কখনও ভেবে দেখেছেন যে পরীক্ষার আগে হঠাৎ কেন আপনার হাত পা কাঁপত? কেনই বা ইন্টার্ভিউ-র আগে আপনার হাতের চেটো ঘেমে যেত? এগুলো কিন্তু স্বাভাবিক। একবার পরীক্ষা বা ইন্টার্ভিউ শুরু হয়ে গেলে পর, খানিকক্ষণের মধ্যে আপনি শান্ত হয়ে যেতেন। এত চাপের ফলে কিন্তু আমরা মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারি।যদিও অনেকেই অকারণে, অযৌক্তিক ভয় পান।
এবং তাঁরা চেষ্টা করেও সেই উদ্বেগ ও ভীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। তাদের উদ্বিগ্নতা দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে। এংজাইটি ডিস্অর্ডার কথাটা তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
সাধারণ উদ্বিগ্নতা এবং এংজাইটি ডিস্অর্ডার এর পার্থক্য
রেগুলার এংজাইটি বা সাধারণ উদ্বিগ্নতা | এংজাইটি ডিস্অর্ডার |
চাকরির ইন্টার্ভিউ, বিলের টাকা জমা বা পরীক্ষা নিয়ে চিন্তা করা | অকারণে সবসময় দুশ্চিন্তা করা |
লোকের সামনে কিছু বলবার আগে বুক ঢিপঢিপ করা | কোনও অবস্থাতেই লোকের সামনে কিছু বলার বা করার কথা চিন্তা মাত্র অসুস্থ হয়ে যাওয়া |
বিপজ্জনক জিনিষ দেখে ভয় পাওয়া, যেমন হিংস্র পাগলা কুকুর সামনে চলে এলে… | অযৌক্তিক ভয়, লিফ্টে আটকে যাওয়ার ভয়ে লিফ্ট না চড়া |
কোনও প্রিয়জনের মৃত্যুতে গভীর শোকাহত হওয়া | ভুলতে না পারা, বারংবার সেই স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠা এবং সেইসমস্ত নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখা |
নিজেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা | অতিরিক্ত শুচিবায়ু |
খেলার আগেই ঘামে গোটা শরীর ভিজে যাওয়া | নার্ভাস হয়ে গিয়ে বার বার প্যানিক অ্যাটাকের শিকার |
এংজাইটি ডিস্অর্ডার এর উপসর্গ কি?
আমরা সকলেই কম বেশী ভয় পাই, দুশ্চিন্তা করি। কাজেই, চট করে এই রোগ ধরতে পারা মুস্কিল। কিন্তু দীর্ঘ সময় জুড়ে অকারণ দুশ্চিন্তায় জীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠলে একবার মনোবিদের পরামর্শ নেওয়ার কথা ভেবে দেখুন। নিম্নলিখিত উপসর্গগুলি এংজাইটি ডিস্অর্ডার বা উদ্বিগ্নতাজনিত মানসিক সমস্যা রোগে দেখা যেতে পারেঃ
- হৃদস্পন্দন ও নিশ্বাস প্রশ্বাসের গতি বৃদ্ধি
- শিরায় টান
- বুকে খিঁচ ধরা
- অস্থির মনোভাব এবং ক্রমাগত দুশ্চিন্তায় ভোগা
- ফালতু জিনিষ নিয়ে মাথা ঘামানো
ইত্যাদি হতে পারে এংজাইটি ডিস্অর্ডার বা উদ্বিগ্নতাজনিত মানসিক সমস্যা রোগের উপসর্গ।
যে সমস্ত কারণে এংজাইটি ডিস্অর্ডার হয়ে থাকে তা হলঃ
- পারিবারিক ইতিহাস – পরিবারে আগে কারোর কোনও মানসিক রোগ, যেমন ও সি ডি হয়ে থাকলে, এংজাইটি ডিস্অর্ডারে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে।
- মানসিক চাপ – কাজের চাপ, প্রিয়জনের মৃত্যু বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপড়েন থেকেও এই রোগ হবার সম্ভাবনা থেকে যায়।
- শারীরিক সমস্যা – থাইরয়েড, আস্থমা, ডায়াবিটিস বা হৃদরোগও কখনও কখনও এই রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি, ডিপ্রেশন থেকেও অনেক সময় এংজাইটি ডিস্অর্ডার শুরু হয়।
- নেশা – অত্যাধিক মদ ও মাদকদ্রব্যের আসক্তিও কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে।
- ব্যক্তিত্ব ও মানসিকতা – যারা নিখুঁত কাজকর্ম করতে ভালবাসেন বা অন্যের পরামর্শ অনুযায়ী চলেন, তাঁদের পরবর্তীকালে এংজাইটি ডিস্অর্ডার হবার ঝুঁকি থেকে যায়।
এংজাইটি ডিস্অর্ডার কত প্রকারের হয়?
ক্ষেত্র-বিশেষে, এংজাইটি ডিস্অর্ডার বিভিন্নরকম হতে পারেঃ
সাধারণ এংজাইটি ডিস্অর্ডার বা জিএডি
জি এ ডি আক্রান্ত ব্যক্তিরা যে কোনও পরিস্থিতিতেই অত্যাধিক দুশ্চিন্তায় ভোগেন। সেই দুশ্চিন্তা তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না বলে একরকম মানসিক অস্থিরতায় দিন কাটান। এঁরা নিজেকে এক “দম দেওয়া পুতুলের” সাথে তুলনা করেন।
অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিস্অর্ডার বা ওসিডি
এঁরা নির্দিষ্ট ভয় বা দুশ্চিন্তা কাটানোর জন্য একই কাজ বারংবার করতে থাকেন। উদাহরণ স্বরূপ, জীবাণুর ভয়ে বার বার হাত-পা ধোয়া, কাপড় কাচা, বাসন মাজা বা ঘর মোছা।
সামাজিক ভয় বা এসএডি
এঁরা সাধারণত লোকের সামনে কোনও কিছু করতে বা বলতে ভয় পান। কারণ এঁরা ভাবেন যে সবাই প্রতি মুহূর্তে তাঁদের খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছে। সামান্য ভুল করলে তিনি হাস্যাস্পদ হয়ে উঠবেন। এমন কি নেমন্তন্ন বাড়িতে খেতেও ভয় পান।
নির্দিষ্ট জিনিসে ভয় বা ফোবিয়া
এই পরিস্থিতিতে ব্যক্তি অযৌক্তিক ও অবাস্তব ভয়ের চোটে নির্দিষ্ট জিনিসপত্র এড়িয়ে চলেন। প্লেনে চড়তে, উঁচু বাড়িতে উঠতে, ভিড়ের মাঝে বা মাকড়সা দেখেও ইনি ভয় পেতে পারেন।
পোস্ট-ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিস্অর্ডার বা পিটিএসডি
অনেক সময় ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার স্মৃতি জনিত আতঙ্কে ব্যক্তির মানসিক শান্তি ও ঘুম নষ্ট হয়ে যায়।
প্যানিক ডিস্অর্ডার
প্যানিক ডিস্অর্ডার আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনিয়ন্ত্রিত প্যানিক অ্যাটাকের ফলে বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গ, যেমন মাথা ঘোরা, শ্বাসকষ্ট এবং অত্যাধিক ঘামতে দেখা যায়। এই সময় তাঁরা নিজেদেরকে অন্তিম লগ্নের সম্মুখীন মনে করেন ফলে, ‘আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি’ বা ‘আমি মারা যাচ্ছি’র মত চিন্তা করতে থাকেন। এই অ্যাটাকের কোনও নির্দিষ্ট কারণ না থাকার ফলে ব্যক্তি সর্বদাই এক আতঙ্কের মধ্যে বাস করেন।
এংজাইটি ডিস্অর্ডারের চিকিৎসা
এংজাইটি ডিস্অর্ডারকে জয় করা এমন কিছু কঠিন না। তাই বলে এই রোগকে হালকা ভাবে নেওয়া উচিত না। সঠিক ওষুধ এবং কাউন্সেলিং এর সাহায্যে এই রোগের চিকিৎসা সম্ভব।
এংজাইটি ডিস্অর্ডারের রোগীর যত্ন নেওয়া
আপনার পরিচিত কারুর যদি এই রোগ হয়ে থাকে, তবে আপনার সাহায্য পেলে উনি এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেন। যে কোনও অসুখের মতই প্রথমে এই রোগ সম্পর্কে আপনি স্পষ্টভাবে জেনে নিলে তাঁর পাশে দাঁড়াতে পারবেন। এই কাজে অসীম ধৈর্যের প্রয়োজন কারণ রোগীকে ক্রমাগত উৎসাহ যুগিয়ে যেতে হবে যাতে তিনি নিজের ভয় বা আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারেন।
এংজাইটি ডিস্অর্ডার -এর সাথে মানিয়ে নেওয়া
ইতিবাচক মানসিকতা, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের সাহায্যে এংজাইটি ডিস্অর্ডার এর সঙ্গে সমঝোতা করা সম্ভব। তবে নিজে থেকে এই সমস্ত কিছু করে ওঠা আপনার পক্ষে কঠিন হতে পারে। তাই আপনার পক্ষে অভিজ্ঞ মনোবিদের পরামর্শ নেওয়াই সুবিধাজনক।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে