সাম্প্রতিক সময়ে মানসিক স্বাস্থ্যের যে আধুনিকায়ন এবং উন্নয়ন ঘটেছে তা একদিনে সম্পন্ন হয়নি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিভিন্ন ইতিহাস রচিত হয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য বা মানসিক সমস্যা ঘিরে। শুরু থেকেই মানসিক রোগ এবং চিকিৎসা সম্পর্কিত ধারণাগুলো ছিল খুবই রহস্যময়। একটা সময় মনে করা হত খারাপ আত্মা মস্তিষ্কে আটকে থাকার কারণে মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। সেসময় মানসিক সমস্যার চিকিৎসার জন্য মস্তিষ্কে ছিদ্র করা (ট্রিফাইনেশন) হত যাতে খারাপ আত্মা বেরিয়ে যেতে পারে। মেসোপটেমিয়ান এবং মিশরীয় প্যাপিরাস থেকে পাওয়া যায়, মহিলাদের মানসিক রোগের কারণ হিসেবে তারা ভ্রাম্যমাণ জরায়ুর ধারণায় বিশ্বাস করতেন। তারা মনে করতেন জরায়ু তার অবস্থান হতে স্থানচ্যুত হয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গা যেমন লিভার, বক্ষ, গহ্বর ইত্যাদিতে অবস্থান করে। একটা সময় ভাবা হত শরীরের বিভিন্ন ধরনের ফ্লুইডের তারতম্য মানসিক সমস্যার জন্য দায়ী। অনেকে সমাজে অভিশাপ, সৃষ্টিকর্তার অসন্তুষ্টিকে বা খারাপ আত্মার প্রভাবকে মানসিক ব্যাধির কারণ হিসেবে মনে করা হত। সেসময় এসবের চিকিৎসা পদ্ধতিও ছিল অদ্ভুত এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানবতাবিবর্জিত। হাত কেটে শরীর হতে রক্ত বের করে দেওয়া, জোর করে বমি করানো, বিশ্রী দুর্গন্ধযুক্ত জিনিসের ঘ্রাণ নিতে বাধ্য করা ইতাদি ছিল চিকিৎসা পদ্ধতি। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মানসিক অসুস্থ ব্যক্তিদের বিশেষ করে মহিলাদের ডাইনি হিসেবে চিহ্নিত করে মেরে ফেলা (উইচ হান্ট) হত।
ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগের দিকে মানসিক অসুস্থ রোগীদের প্রাতিষ্ঠানীকিকরণ শুরু হয়। লন্ডনের বেথেলহামের সেইন্ট মেরিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে রোগীদের রাখা হত। তখনও তাদের অবস্থা ছিল বেশ শোচনীয়। প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল মূলত তাদেরকে আটকে রাখার স্থান বা কারাগার। সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মানসিক অসুস্থ রোগীদের একপ্রকার তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেখানে আটকে রাখা হত। সেখানে তাদেরকে পশুর মতো মূল্যায়ন করা হত। তাদেরকে শিকল দিয়ে দেয়ালের সাথে বেঁধে রাখা হত, করা হত শারীরিক প্রহার। এমনকি মানুষের বিনোদনের চাহিদা মেটাতে মাঝে মাঝে তাদের নিয়ে করা হত প্রদর্শনী।
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে মানসিক রোগীদের প্রতি মানবতাবাদের উন্মেষ ঘটতে থাকে। ১৭৫৮ সালে ইটালিয়ান চিকিৎসক ভিনসেনযে কিয়ারুজি ইতালির ফ্লোরেন্সের সেইন্ট বোনিফেইস হাসপাতালে রোগীদের জন্য শিকলের ব্যবহার বন্ধ করেন। ১৭৯৬ সালে উইলিয়াম টুক ইংল্যান্ডের ইয়োর্কশ্যায়ারে মানসিক রোগীদের প্রতি ভদ্র ও সম্মানজনক আচরণের আহ্বান করেন। ১৯০৮ সালে ক্লিফোর্ড বিয়ারস এর ‘মেন্টাল হাইজিন মুভমেন্ট’ ছিল মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সেবার মনোন্নয়নে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর ওপর ভিত্তি করে ১৯০৯ সালে আমেরিকায় ন্যাশনাল কমিশন অব মেন্টাল হাইজিন তৈরি হয় যার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মাত্রা পায়।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সাইকো-এনালাইসিস এবং সাইকোথেরাপির মাধ্যমে রোগীদের চিকিৎসা করা হত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মূলত মানসিক রোগের চিকিৎসায় ওষুধের ব্যবহার শুরু হয়। এন্টিসাইকোটিকস, এন্টিডিপ্রেসেন্টস, ইসিটি ইত্যাদির ব্যবহার বাড়তে থাকে। ১৯৪৮ সালের ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, স্বাস্থ্যের যে সংজ্ঞা দেয় তাতে মানসিক স্বাস্থ্যের কথা উল্লেখ থাকে। ১৯৫২ সালে মানসিক রোগের শ্রেণিকরণ ও ডায়াগনোসিসের জন্য আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন ডায়াগনোস্টিক এন্ড স্ট্যাটিসটিকাল ম্যানুয়্যাল (ডিএসএম) প্রকাশ করে।
মানসিক স্বাস্থ্যের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করে ব্রিটিশ ন্যাশনাল এসোসিয়েশন ফর মেন্টাল হাইজিন ১৯৪৮ সালে। এই সম্মেলনে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ উঠে আসে। সম্মেলনের শেষের দিকে ‘মেন্টাল হাইজিনের’ পরিবর্তে ‘মেন্টাল হেলথ’ ব্যবহারকে লক্ষ্য করে গঠিত হয় ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ। মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশ সাধনের লক্ষ্যে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ ১৯৯২ সালের ১০ অক্টোবর সর্বপ্রথম মানসিক স্বাস্থ্য দিবস উদযাপন করে। প্রথম দিকে এর নির্দিষ্ট কোনো থিম ছিল না। ১৯৯৪ সালে প্রথম থিম সংযুক্ত হয়। এর পর থেকে প্রতিবছর নির্দিষ্ট থিম নিয়ে অক্টোবরের ১০ তারিখ দিবসটি উদযাপিত হয়ে আসছে। সময়ের সাথে সাথে মানসিক রোগের ডায়াগনোসিস এবং চিকিৎসায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। তবু মানসিক স্বাস্থ্য ও রোগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানান কুসংস্কার বিদ্যমান রয়েছে। অনেক শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও প্রয়োজনের সময় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে অনাগ্রহ দেখা যায়। এই অবস্থার পরিবর্তনে দরকার বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষের কাছে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সঠিক তথ্য তুলে ধরা এবং সার্বিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
ডা. মো. আরিফুজ্জামান
এম ডি রেসিডেন্ট, সাইকিয়াট্রি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট, ঢাকা।
সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৯ম সংখ্যায় প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে