নালা থেকে, ডোবা থেকে বেওয়ারিস লাশ যখন আমরা পাই, বুঝতে বাকি থাকে না যে তাদের ধর্ষণের পরে খুন করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে খবরে আমরা এমন সংবাদ পেতে পেতে; ধরেই নেই ধর্ষণোত্তর হত্যা একটি অস্বাভাবিক ঘটনার সাধারণ পরিণতি। কিন্তু এমন কেন হয়, কীভাবে একজন মানুষ চরমতম অমানুষ হয়! বিদেশে এ ধরনের সিরিয়াল কিলারদের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়, যাকে আমরা বলি কোয়ালিটেটিভ স্টাডি বা গুণগত গবেষণা। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক এবং বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আনোয়ারা সৈয়দ হকের একটি উপন্যাস নখ এ আমরা এমনটি দেখতে পাই। সেখানে এসিড ছুড়ে মারার অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের সাক্ষাৎকার নিতে দেখি উপন্যাসের নায়িকাকে।
গত বছর অক্টোবর মাসে হার্ভাড ইন্টারন্যাশনাল রিভিউতে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে, দেশে করোনা অতিমারির সময়ে নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা মহামারিতে রূপ নিয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১ হাজার নারী ধর্ষিত হয়েছে। ধর্ষণের পর মারা গিয়েছে ৪৬ জন। প্রায় দুইশরও বেশি নারী ধর্ষণের বিষয়টা কাউকে জানাননি। আমাদের দেশে সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষণের আসামীদের কোনো সাক্ষাৎকার নেওয়ার রিপোর্ট জানা যায়নি। তবে আমেরিকার একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ড. শ্যামুয়েল ডি স্মিথিম্যান ৫০ জন ধর্ষকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। দেখা গেছে, এই ৫০ জন ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান, ব্যক্তিত্ব, মানসিকতা বিভিন্ন। তাই বিশেষ করে বলা সম্ভব নয় কে ধর্ষণ করবে আর কে করবে না। তবে বিশেষ কয়েকটি দিক আবার মিল পাওয়া গিয়েছে। যা বলতে গেলে সব ধর্ষকের মধ্যেই ছিল।
এক- তাদের মধ্যে সহমর্মিতার অভাব
দুই- তারা অতি মাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক
তিন- নারীর প্রতি তারা হিংস্রতা অনুভব করত
মোটা দাগে, এটা বলা সম্ভব নয় যে যাদের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য আছে তারা সবাই তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে ধর্ষণ করবে। কিন্তু এমন ঐ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন পুরুষদের ব্যাপারে সতর্ক থাকা যেতে পারে। তাহলে জেনে নেওয়া যাক সহমর্মিতা কী, অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিকতা কী, নারীর প্রতি হিংস্রতা পোষণ করে সেটা আমরা কীভাবে বুঝব। সহমর্মিতা শব্দটি ইংরেজি এমপ্যাথি শব্দের বাংলা। এমপ্যাথি বলতে আমরা বুঝি অন্যের আবেগ অনুভূতিকে তার মতো করে বুঝতে পারার ক্ষমতা। সহজ উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, অন্যের জুতায় নিজের পা দিয়ে দেখা। অন্যের অবস্থানে নিজেকে কল্পনা করতে পারলেই সেটা পারা সম্ভব। কাজেই কোনো পুরুষের সঙ্গে মিশতে গেলে খেয়াল করা দরকার সে তার আবেগ অনুভূতিকে যথাযথভাবে বুঝতে পারছে কিনা। স্বাভাবিকভাবে কেউ যদি অন্যকে বুঝতে না পারে তাহলে সে নিজেকে নিয়েই থাকে, যা পরবর্তীতে অতি মাত্রায় আত্মকেন্দ্রিকতার দিকে নিয়ে যায়।
গ্রীক একটি শব্দ আছে নার্সিসিজম। নিজেকে বড়ো করে দেখা। এই নার্সিসিস্টিক মানুষগুলো সবসময় নিজেরটা বড়ো করে দেখতে অভ্যস্থ। অন্যের সুখ-দুঃখ তারা যেমন বুঝতে পারে না, তেমনি গুরুত্বও দেয় না। নারীর প্রতি হিংস্রতা পোষণ করছে কিনা সেটা কিন্তু আচরণ দেখেই বোঝা যায়। তারা অতিমাত্রায় পুরুষতান্ত্রিক। নারীকে হেয় করে দেখা, নারীর অবদানকে অস্বীকার করা এগুলো তো লুকানোর মতো আচরণ নয়। এই আচরণগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে এবং যাদের মধ্যে এই আচরণ আছে তাদেরকে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে। বস্তুত এটা কোনো তাৎক্ষণিক ব্যাপার নয়।
শিশু বয়স থেকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে ওঠা পর্যন্ত তাকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান ও তার যথাযথ বিকাশের দায়িত্ব বর্তায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর। শিশুবয়স থেকেই খেয়াল রাখা জরুরি আজকের শিশুটি ভবিষ্যতের জন্য কোনো বিষাক্ত মনোভাব নিয়ে বেড়ে উঠছে কিনা, বেড়ে উঠতে উঠতে সে কোনো বিকৃত মনোজগতে বিচরণের উপকরণ হাতের নাগালে পেয়ে যাচ্ছে কিনা। এ দায়িত্ব যেমন পরিবারের, তেমনি সমাজ রাষ্ট্রের দায়িত্বও সামাজিক বিকৃতিগুলোকে অপসারণ করা। যাতে নারীর প্রতি হিংস্রতার মতো বিষাক্ত প্রবণতাগুলোর সংক্রমণ হ্রাস পায়।
লিখেছেনঃ ডা. এস এম আতিকুর রহমান
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে