মানসিক সমস্যা ও রোগ নিয়ে বিভ্রান্তির শেষ নেই। নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমাদের চারপাশে। এসব বিষয় আমরা বুঝতে পারলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেশ একটা উদাসীনভাব লক্ষ্য করা যায় আমাদের মধ্যে।
‘মানসিক রোগ’ আসলে কোনো রোগ কিনা, এ বিষয়েও প্রশ্ন দেখা যায় অনেকের মধ্যে। আবার এর চিকিৎসা, চিকিৎসা পদ্ধতি থেকে শুরু করে সুস্থতা অসুস্থতা নিয়েও বিভিন্ন রকম কথাবার্তা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি।
পাঠক যদি একটি একটি করে জানতে চান, তবে তার প্রত্যেকটির আলাদা করে উত্তর নিয়ে পূর্ণ একটি করে লেখা তৈরি করা সম্ভব। আপাতত অতি পরিচিত ও প্রচলিত একটি বিভ্রান্তি নিয়ে কথা বলি।
কখন হতে পারে মানসিক রোগ বা মানসিক সমস্যা?
এক কথায় উত্তর, যে কোনো বয়সে, যে কোনো সময়। নির্দিষ্ট করে বলার মতো কোনো উত্তর নেই।
যারা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তাদের প্রত্যেককেই একটা কথার মুখোমুখি হতে হয়, আর তা হলো-‘ডাক্তার সাহেব বিশ্বাস করেন, আগে কোনো দিন ওর মাঝে এমন কোনো সমস্যা ছিল না’। অথবা ‘আগে তো কোনো দিন ও এমন করতো না’, কিংবা ‘ছোটকাল থেকে ওতো ভালোই ছিল’। আর এসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের উত্তর হয় ‘আগেতো ওর রোগটি ছিল না’।
উত্তর শুনে, অনেকেই হতাশ হন। তাদের হয়তো বিষয়টি মেনে নিতে কষ্ট হয়।
শেষ পর্যন্ত তারা হয়তো এমন ভাবে যে,
– মানসিক রোগ নতুন করে শুরু হতে পারেনা।
– মানসিক রোগ ছোট বয়স থেকেই শুরু হতে হবে।
– উল্টোভাবে বলা যায়, ছোটবেলা থেকে কেউ কোনো সমস্যায় থাকলে বা পড়লে সেটাই মানসিক রোগের মধ্যে পড়বে। অন্যথায় সেটা অন্য কোনো সমস্যা, মানসিক রোগ নয়।
বস্তুত মানসিক রোগ যেকোনো বয়সে, যেকোনো মানুষের, যেকোনো সময় হতে পারে। নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয় যে, এত বছরের আগে হলে মানসিক রোগ নয় কিংবা এত বছরের পরে হলে সেটা মানসিক রোগ।
তবে অন্য যেকোনো শারীরিক রোগের মতোই কিছু কিছু মানসিক রোগ বা সমস্যা আছে যেসব নির্দিষ্ট কিছু বয়সে বা সময়ে হতে পারে। কিছু রোগ যেমন জন্মগত, কিছু বংশগত, কিছু প্রকৃতি নির্ভর, কিছু আবার বয়স নির্ভরও হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন রকমের মানসিক চাপ, ওষুধের প্রভাব (নেশা দ্রব্যসহ) থেকে শুরু করে অনেক কারণেই মানসিক রোগ হতে পারে। যার উপর যখন বা যে বয়সে এসব ভর করে, তখনই তার কোনো না কোনো রোগ বা সমস্যা হতে পারে। এখানে বয়স নিজে কোনো বিষয় নয়।
ধরুন, কারো কিডনি রোগ হলে তা যেমন নির্দিষ্ট কোনো বয়সে হয় না , বরং ছোট কিংবা বড় যেকোনো বয়সেই হতে পারে। তেমনি মানসিক রোগও ছোট কিংবা বৃদ্ধ যে কারোরই হতে পারে।
তবে শারীরিক রোগের সঙ্গে মানসিক রোগের একটি বড় রকমের তফাৎ হলো, প্রকাশের ক্ষেত্রে। একই মানসিক রোগ ভিন্ন বয়সে, ভিন্ন রকমের প্রকাশভঙ্গী নিয়ে হাজির হতে পারে। এমনকি একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রেও এ পার্থক্য দেখা যেতে পারে। কারো সাত- আট বছরে যদি কোনো একটি মানসিক রোগ হয়, তার তখন যেভাবে প্রকাশ পাবে, একই রোগ- একই ব্যক্তির ৪০, ৫০ কিংবা ৬০ বছর বয়সে একই রূপে প্রকাশ নাও হতে পারে। সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারে রোগের প্রকাশ। কিন্তু কিডনির কোনো একটি রোগের প্রকাশ কিন্তু সব বয়সেই প্রায় একই রকম হবে। এটা শারীরিক রোগের তুলনায় মানসিক রোগের বড় একটি পার্থক্য।
মানসিক রোগের ক্ষেত্রে বয়স সংক্রান্ত বিষয়টিকে গুলিয়ে ফেলার বড় কারণ সম্ভবত মানসিক প্রতিবদ্ধিতাকে মানসিক রোগের সাথে মিলিয়ে ফেলা। আমরা জানি মানসিক প্রতিবন্ধিতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জন্মগত (কিছু কিছু পরবর্তীতেও শুরু হতে পারে), অর্থাৎ ছোটবেলা থেকেই আচরণের ভিতর কিছু কিছু অসংলগ্নতা দেখা যায়। অনেকেই হয়তো ধারণা করেন, শুধু এসবই মানসিক রোগের লক্ষণ। তাই জন্ম থেকে শুরু হওয়া সমস্যাগুলোকেই মানুষ অন্যদের ক্ষেত্রেও খুঁজে বেড়ান। সেসব না থাকলে মানসিক রোগ হবে না বলেই অনেকে ধরে নেয়।
যদি সমস্যাগুলো ছোটবেলা থেকে না থেকে থাকে, তবে সেসবকে মানসিক সমস্যা ভাবতেও অনেকের অসুবিধা হয়। এমনকি বিশেষজ্ঞের মুখ থেকে শোনার পরও মানতে অনীহা। এসবের পেছনের কারণ হিসেবে, রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক শিক্ষা সংক্রান্ত অনেক কিছুই বিদ্যমান। একদিনে সব সমস্যা দূর করা সম্ভব নয় জানা কথা, তবে দ্রুতই শুরু হওয়া দরকার। মনে রাখতে হবে, যে কারণেই হোক, রোগগুলো সঠিক সময়ে চিহ্নিত করতে না পারার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন, আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তার পরিবার।
মানসিক স্বাস্থ্য, মানসিক রোগ বিষয়ক বিভ্রান্তিগুলো যতদ্রুত সম্ভব দূর করা উচিৎ। বিভ্রান্তি দূর করে যত দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনা যায় আক্রান্ত লোকটির জন্য, তার পরিবারের জন্য এমনকি দেশের জন্য ততই মঙ্গল।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনেরখবর-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য মনেরখবর কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।