, আরো জোরালো করেছে।
একজন মা তার সন্তানের গায়ের গন্ধ দিয়েই অনুভব করতে পারেন তার সন্তানের অস্তিত্ব। পশুদের ভেতর এর তীব্রতা আরো বেশি এবং স্পষ্ট হয়ে থাকে। মজার বিষয় হলো, এই খেলায় শিশুটিও কম যায় না। জন্মের অতি অল্প সময়ের ভেতর শিশুটিও মায়ের গন্ধটি বুঝে যায়। স্তন পান করা শিশুটির কাছে বিষয়গুলি আরো স্পষ্ট। তারা এমনকি মায়ের একটি স্তন থেকে অন্য স্তনকে আলাদা করতে পারে।
অনেক গবেষক বলেছেন, এই গন্ধের অনুভবটি গর্ভে থাকা অবস্থায়ই শুরু হয়। গবেষকগণ এর একটি নামও দিয়েছেন, ফ্যারোমোন্স (Pheromones)। এই ফ্যারোমোন্স বা গন্ধবিজ্ঞানের কীর্তিকলাপ আরো বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। অনুমান করা হয় গন্ধ বিষয়টিই মা ও সন্তানের সম্পর্কের মূল শেকড় বা প্রাথমিক ভিত্তি। মা-শিশুর এই গন্ধ-গন্ধ রাসায়নিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পরস্পরকে, বিশেষ করে শিশুটিকে নিরাপত্তার অনুভব দেয়। অর্থাৎ গন্ধ পাওয়ার সাথে সাথে শিশুটি বুঝতে পারে, তার খাদ্য থেকে শুরু করে সমস্ত অনিশ্চিত বিষয়গুলো এখন নিশ্চিত। কান্নারত শিশুটি কান্না থামিয়ে দেয়, ভীত সন্তস্ত্র ভাবটি নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। নিরাপত্তার এই অনুভূতি প্রতিটি সন্তানকে মা-ই শেখান, মা-ই দেন এবং মা-ই দিতে পারেন।
বিশ্ব মা দিবস বা মা দিবস। বহুদিন, বা বহুবছর ধরেই এ দিবসটি পৃথিবীতে বিভিন্নভাবে পালিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী কিংবা ধর্মীয় গোষ্ঠীতেও এই দিবস পালনের রীতি আছে। মাকে অনুভব করা, মা-শিশুর সম্পর্ককে অনুভব করা, সর্বোপরি মায়ের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করার জন্যই এ দিবসটি পালন করা হয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দিবসটি ভিন্ন ভিন্ন দিনে পালন করা হয়। এমনকি একই দেশে বছরে বছরে তারিখ পরিবর্তনও হয়। আমাদের দেশে দিবসটি পালন করা হয়, প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার। দিবসটির আধুনিক প্রবক্তা হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যানা জার্ভিস। তিনি তাঁর মায়ের প্রতি সম্মান জানাতেই এই দিবসটি পালনের কথা ভাবতে শুরু করেন। তাঁর মা অ্যানা মেরি রিভস্ জার্ভিস জীবনভর অনাথ ও আতুর মানুষের সেবা করেছেন। যা তিনি করেছেন একান্তে ও গোপনে। সেই মা মারা যান ১৯০৫ সালে। পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমন অসংখ্য মায়েদের প্রতি সম্মান জানাতেই এ দিবসটির কথা ভাবতে শুরু করেন অ্যানা জার্ভিস। সাত বছর পর যুক্তরাষ্ট্র সরকার দিবসটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবেই স্বীকৃতি দেন।
‘মা’ অতি সাধারণ, সহজ-সরল ছোট্ট একটি শব্দ। যে শব্দের উচ্চারণেও কোনো জটিলতা নেই। অনুভবেও কোনো অস্পষ্টতা নেই। পৃথিবীর যে-কোনো জাতির, যে-কোনো দেশের, যে-কোনো গোষ্ঠীর সকল সন্তানের নিরাপত্তার প্রথম অনুভূতি-মা।
আমার মতে, মা হলো পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসার প্রাথমিক উৎস। মায়েরা কিছুটা স্বার্থপরও হয়ে থাকেন। নিজের সন্তানের প্রতি ভালোবাসা তারা আর কোনো কিছুতেই ভাগ হতে দিতে চান না। জগতের সকল সন্তানই মায়ের কাছে সন্তান, তবুও কোথায় যেন তারা নিজের নাড়ি-ছেঁড়া ধনের প্রতি আলাদা একটা টান অনুভব করেন। এই টান অনুভবে বাবারাও কম নন। কোথাও কোথাও হয়তো বাবাদের অনুভব আরো বেশিও দেখা যায়। সন্তানটির জিনগত গঠনেও বাবার অস্তিত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই।
কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা সন্তানের অনুভব তৈরির ক্ষেত্রে বাবার চেয়ে মায়ের আবেগের দিকটিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। তারা বলছে, সন্তানের আবেগ তৈরির ক্ষেত্রে বাবার চেয়ে মায়ের আবেগই বেশি অবদান রাখে। হয়তো সত্যি, হয়তো না! না, আমি গবেষণালব্ধ এসব ফলের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করছি না। বরং মায়ের অবদান বা অবস্থানের প্রতি আরো একটু বেশি যুক্তি খোঁজা যায় কিনা সে চেষ্টা করছি।
প্রতিটি মানব সন্তান, মায়ের পেটে যখন ভ্রুণ হিসেবে কিংবা একখন্ড ক্ষুদ্র মাংসপিন্ড হিসেবে যাত্রা শুরু করে, তখন তাদের নিজস্ব কোনো পরিচয় পর্যন্ত থাকে না। ছেলে না মেয়ে সে বিষয়টিও তখন প্রকাশ পায় না। ক্ষুদ্র মাংসপিন্ডটি মায়ের জঠরের ভেতর, মায়ের শরীরের অংশ হিসেবেই বাড়তে থাকে। মায়ের রক্ত, মায়ের মাংস, অক্সিজেনসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু মায়ের শরীর থেকে সরাসরি নিয়েই মাংসপিন্ডটি বড় হয়। সপ্তাহখানেক পর, ধীরে ধীরে আলাদা হতে শুরু করে। ছেলে কিংবা মেয়ে, তার নিজস্ব পরিচয়ের দিকে এগোতে থাকে। এখানে অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলে রাখা ভালো, মেয়ে হলে ভ্রুণের প্রাথমিক অবস্থা, অর্থাৎ পূর্বের গতিপথ ধরেই এগোয়।
ছেলে হলে অর্থাৎ ‘Y’ ক্রোমোজোম থাকার কারণে ধীরে ধীরে গতি পরিবর্তিত হয়। উভয়ক্ষেত্রেই মাংসপিন্ডটি মায়ের পেটে বিভিন্ন পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যেতে-যেতে এক সময় একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষে রূপ নেয়। এটাই সব মানুষের জন্মের সাধারণ হিসেব। আমি কিংবা আপনি সবার ক্ষেত্রেই একই হিসেব, একই কাহিনি। প্রতিটি মানুষকেই সরাসরি মায়ের শরীরের অংশ হিসেবে জীবনের যাত্রা শুরু করতে হয় এবং নির্দিষ্ট সময় পর মায়ের শরীর থেকে আলাদা হতে হয়। সন্তান ভূমিষ্ট হয়, পৃথিবীতে আসে। তৈরি হয় দুটি মানুষের দুটি আলাদা পরিচয়-মা ও শিশু। সে মা সন্তানের নিরাপত্তার কেন্দ্রবিন্দু হবে না, তাহলে কে হবে!
মনোবিজ্ঞানের ভাষায় আরো একটি শব্দ আছে, ‘এটাচমেন্ট’। শিশুসন্তান জন্মের পর সাধারণত তারা কোনো একজনের ওপর নির্ভর করে। এই নির্ভরতার বিষয়টিকেই বলে এটাচমেন্ট। আর নির্ভর করা মানুষটিকে বলে ‘এটাচমেন্ট ফিগার-যার সাথে বা যার সান্নিধ্যে শিশুটি সব ধরনের নিরাপত্তা অনুভব করে।
পূর্বের আলোচনা থেকেই এটি স্পষ্ট যে, সাধারণত এই এটাচমেন্ট ফিগারটিই হয়ে থাকেন মা। কখনো কখনো মা ছাড়া অন্য কেউও হতে পারেন। যেমন : যেসব ক্ষেত্রে মা থাকেন না বা মায়ের নিজের অবস্থা নিরাপদ থাকে না সেসব ক্ষেত্রে অন্য কেউ এই ভূমিকায় থাকতে পারেন। এই এটাচমেন্ট তৈরি হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। যেসব শিশুদের ক্ষেত্রে এটাচমেন্ট বিষয়টি তৈরি হয় না বা কোনো কারণে বিঘ্নিত হয়, তাদের শিশুকাল থেকেই এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার অনুভব তৈরি হয়। যা তাদেরকে এমনকি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে হতে পারে। অপরদিকে, মায়ের সাথে সুন্দর স্বাভাবিক সম্পর্কটি মানুষকে শৈশব-কৈশোর-যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্য কিংবা জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত প্রচন্ড এক মানসিক শক্তি দিয়ে থাকে। যার নাম নিরাপত্তা, নিরাপত্তা-বোধ।
মা-ও সন্তানের যে-কোনো ধরনের নিরাপত্তাহীনতাকে অনুভব করতে পারেন। সন্তানের যে-কোনো বিপদে নাকি মায়ের মনে ‘কু-ডাক’ দিয়ে ওঠে, মায়ের হাত থেকে থালা পড়ে যায়, মায়ের বুক কেঁপে ওঠে-এমন অনেক গল্প কিংবা বিশ্বাস আমাদের সমাজে সবখানেই চালু আছে। সন্তানের যে-কোনো সাফল্যেও নিশ্চয়ই তার চেয়ে বেশি খুশি হওয়ার মানুষ পৃথিবীতে কত গান, কত কবিতা, কত নাটক-সিনেমা নির্মাণ হয়েছে মা আর সন্তানের সম্পর্ককে ভিত্তি করে, সেকথা হিসেব করে শেষ করা যাবে না। ধর্ম কিংবা বিজ্ঞান, বিজ্ঞান কিংবা সাহিত্য কোথাও এর ব্যত্যয় দেখা যায়নি। ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত’, ‘মায়ের মতো আপন কেহ নাইরে…’ এমন হাজারো উপমা, লাইন, উক্তি প্রতিনিয়ত তৈরি হয় পৃথিবীতে মাকে নিয়ে।
ডিয়াগো ম্যারাডোনা তাঁর মাকে নিয়ে বলেছেন, ‘আমার মা মনে করেন আমিই সেরা, আর আমার মা মনে করেন বলেই আমি সেরা হয়ে গড়ে উঠেছি।’ মায়ের অবদান, মায়ের অবস্থান, মায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করা মানে নিজের জীবনকেই ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা। বিশ্ব মা দিবসের প্রয়োজন কতটুকু জানি না। মাকে স্মরণ করতে কিংবা মায়ের প্রতি সম্মান দেখাতে আলাদা কোনো আড়ম্বরের প্রয়োজন আছে কিনা সেটিও একটি প্রশ্ন! মায়ের পেটে ভ্রুণ হিসেবে যাত্রা শুরু করার পর থেকে জীবনের যে-কোনো সময়ে বা যে-কোনো প্রয়োজনে মায়ের চেয়ে ধারালো, শানানো তলোয়ার বা হাতিয়ার সন্তানের জন্য আর কে হতে পারে? ফ্রয়েড মানুষের সামনে চলার বিষয়গুলোকে ‘ড্রাইভ’ শব্দ দিয়ে বর্ণনা করছেন। সেই ড্রাইভের ব্যাখ্যার জন্য দুটি শব্দও তিনি রেখেছেন। একটি ‘এরোস’ অন্যটি ‘থ্যানোস’।
এরোস মানে পাওয়ার জন্য-নিজের জন্য, আনন্দের জন্য ড্রাইভ। আর ‘থ্যানোস’ মানে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে কিছু পাওয়ার চেষ্টা করা। মায়েরা সন্তানের জন্য সেই ‘থ্যানোস’ গ্রুপে অবস্থান করেন। সেই সন্তান যদি মাকে যথাযথ সম্মান না দিতে পারে, তাহলে তার চেয়ে পরিতাপের বিষয় আর কী হতে পারে! সবশেষে বিখ্যাত অভিনেত্রী সোফিয়া লরেনের একটি উক্তি উল্লেখ করছি, ‘কোনো একটি বিষয় মায়েদেরকে দুইবার ভাবতে হয়, একবার নিজের জন্য একবার তার সন্তানের জন্য।’ সারা পৃথিবীর কোনো মা-ই যেন জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত অনিরাপদ অনুভব না করেন, অনিশ্চিত না থাকেন। ব্যক্তি, রাষ্ট্র, সমাজ কিংবা পরিবার সবার কাছে এমন প্রত্যাশাই থাকবে।
সূত্র: মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ১ম বর্ষ, ৫ম সংখ্যায় প্রকাশিত।
মানিসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকন সর্তক থাকুন