কিছুদিন আগে এক কিশোরীর সাথে কথা হলো তার জীবনের লক্ষ্য নিয়ে। সে বড় হয়ে মনোবিজ্ঞানী হতে চায়। সে বিজ্ঞান বিভাগের দশম শ্রেণীর ছাত্রী আর তার বাবা-মার ইচ্ছা সে ডাক্তার হবে। সে বাবা-মার কাছে শুনেছে মনোবিজ্ঞান ততোটা ভাল সাব্জেক্ট নয়। এটা পড়ে ততোটা ভাল করা যাবেনা! তাই তার মন খুবই খারাপ। সে একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণীর মনোবিজ্ঞান বইও পড়েছে। তার একাডেমীক রেজাল্ট বেশ ভালো আর পাশাপাশি এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিসগুলো চলছে। তাই তাকে কোনো ভাবেই কম মেধাবী কিংবা অলস বলা যাবে না। কিন্তু বাবা-মা কেন তার স্বপ্ন, তার জীবনের লক্ষ্যটা মেনে নিচ্ছেনা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। আমি তাকে প্রথমেই বললাম, ‘বুঝতে পেরেছি তোমার জীবনের লক্ষ্য একজন মনোবিজ্ঞানী হওয়া এবং সেজন্য তুমি উপরের ক্লাসের মনোবিজ্ঞান বইও পড়ে শেষ করে ফেলেছ।’
তাহলে এই মুহুর্তে আগামী এক বছরের জন্য তার লক্ষ্য জানতে চাওয়াতে সে বলল এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করা এবং এইচএসসিতেও বিজ্ঞান নিয়ে পড়া। এবার তাকে বললাম, “এইচএসসিতে কেমন রেজাল্ট করতে হবে মনোবিজ্ঞানী হতে চাইলে?” তার উত্তর, “অবশ্যই ভালো রেজাল্ট।” এবার মনোচিকিৎসক এবং মনোবিজ্ঞানীর পার্থক্য জানা আছে কিনা জানতে চাইলাম। ডাক্তার হয়ে সে সাইকিয়াট্রি নিয়ে পড়ে মনোচিকিৎসা দিতে পারবে জেনে সে খুশি হলো তাহলে বাবা-মার সাথে দ্বন্দ্বটা কমে যাবে সে নিজেই বলল। কিন্তু তাহলে কি মনোবিজ্ঞানী হতে পারবে না সে? আবার তার প্রশ্ন! বললাম, “বাবা-মা যে বলেছেন মনোবিজ্ঞান পড়ে ততোটা ভালো করা যাবেনা, এই ততোটা ভালো আসলে কিরকম?” তার সহজ উত্তর, “ভালো চাকরি হবেনা”। এ ব্যপারে তার মতামত জানতে চাইলাম। না, তার কোনো ধারনা নেই। বললাম, “যে কোনো যায়গায় ভর্তির জন্য এসএসসি এবং এইচএসসির রেজাল্ট এবং লক্ষ্য পূরণে কঠোর পরিশ্রম দরকার সেটা যদি তুমি প্লেন চালাও কিংবা পথে ইট ভাঙতে চাও। স্বপ্ন, কাজের প্রতি একাগ্রতা, আর কঠোর পরিশ্রম থাকলে যে কেউই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে।” না, আমার এ কথায় সে সন্তুষ্ট হলো না! মন খারাপ করে বলল, “তাহলে তো সবাই ক্লাসে প্রথম হতো। চাইলেই কি সবাই সফল হয়?” খুব যুক্তি আছে তার কথায় তাই বললাম, “হুম, তোমার সাথে আমি একমত সবাই ক্লাসে প্রথম হয় না, সবাই সফল হয়না কারণ সময়ের সাথে সাথে আমাদের স্বপ্ন বদলে যায়। আমরা কেউ কেউ বাধা পেলে থেমে যাই, কেউ হেরে যাবার ভয়ে আগাতেই চাই না, কেউ রোল মডেল হিসেবে তেমন কাউকে পাই না, কেউ পরিবার-পরিবেশ থেকে উৎসাহ পাই না, পাই না সঠিক দিক-নির্দেশনা।” তার উত্তর, “হুম, জীবনে একজন মেন্টর দরকার, দরকার পথ নির্দেশনা দেবার কেউ আর ইচ্ছা শক্তি আর পরিশ্রমও করতে হবে বুঝলাম।”
এ প্রসঙ্গে বলার উদ্দেশ্যই হলো আমাদের কিশোর বয়সী সন্তানেরা জীবনের লক্ষ্য নিয়ে ভীষণ আবেগ প্রবণ ও স্পর্শকাতর হয়ে উঠে সে সম্পর্কে ভাবা।
পুরাতন প্রবাদ আছে, “পরিকল্পনাহীন একটি লক্ষ্য শুধুমাত্র একটি ইচ্ছা, সেটা লক্ষ্য বা গোল নয়”। আপনি আপনার সন্তানকে যখন ভালো রেজাল্টের জন্য বেশি সময় পড়া কিংবা কোনো কাজ করার জন্য যত বেশি চাপ দেবেন, ততই সে তার যুক্তি দেখাবে এবং আপনাকে প্রতিরোধ করবে। তার সাথে দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগও বেড়ে যাবে। এভাবে পারিবারিক উদ্বেগ চক্র গতিশীল হবে।
এই অবস্থা সামলাতে সব বাবা-মা’ই অত্যন্ত কঠোর হন (Authoritarian Parents) । আবার কেউ একদমই যা চায় সব করতে দেন (Permissive Parents) । কিন্তু বাবা-মা হিসেবে আমরা যেন বন্ধুর মত তার ইচ্ছার গুরুত্ব দেয় এবং সময় নিয়ে শুনি সে কী হতে চায়, নিজেকে কোথায় দেখতে চায়। সময়ের সাথে সাথে তার মাঝে পরিপক্বতা আসবে এবং আপনি তাকে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি দিয়ে পথ দেখালে সঠিক পথ সে নিজেই বেছে নিতে পারবে। আমরা যেন সহনশীল এবং বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করি এই সময়টায় (Authoritative Parents) ।
‘বাস্তব পরিকল্পনা বা প্রচেষ্টা ছাড়াই, এমনি সব ঠিক হয়ে যাবে’ এটি একটি ভুল বিশ্বাস। আমরা যখন বলি, “তোমাকে এখনই এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না” তখন তার চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করা হয় যা বাস্তব জগতে প্রবেশের সময় তার চিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
আপনার সন্তানকে একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করতে শেখান। লক্ষ্য অগ্রগতি-পর্যবেক্ষণের জন্য কিছু নির্দেশিকা স্থাপন করুন।
লক্ষ্য স্থির করা
আপনার সন্তানকে এমন একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করতে বলুন যা তার আগ্রহের ক্ষেত্র এবং আপনি তার আচরণে যে পরিবর্তন দেখতে চান তার সাথে সম্পর্কিত। মনে রাখবেন শিশুরা, এমনকি বয়:সন্ধিকালেও তাদের নিজেদের লক্ষ্য নির্ধারণে কঠিন সময় পার করে। ছোট ছোট কাজ দিয়ে শুরু করুন।
স্বপ্ন এবং জীবনের লক্ষ্যের গুরুত্ব
সন্তানের লক্ষ্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অভিনেতা/অভিনেত্রী বা পেশাদার খেলোয়াড় বা যে কোনো কিছুই হোক তা স্কুল-কলেজে পড়ার সময়েই গড়ে তুলতে সাহায্য করুন। আপনার সন্তানের স্বপ্নকে সমর্থন করা এবং তাদের প্রতিভা এবং আগ্রহগুলো অন্বেষণ করে আগানো তার বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ফিনিস লাইনে আসা
প্রতিটি পরিকল্পনার পরিণতির ভালো-খারাপ দিক, সমস্যাবলী, সময়সীমা ইত্যাদি কেমন হতে পারে সেটা নিয়ে আলোচনা করুন। উদাহরণস্বরূপ- আপনার সন্তান একজন ইউটিউবার হতে চায় এটা শুনে রেগে না গিয়ে এর পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করুন।
সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা
আপনার শিশু তার পছন্দসই লক্ষ্যের ব্যপারে 5W+H প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে কিনা তা নিশ্চিত করুন। যেমন- কে, কী, কখন, কোথায়, কেন এবং কীভাবে? যদি তার উত্তরগুলো পর্যবেক্ষণযোগ্য হয়, তার মানে আপনি পরিকল্পনাটির প্রায়োগিক রূপ দেখতে পাচ্ছেন। পরিমাপযোগ্য হওয়ার অর্থ হলো আপনি পরিবর্তনগুলো দেখানোর জন্য সংখ্যা ব্যবহার করতে পারেন। যেমন- স্কুলের পড়া বা অন্য কাজে অংশগ্রহণের সময় প্রাপ্ত নম্বর বা গ্রেড। বাস্তবসম্মত মানে হলো যে পরিকল্পনাটি সন্তানের ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। অর্থাৎ আকাশ কুসুম চিন্তা কিংবা রূপকথার মত যেন না হয়। সর্বোপরি, পরিকল্পনাটি খুব সহজ রাখুন।
ধাপে ধাপে আগানো
এক এক করে এক ধাপ এগিয়ে যান। উদাহরণস্বরূপ- আপনার সন্তান যদি একজন পেশাদার সঙ্গীতশিল্পী হতে চায় তাহলে তাকে প্রতিদিন অনুশীলন করতে দিন। যদি আপনার সন্তানের লক্ষ্য একটি নির্দিষ্ট স্কুলের বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত হয় তাহলে লক্ষ্য হতে পারে যে প্রতিদিন সেই বিষয়ে অতিরিক্ত ১৫ মিনিট সময় ব্যয় করা। একবারে বসে অনেক সময় ধরে সব হোমওয়ার্ক করা তার জন্য বিরক্তিকর হতে পারে। তবে আপনি কিছু কাজ করতে পারেন। যেমন- যতক্ষণ না সে পড়াশোনা শেষ করে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য টিভি/ ইন্টারনেট বন্ধ রাখা।
লক্ষ্য পর্যবেক্ষণ করা
আপনি এবং আপনার সন্তান যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন যে, সে কী নিয়ে কাজ করবে। একটি লিখিত ডকুমেন্ট ডাইরী থাকতে পারে। এটি কীভাবে চলছে, পরিকল্পনার কোন অংশ কাজ করছে এবং কোন অংশটি নয়। সে সম্পর্কে নিয়মিত অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের জন্য সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট মিটিং হতে পারে।
প্রচেষ্টা, অগ্রগতি এবং পুরস্কার
প্রচেষ্টা এবং অগ্রগতি বুঝে সাপ্তাহিক চেক-ইনের পর তাকে পুরস্কৃত করতে পারেন। পুরষ্কারগুলো সহজ, সাশ্রয়ী মূল্যের এবং বৈচিত্র্যময় রাখুন যাতে তার আগ্রহ থাকে এবং আপনার উপরও অর্থিক চাপ না পড়ে।
দৃষ্টান্ত দিন তুলনা নয়
আপনার সন্তানকে বিখ্যাত সফল মানুষের উদাহরণ দিন। অবশ্যই সাথে সমালোচিত এবং অসফল ব্যক্তিদের জীবনী জানারও সুযোগ দিন। আপনার নিজের সফলতা এবং ব্যর্থতার গল্পগুলো নির্দ্বিধায় বলুন। এখান থেকে সে প্রকৃত শিক্ষা পাবে।
জবাবদিহিতা
সন্তানকে তার দায়িত্ব পালন এবং তার লক্ষ্যের দিকে কাজ করার জন্য জবাবদিহি করতে হবে সেই অনুশীলন রাখুন। প্রতিটি ব্যর্থতার পর্যালোচনা যে ভবিষ্যৎ সফলতার চাবিকাঠি তা তাকে বুঝতে সাহায্য করুন। কটাক্ষ না করে তাকে প্রশ্ন করুন। তার অভিমত, যুক্তিকে সম্মান করুন এবং আপনার অর্থবহ মতামত দিন। এটি একটি সাপ্তাহিক আপডেট দেয়ার মতো হতে পারে। মনে রাখবেন, রোম একদিনে নির্মিত হয়নি।
শখ নাকি পেশা
শিশু-কিশোরদের পেশা, নেশা, শখের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে দিতে হবে। অনেক বাবা-মাই সন্তানের পেশাকে আর্থিক স্বচ্ছলতা দিয়ে মূল্যায়ন করতে পছন্দ করেন। জীবনে কেনো অর্থনৈতিক উন্নতি প্রয়োজন সেটা তাকে যুক্তি দিয়ে নমনীয়ভাবে জানান। অর্থ উপার্জন করেও কিভাবে শখের কাজগুলো করা যেতে পারে তা নিয়ে কথা বলুন। সময়ের সাথে সন্তানের শখ এবং স্বপ্নকে গলা টিপে হত্যা করা হলে ক্যারিয়ার জীবনে সে যতই সফল হোক না কেনো না পাওয়ার ব্যাথা তাকে তাড়িয়ে বেড়াবে আমৃত্যু।
পরিশেষে, আমরা নিজের জীবনে কঠোর পরিশ্রম না করে সন্তানের কাজের সাফল্য কামনা করলে সেটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক হতে পারে। বাচ্চারা কাজ না করলে কিংবা কাজে ব্যর্থ না হলে, কঠোর পরিশ্রম এবং প্রাপ্তির আনন্দের মধ্যে সংযোগ দেখতে পাবেনা।খুব কম লোকই স্বাভাবিক জীবন যাপন থেকে রাতারাতি পত্রিকার প্রচ্ছদে আসে। আপনার সন্তানকে প্রথমে ছাত্র হতে সাহায্য করার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত এবং দ্বিতীয়টি তার স্বপ্নের পেশার ছাত্র। সহজ, ছোট পরিবর্তনগুলো খুঁজুন যা সময়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং আপনার সন্তানকে বাস্তববাদী এবং দায়িত্বশীল হতে শিখতে সাহায্য করবে। আমরা বাচ্চাদেরকে জিজ্ঞেস করি, “বাবা তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও? আমরাই তাদের বলি, ‘আমি চাই তুমি অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ে, অমুক মেডিকেলে পড়’। আমরা কি আজকে থেকে এভাবে বলতে পারি, “বাবা তুমি বড় হয়ে এই পৃথিবীর মানুষের জন্য কী কী ভালো কাজ রেখে যেতে চাও?” ভেবে দেখবেন আশা করি।
ফারজানা ফাতেমা (রুমী)
মনোবিজ্ঞানী, “শৈশবকালীন প্রতিকূলতা ও নিউরো ইমেজিং স্টাডি বাংলাদেশ”, আইসিডিডিআর, বি।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে