করোনা মহামারী মোকাবিলায় প্রধান ভরসা দেশের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা। আর এইসব করোনা যোদ্ধাদের শক্তি, সাহস, সরঞ্জাম যোগাতে যে কয়েকজন মানুষ নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ডা. শামীম রিজওয়ান। মনের খবর এর সাথে কথা হয় পর্দার আড়ালে থেকে করোনা যুদ্ধে মানসিক স্বাস্থ্য সেবায় নেতৃত্ব দিয়ে যাওয়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এই প্রোগ্রাম ম্যানেজার এর সাথে-
করোনা পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কতটা জরুরি বলে আপনি মনে করেন?
আমাদের দেশের যে পরিস্থিতি তাতে শারীরিক স্বাস্থ্যের চেয়েও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি মাথায় রাখা বেশি জরুরী বললে ভুল হবে না। কারণ আমাদের দেশের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের বর্তমানে যে অবস্থা বা যে ধরনের মনোবৈকল্য দেখা দিয়েছে তাতে শারীরিক স্বাস্থ্য বা সার্ভিস ডেলিভারী সিস্টেমটাও ব্যহত হচ্ছে। প্রথমত যদি বলি, রোগটাকে এমনভাবে স্টিগমাটাইজড করা হয়েছে যে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা আতংক বিরাজ করছে যার ফলে সে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে বা নিতে চাচ্ছে অথবা নিতে বাধ্য হচ্ছে। যেমন আপনি যদি কোনো বাড়িতে লিখে দেন এটা করোনা বাড়ি বা করোনা পাড়া এর ফলে মানুষ স্টিগমাটাইজড হয়ে যাচ্ছে এবং যে সব মানুষের মধ্যে প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিয়েছে বা যাদের মধ্যে অল্প লক্ষণ আছে তারা ভয়ে টেস্ট করাচ্ছে না এবং এলাকার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং রোগ ছড়াচ্ছে। আবার যিনি সত্যিই রোগাক্রান্ত হয়েছেন তাকে বাসায় থাকতে বলা হচ্ছে। তাকে আমরা সামাজিকভাবে কতটুকু সহায়তা করতে পারছি? সমাজ তাকে আলাদা করে দিচ্ছে ফলে সে বাড়িতে বসে থেকে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতি মানুষের জন্য একেবারেই নতুন। তাই মানসিক উদ্বেগ বা মানসিক আতঙ্ক মানুষের মধ্যে কাজ করাটাই স্বাভাবিক। মানুষকে এই ধরণের পরিস্থিতি সহ্য করার জন্য তাদের দক্ষতা বা সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য যারা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন তাদেরকে গূরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে হবে। করোনা বিশ্বব্যাপী মহামারীর আকার ধারন করেছে। তাই মানুষের এক্ষেত্রে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা চাই, কেউ যাতে ভয় পেয়ে ভুল কোন সিদ্ধান্ত না নেয়, ভয় থেকে যাতে সতর্ক হয়, ভয় থেকে যাতে কেউ বিমর্ষ না হয়ে পড়ে। অতীতে সে কোন বিপদে পড়ে সেগুলো থেকে যেভাবে বেরিয়ে এসেছে সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ভয় থেকে বের হয়ে আসতে হবে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে শিশু ও প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
করোনার সময় আমাদের বাচ্চাদের স্বাভাবিক রুটিন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সেই বাচ্চাদের মনোসামাজিক ব্যাবস্থা উন্নয়নে আমরা কতটুকু কাজ করছি? সারাদিন টিভি বা সোস্যাল মিডিয়া বা অন্যান্য মিডিয়াতে করোনা সম্পর্কে শুনতে শুনতে মানুষের মধ্যে করোনা নিয়ে একটা ভীতি চলে এসেছে। করোনা থেকে যে মুক্তি পাওয়া যায় বা কিছু নিয়ম মানলেই যে বাঁচা যায় বা কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলেই যে ভালো ও নিরাপদ থাকা যায় এবং অনেকেই যে আরোগ্য লাভ করেছে সে ইতিবাচক খবর গুলো কিন্তু আমরা খুবই কম দেখছি। আমরা সব সময় আতংক,রোগ, ভয় এই ধরনের কথা বার্তা দিয়ে মানুষকে বিশেষ করে শিশু বাচ্চাদেরকে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলছি। আর আমাদের সমাজের একটি বড়ো অংশ রয়েছে যারা প্রতিবন্ধী যার মধ্যে একটি অংশ রয়েছে যারা মানসিক ভাবে প্রতিবন্ধী। এই সময়ে আমরা যে নির্দেশনা গুলো দিচ্ছি সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে কিভাবে হাত ধুতে হবে, মুখ ধুতে হবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কিন্তু আমরা যে নির্দেশনা গুলো দিচ্ছি সেগুলো প্রতিবন্ধী বা মানসিক প্রতিবন্ধীদের (মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯% থেকে ১১%) কথা চিন্তা করে আমরা করতে পারছি কিনা সেটা আমাদের ভাবতে হবে। কাজেই এখানে মানসিক স্বাস্থ্য খুব গুরত্বপূর্ণ । শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য, বড়দের মানসিক স্বাস্থ্য, আক্রান্ত মানুষদের মানসিক স্বাস্থ্য, যারা তাদের সেবা দিচ্ছেন তাদের মানসিক স্বাস্থ্য এই সব বিষয় গুলো আমাদের খুবই গুরুত্ব দিতে হবে।
করোনা আক্রান্তদের মেন্টাল হেলথ সাপোর্ট এর জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কি কি ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে মানসিক স্বাস্থ্য এবং মনোসামাজিক বিবেচ্য বিষয় সমূহ নিয়ে কভিড- ১৯ বিস্তার কালে আমরা গাইড লাইন, মডিউল,টি ভি সি করেছি। এ ছাড়াও www.corona.gov.bd তে মানসিক সাস্থ্য, প্রতিবন্ধীদের মানসিক স্বাস্থ্য এর উপরে বিভিন্ন লিফলেট. ব্রোশিয়ার, গাইড লাইন দেওয়া আছে। আমরা বিষয় গুলোকে চার ভাগে ভাগ করেছি। ১. মানসিক স্বাস্থ্য ও মনোসামাজিক বিবেচ্য বিষয় সমূহ। ২. বড়দের করণীয় সমূহ। ৩. কভিড- ১৯ প্রাদুর্ভাব এর সময় শিশুদের করণীয় সমূহ। ৪. প্রতিবন্ধী ও মানসিক ভাবে অসুস্থ যারা তাদের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় সমূহ। এছাড়াও এগুলোর আলোকে ঘরে থাকুন, সুস্থ্য থাকুন, সচল থাকুন- এগুলোর সিরিজ লিফলেট ও স্লাইড সংযুক্ত করে আমরা বিতরণ করেছি।
করোনায় যারা স্বাস্থ্য সেবা দিচ্ছেন তাদের জন্যে কি কি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে?
করোনায় যারা সেবা দিচ্ছেন তাদের জন্য করোনাকালীন সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য ও মনোসামাজিক বিবেচ্য বিষয় সমূহ কে ৪টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১. সাধারণ জনসাধারণের মানসিক স্বাস্থ্য বা মনোসামাজিক সাপোর্ট আমরা কিভাবে দেওয়া যেতে পারে গাইড লাইনে তা উল্লেখ করা হয়েছে। ২. যারা সেবাকর্মী তাদের বেলায় কি করতে হবে- সেই গাইড লাইনে উল্লেখ করা হয়েছে। ৩. যারা সেবা কর্মীর ব্যবস্থাপনা করেন তারা কি করবেন- তার গাইড লাইনে উল্লেখ করা হয়েছে। ৪. প্রতিবন্ধী ও অন্যান্যদের বেলায় যারা মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিতে আসবেন তাদের বেলায় বিবেচ্য বিষয় সমূহও গাইড লাইনে উল্লেখ করা হয়েছে। গাইড লাইনে স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে যে করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য কর্মীদের মানসিক ভাবে কিভাবে স্থিতিশীল রাখা যাবে এই সময়ে।
করোনা পরবর্তী মানসিক সমস্যা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোন পরিকল্পনা আছে কিনা অথবা এবিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
কোন সংকটময় মূহুর্তে বা বিপদকালে প্রথমেই সেই বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হয়। সংকটকালীন সময়ে আমরা সাইকোলোজিকাল ফাস্ট এইড বা প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা দিয়ে থাকি। সংকটকালীন পরিস্থিতি কেটে গেলে তখন মানুষের বৈকল্য, ভয়, মানসিক চাপ, উত্তেজনা, উদ্বেগ, বা বিভিন্ন ধরণের খারাপ স্মৃতি থেকে মানুষকে মুক্ত করতে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউট ক্লিনিক্যাল সেবা দিয়ে থাকে। আর প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার আমরা দিয়ে থাকি। আমাদের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের মানসিক স্বাস্থ্যের পোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে আমি এবং আমার সাথে দুইজন ডেপুটি পোগ্রাম ম্যানেজার আছেন। সারাদেশব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে আমরা প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করি। করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে করোনা সংক্রান্ত এবং তার পরবর্তী উদ্ভূত যেসব মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিবে, সেগুলোর প্রাথমিক পর্যায়ে বা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পর্যায়ে বা কমিউনিটি পর্যায়ে কী ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া যায় সে বিষয়ে আমরা কাজ করবো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউটের যারা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ আছেন, বিভিন্ন স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা যারা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও ছাত্র-ছাত্রী যারা আছেন তাদের সবাইকে নিয়ে বহুখাতভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে সেটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা এই মুহূর্তে আমাদের হাতে রয়েছে।