বয়ঃসন্ধি-কালে মানসিক সুস্থতা

0
62
জীবনের নানা ওঠা-পড়ার সঙ্গে কৈশোরকাল বা বয়ঃসন্ধি পর্ব ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। এই সময়ে মানুষের শরীর ও মনের বিকাশের ক্ষেত্রে খুব দ্রুত পরিবর্তন দেখা যায়। নিরাপদ শৈশবস্থা কাটিয়ে মানুষ যখন বৃহত্তর জীবনের দিকে পা বাড়ায়, অর্থাৎ বয়ঃসন্ধি পর্যায়ে এসে পৌঁছায়, তখন স্বভাবতই তার মনে অনেক প্রশ্ন, সন্দেহ ইত্যাদি উঁকি দিতে শুরু করে। এই সময়কালের মধ্যে একজন ব্যক্তির মধ্যে নতুন অনুভূতি এবং দেহকল্পের উপর ভিত্তি করে তার নিজস্বতা সম্পর্কে একপ্রকার বোধ জন্মায়। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন বা কাছের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও এই সময়পর্বের ছেলে-মেয়েদের মনে এক বিরাট বদল লক্ষ্য করা যায়।
এই পরিবর্তনের সঙ্গে পড়াশোনার চাপ এবং সমাজের প্রত্যাশা— সব মিলেমিশে খুব উল্লেখযোগ্যভাবে তরুণ-তরুনীদের মনে বেশ চাপের সৃষ্টি হয়। অভিভাবকদের ক্ষেত্রেও সন্তানের বয়ঃসন্ধি পর্যায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ছেলে-মেয়েদের মানসিক সুস্থতার দিকে এইসময় বাবা-মাকে কড়া নজর রাখতে হয়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সময়কালকে মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনের পর্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। কিশোর-কিশোরীদের মস্তিষ্কের বিকাশের ধারা এই সময় থেকে শুরু হয়। তাই এই বয়সের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, সময়ের সদ্ব্যবহার করা, জীবনের লক্ষ্যকে স্থির করা এবং বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে অনেক অসুবিধা চোখে পড়ে।
”উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে যে সব সমস্যা খুব প্রকটভাবে দেখা যায়, সেগুলির মধ্যে রয়েছে সাবট্যান্স সম্পর্কিত সংকট, যৌনতাভিত্তিক সমস্যা, অনিদ্রাজনিত অসুবিধা, অস্বাস্থ্যকর খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস এবং প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি। যাইহোক, এই সমস্ত সমস্যাগুলি যখন গুরুতর আকার ধারণ করে, তখন তরুণ-তরুণীদের সামাজিক ক্ষেত্র এবং কাজকর্মের জায়গা, মূলত স্কুল বা  কলেজ-জীবনে তার কুপ্রভাব পড়ে। এইসময় তাদের প্রয়োজন হয় একজন মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞের সাহায্য।”—এমনই মত পোষণ করেছেন ডাক্তার প্রিয়া কায়স্থ আনন্দ। তিনি একজন ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট। ব্যাঙ্গালোরে শিশু এবং বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের সাইকোথেরাপি সংক্রান্ত চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব পালন করেন ডাক্তার আনন্দ।
ডাক্তার কায়স্থের মতে, কিশোর-কিশোরীদের মানসিকভাবে সুস্থ থাকার পিছনে দু’টি বিষয়ের উপস্থিতি একান্ত জরুরি। বিষয় দু’টি হল— সঠিক লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া এবং জীবনে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা অনুসরণ করা। অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েদের চালিকাশক্তি হিসেবে দু’টি পূর্বশর্ত হল— অন্তর্নিহিত সন্তুষ্টি এবং তৃপ্তি।
এই বয়সের একজন ছেলে বা মেয়ের জীবনের স্বাভাবিক চাহিদাসমূহ হল–

  • একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা এবং সম্মানপ্রদান জরুরি।
  • তাদের চিন্তাভাবনা ও অনুভূতিকে মূল্য দিতে হবে।
  • কিশোর বয়সের ছেলে-মেয়েদের ভাবানুবেগকে দৃঢ়ভাবে অনুধাবন করা দরকার।
  • এই বয়সের ছেলে-মেয়েদের সামনে সঠিক অভিভাবকত্বের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা অবশ্য কর্তব্য।
  • তাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে হবে।

বাবা-মায়েদের পক্ষ থেকে সন্তানের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বয়ঃসন্ধির সঙ্গে তাদের মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয় সহযোগিতা একান্ত কাম্য। এক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে একজনের করণীয় হল—

  • বাবা বা মায়ের ব্যক্তিত্ব কিশোর-কিশোরীর মনে প্রভাব বিস্তার করে। তাই তাদের সামনে নিজেদের আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা অভিভাবকদের প্রধান দায়িত্ব। এর জন্য চাই মনের আবেগানুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সন্তানের সঙ্গে কার্যকরী যোগাযোগ গড়ে তোলা।
  • ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে উদার, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ, সহানুভূতিশীল এবং গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ পরমত সহিষ্ণু হওয়া বাবা-মায়েদের একান্ত জরুরি।
  • মনের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা বিকাশের জন্য অনুশীলন করা।
  • বয়ঃসন্ধি পর্বের একজন ছেলে বা মেয়ের বিষয়ে যে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে তাদের ওয়াকিবহাল করাটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
  • পরিবারের সবাইকে নিয়ে মাঝে-মধ্যে অবসরযাপনের অভ্যাস গড়ে তোলা।
  • নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকার জন্য উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের ক্রমাগত উৎসাহ দান এবং তাদের নিজস্ব সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সঠিক অভিভাবকত্বের ভূমিকা পালন করা।
  • ছেলে-মেয়েদের সামনে তুলনা করার অভ্যাস বর্জন করা বাঞ্ছনীয়।

একজন তরুণ বা তরুণীর পক্ষে যে যে বিষয়ের সঙ্গে মোকাবিলা করা সম্ভব
সেগুলি হল—

  • সঠিক লক্ষ্যে চালিত ও নিয়মানুবর্তিতা অনুসরণ করা।
  • সেই সব বড়দের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে রাখা, যাঁরা তাদের কাছে বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি।
  • স্বাস্থ্যসম্মত ঘুমের প্রতি যত্নশীল হওয়া।
  • এই বয়সের ছেলে-মেয়েরা যে ধরনের খাওয়াদাওয়া পছন্দ করে তা প্রয়োজন মতো নিয়ন্ত্রণ করার মানসিকতা গড়ে তোলা।
  • যথাযথ কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করা।
  • ভবিষ্যতে একজন কিশোর বা কিশোরী কীভাবে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়, তার উপর ভিত্তি করে নিজেদের জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য স্থির করা।

একটা কথা সবসময় মনে রাখা জরুরি যে, প্রত্যেকটি বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়ে একে অপরের থেকে আলাদা এবং তারা লালিত-পালিত হয় পৃথক-পৃথক পরিবেশে। তাই এই বয়সের একজন ছেলে বা মেয়ে কিংবা তাদের বাবা-মা অথবা একজন শিক্ষকের ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধি পর্যায়ের প্রধান দায়িত্ব এবং কর্তব্যের প্রতি যত্নশীল হওয়া একান্ত কাম্য। এর ফলাফল সম্পর্কে অতিরিক্ত চিন্তাশীল এবং ভাবিত হওয়ার তেমন প্রয়োজন নেই।

Previous articleআত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রে
Next articleখেলার ছলে সন্তানের ভালো থাকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here