করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকানোর একটা পদক্ষেপ হিসাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং স্বেচ্ছায় নিজেকে আলাদা করে রাখার অর্থাৎ সেলফ আইসোলেশনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
বিশ্বের যেসব দেশে এই ভাইরাসের দ্রুত বিস্তার ঘটছে, সেখানে নিত্য প্র্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রির দোকান ছাড়া আর সব দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। লাইব্রেরি, বাচ্চাদের খেলার মাঠ, বাইরে ব্যায়াম করার জিম এবং অনেক ক্ষেত্রে উপসনালয়গুলোও বন্ধ রাখা হচ্ছে।
ব্রিটেনে দুজনের বেশি কেউ এক জায়গায় জড়ো হতে পারবে না। এক্ষেত্রে একমাত্র ছাড় দেয়া হচ্ছে একই পরিবারের সদস্যদের।
একশ তিরিশ কোটি মানুষের দেশ ভারতে আজ বুধবার থেকে কার্যকর হয়েছে পুরো ‘লকডাউন’। যা বলবৎ থাকবে তিন সপ্তাহ।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বিভিন্ন দেশের সরকার বলছে শুধু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস এবং ওষুধ কেনার জন্য বাজারে যেতে এবং প্রয়োজন হলে ও সুযোগ থাকলে ঘর থেকে অফিসের কাজ করতে।
কিন্তু বাইরে যাদের বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে তাদের জন্য যেসব পরামর্শ দেয়া হচ্ছে:
বাইরে বের হতে হলে আমার কী করণীয়?
যদি বাজারে যেতেই হয়- খাবারদাবার বা ওষুধপত্র কিনতে- তাহলে পরস্পরের মধ্যে দুই মিটারের বেশি দূরত্ব বজায় রাখবেন। কারো দুই মিটার বা সাড়ে ছয় ফুট দূরত্ব ছেড়ে থাকবেন।
বহু দেশে রেস্তোঁরা, ক্লাব, থিয়েটার, সিনেমা, বিনোদন কেন্দ্র, শপিং মল ইতোমধ্যেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সামাজিক দূরত্ব তৈরি করার খাতিরে।
আর যাদের জ্বরের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে বা শুকনো কাশি অথবা অনেক জ্বর উঠছে তাদের বারবার করে বলা হচ্ছে তারা যেন বাসার ভেতর আলাদা থাকেন, একেবারেই বাইরে না বেরন অর্থাৎ তারা যেন স্বেচ্ছায় নিজেদের সবার থেকে বিচ্ছিন্ন রাখেন যাতে তাদের থেকে অন্য কেউ সংক্রমিত না হয়।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা কেন জরুরি?
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা খুবই জরুরি, কারণ আক্রান্ত কেউ হাঁচি কাশি দিলে তার সূক্ষ্ম থুতুকণা যাকে ইংরেজিতে ‘ড্রপলেট’ বলা হয় তা বাইরে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এই ড্রপলেটের মধ্যে ঠাসা থাকে ভাইরাস।
যেসব জায়গায় এই কণাগুলো পড়ছে সেসব জায়গা যদি আপনি হাত দিয়ে স্পর্শ করেন, এবং তারপর আপনার সেই অপরিষ্কার হাত আপনি মুখে দেন অথবা খুব কাছ থেকে সেই কণাগুলো নি:শ্বাসের মধ্যে দিয়ে আপনার শরীরে ঢোকে, আপনি সংক্রমিত হবেন।
আপনি যদি অন্য ব্যক্তিদের সঙ্গে বেশি সময় না কাটান, অন্যদের খুব কাছে না যান, আপনার সংক্রমিত হবার সম্ভাবনাও কমবে।
কোন কোন দেশে আরো কঠোর পদক্ষেপ
কোন কোন দেশ যেখানে এই ভাইরাস মারাত্মকভাবে ছড়িয়েছে বা যেসব দেশ ছড়ানোর আশংকায় রয়েছে সেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
- পুরো ইতালিতে ৯ই মার্চ থেকে লকডাউন চলছে।
- এই সপ্তাহান্তে ইতালির লম্বার্ডি এলাকায় মানুষকে বলা হয়েছে তারা যদি বাইরে ব্যায়াম করতে চান তা করতে হবে নিজের বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই।
- স্পেনে খাবার ও ওষুধ কেনা বা কাজে যাওয়া ছাড়া কারোর ঘরের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
- আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে কয়েকশ লাখ মানুষকে বাসায় থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
- বেলজিয়ামে বাসিন্দাদের ৫ই এপ্রিল পর্যন্ত ঘর থেকে না বেরতে বলা হয়েছে। হাঁটা বা ব্যায়াম করার জন্য বাইরে বেরনর অনুমতি আছে তবে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তা করতে হবে। সবধরনের সামাজিক জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
- ফ্রান্সে ১৫ দিনের জন্য কঠোর লকডাউন বলবৎ করা হয়েছে। বাসা থেকে বেরলে কেন বের হচ্ছে বাসিন্দাদের তার স্বপক্ষে নথিপত্র দেখাতে হবে। এক লাখের বেশি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। নির্দেশ অমান্য করলে যাদের ১৩৫ ইউরো জরিমানা করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
- জার্মানিতেও দুজনের বেশি একসঙ্গে বৈঠক করতে পারবে না।
- ব্রিটেনেও দুজনের বেশি কেউ এক জায়গায় জড়ো হতে পারবে না। এবং নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার ও ওষুধ কেনা ছাড়া বাইরে বেরন যাবে না এবং বাইরে হাঁটা বা জগিং বা বাইরে ব্যায়ামের জন্য বেরন যাবে দিনে একবার।
- ভারতেও পুরো দেশে সম্পূর্ণ লকাডাউন ঘোষণা করা হয়েছে তিন সপ্তাহের জন্য।
সেলফ আইসোলেশন বা স্বেচ্ছায় আলাদা থাকার মানে কী?
সেলফ আইসোলেশন মানে ঘরে থাকবেন- বাইরে যাবেন না- একমাত্র হাঁটাহাঁটি বা জগিং-এর মত ব্যায়ামের জন্য ছাড়া। এই সময়ে কাজে যাবেন না, স্কুল কলেজ বা জন সমাগম হয় এমন কোন জায়গায় যাবেন না।
এমনকী সম্ভব হলে, নিত্য প্রয়োজনীয় খাবারদাবার কিনতেও বের হবেন না। এ ব্যাপারে অন্য কারো সাহায্য নেবেন। তবে মনে রাখবেন যে আপনাকে সাহায্য করছে তার দু মিটার দূরত্বে থাকবেন, বা যদি বাইরে একান্তই যেতে বাধ্য হন তাহলে সামাজিকভাবে কারো কাছাকাছি যাবেন না।
সেলফ আইসোলেশনে কখন ও কেন যাবেন?
করোনাভাইরাসের কোনরকম উপসর্গ যদি দেখা দেয় অর্থাৎ আপনার ৩৭.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর জ্বর ওঠে, ক্রমাগত শুকনো কাশি হতে থাকে অথবা শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন। এবং আপনার সঙ্গে একই বাসায় বা ফ্ল্যাটে থাকে এমন কারো যদি এধরনের উপসর্গ দেখা দেয়।
- আপনি যদি একা থাকেন, তাহলে লক্ষণ প্রকাশ পাবার পর থেকে ৭ দিন ঘরের ভেতর থাকবেন।
- যদি আপনার অথবা আপনার বাসার কারো উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে বাসার সবাইকে ১৪ দিন বাসায় থাকতে হবে এবং কোভিড-১৯ এর লক্ষণগুলো প্রকাশ পাচ্ছে কিনা সেদিকে নজর রাখতে হবে।
- এই সময় যদি বাসার আর কেউ অসুস্থ হয় অর্থাৎ কারো লক্ষণ প্রকাশ পায়, তার ৭দিনের আইসোলেশন শুরু হবে লক্ষণ প্রকাশ পাবার দিন থেকে।
- অর্থাৎ আইসোলেশন শুরু হবার তৃতীয় দিনের মাথায় যদি বাসার অন্য কারো লক্ষণ ধরা পড়ে, তাহলে দশদিনের মাথায় আপনাদের আইসোলেশনের মেয়াদ শেষ হবে।
- কিন্তু কারোর যদি ১৩দিনের মাথায় লক্ষণ প্রকাশ পায়, তাহলে তার ৭ দিনের আইসোলেশন শুরু হবে ১৩দিনের দিন থেকে এবং ওই বাসার সবাইকে মোট বিশ দিন আলাদা হয়ে থাকতে হবে।
লক্ষণ প্রকাশ পাবার পর যখন সেলফ আইসোলেশনে বা স্বেচ্ছায় আলাদা থাকবেন তখন এমন রুমে থাকবেন যেখানে আলো বাতাস ঢোকে। পারলে জানালা খুলে রাখবেন এবং বাসার অন্য মানুষদের কাছ থেকে দূরে থাকবেন।
কাদের একেবারেই বের হওয়া উচিত নয়?
যাদের অন্যধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে ব্রিটেনে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা তাদের ১২ সপ্তাহ একেবারে বাসার ভেতরে থাকার পরামর্শ দিয়েছে। এদের মধ্যে থাকছে:
- যারা কোনরকম ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছেন
- যাদের অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়েছে
- জেনেটিক কোন রোগ আছে যাদের
- যাদের শ্বাসতন্ত্রের বড় ধরনের সমস্যা আছে যেমন সিস্টিক ফাইব্রোসিস (ফুসফুসের কলার রোগ) এবং ক্রনিক ব্রংকাইটিস
- শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমানোর জন্য যারা বিশেষ ওষুধ খান (ইমিউনো সাপ্রেসেন্ট ওষুধ)
- গর্ভবতী যেসব নারীর হৃদযন্ত্রের সমস্যা আছে।
সূত্র: বিবিসি