‘আত্মহত্যা জীবনে সবচেয়ে বড় কাপুরুষতার পরিচয়’- উক্তিটি করেছিলেন জগদ্বিখ্যাত নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। ভারতবর্ষের মহান সাধক ফকির লালন সাঁইও জীবনকে দেখেছেন আশ্চর্য এক সাধনার মঞ্চ হিসেবে। সেই জীবনের টানেই জীবনানন্দ দাশ কবিতার পঙক্তিতে ঢেলেছিলেন সুরিয়ালিস্টিক ভাবধারা। মনীষীরা মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করে জীবনকেই করেছেন মহিমান্বিত। তবে কেন এ আত্মহনন? কেন এ জীবনবিমুখতা? নিজের জীবনের প্রতি কেন বিতৃষ্ণা?
চিকিৎসাবিজ্ঞান আত্মহত্যার চেষ্টাকে মানসিক অবসাদজনিত গুরুতর উপসর্গ হিসেবে দেখেন। বিশ্বের অনেক দেশ আত্মঘাতকদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ বলছে, প্রতিবছর বিশ্বে যেসব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে এর মধ্যে আত্মহত্যা ১৩তম প্রধান কারণ।
যারা আত্মহত্যা করেন তারা সামাজিক ও মানসিকভাবে অতিরিক্ত বিষণ্ণতায় ভুগেন। আত্মহননকারী ব্যক্তি নিজেকে পৃথিবীতে অর্থহীন মনে করেন। এটা নানা কারণে হতে পারে।
আত্মহত্যার কারণ:
জেনেটিক: আত্মহত্যার প্রবণতার অন্যতম কারণ জেনেটিক (বংশানুক্রমিক) কারণ। মোট আত্মহত্যার প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রেই জিন দায়ী। ফলে কোনো পরিবারে একজন আত্মহত্যা করলে এর প্রভাব অন্য সদস্যদের ওপরও পড়ে।
হঠকারিতা বা ইমপালসিভিটি: আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হঠকারিতাও। মানসিক রোগ না থাকার পরও হঠাৎ করেই অনেকে আত্মহত্যা করে বসেন। ধর্ষিত হওয়ার পরপরই আত্মহত্যা, দাম্পত্য কলহে আত্মহত্যা, পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আত্মহত্যা, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আত্মহত্যা, প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদে আত্মহত্যা ইত্যাদি যার মধ্যে অন্যতম।
মানসিক রোগ: আত্মহত্যার জন্য অন্যতম কারণ মানসিক রোগ। বিষণ্ণতা, ম্যানিক-ডিপ্রেসিভ, সিজোফ্রেনিয়া, পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার ও লাভ অবসেশন এর মধ্যে অন্যতম।
প্রত্যাশার মানসিক চাপ: কারও কারও প্রত্যাশা অনেক বেশি। পাশাপাশি পরশ্রীকাতরতাও আছে। কেউ যদি নিজে ব্যর্থ হন এবং পাশাপাশি কাছের কেউ সফল হন তবে সেই গ্লানিবোধ থেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। অনেকসময় আমরা নিজেরাই নিজেদের ওপর প্রত্যাশার চাপ বাড়িয়ে দিই।
পারিবারিক কলহ: দাম্পত্য কলহের কারণে অনেকসময় স্বামী বা স্ত্রী আত্মহত্যা করে বসেন। অনেক সময় সন্তানরা বাবা-মায়ের নিত্যকলহের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে এ পথে পা বাড়ান।
দারিদ্র্য: বিশেষত, আমাদের উপমহাদেশে আত্মহত্যার অন্যতম কারণ দারিদ্র্য। অনেকে বেশিরভাগ সময় ঋণগ্রস্ত থাকেন। সেটা তার মাথার ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে। ব্যক্তি তখন চাইলেই ফুরফুরে মুডে থাকতে পারে না। ঋণ পরিশোধ না করতে পেরে তখন বেছে নেন আত্মহত্যার পথ।
অপরিকল্পিত নারীর ক্ষমতায়ন: নারীর ক্ষমতায়নে সরকার এবং বেসরকারি এনজিও ও উদ্যোক্তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নারীদের আজ ঘরের বাইরে নানা ক্ষেত্রে সরব উপস্থিতি। শিল্প কলকারখানা থেকে শুরু করে শিক্ষা-দীক্ষা এমনকি সামরিক বাহিনীতেও নারীদের জয়জয়কার। কিন্তু নারী ক্ষমতায়নের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ ঘরের বাইরে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পথে ইভটিজিং বা শ্লীলতাহানি বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেককেই আত্মাহুতি দিতে বাধ্য হন।
রাত জাগার বদভ্যাস: মানসিক রোগে ভুগে আত্মহত্যা করেছেন, তাদের বেশিরভাগেরই অন্যতম উপসর্গ রাতে ঠিকমতো ঘুম না হওয়া।
মাদকাসক্তি: মদ্যপায়ীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। হিরোইনসেবীদের আত্মহত্যার হার সাধারণ মানুষের তুলনায় প্রায় ১৪ গুণ বেশি। ইয়াবা সেবনেও আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ে।
জুয়া খেলা: জুয়াড়িদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। অনেক জুয়াড়ি সবকিছু বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হন। এর পরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন মূলত ঋণের কারণে। এদের ঘরের স্ত্রীদের আত্মহত্যার হার সাধারণ মানুষের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি।
দীর্ঘমেয়াদি পীড়াদায়ক রোগ: দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা, ক্যানসার, কিডনি নষ্ট হওয়া, অনিদ্রা (ইনসোমনিয়া), হাঁপানি ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি, কষ্টদায়ক ও ব্যয়বহুল রোগের রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। কোনো ব্যক্তির ক্যানসার ডায়াগনোসিস হলে তার আত্মহত্যার সম্ভাবনা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়।
লাভ অবসেশন: অনেক প্রেম ‘লাভ অবসেশন’ নামে মানসিক রোগের জন্ম দেয়। ফলে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ভালোবাসার মানুষের সামান্যতম অবহেলাও সহ্য করতে পারেন না। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তিনি মানসিক রোগাক্রান্ত হয়ে যাওয়ায় ভালোবাসার মানুষটিকে ফিরে পেতে কিংবা তার বিরহে আত্মহত্যার পথ ধরেন।
আত্মহত্যার লক্ষণঃ
নিজেকে অন্যের জন্য বোঝা মনে করা বা সীমাহীন কষ্টের কথা প্রকাশ করতে না পারাও আত্মহত্যার অন্যতম লক্ষণ। এছাড়া হঠাৎ করেই নিজের সব জিনিস অন্যদের দিয়ে দেওয়া, মৃত্যু বিষয়ে নানা চিন্তা-ভাবনার কথা প্রকাশ করা, আত্মহত্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা, মনের বিক্ষিপ্ততা দৃশ্যমান হওয়া যেমন- একটুতেই উত্তেজিত হওয়া, প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলা, অকারণে কেঁদে ফেলা, নিজেকে গুটিয়ে রাখা, অস্বাভাবিক শান্ত হয়ে যাওয়া- এসব লক্ষণেও বুঝতে হবে ওই ব্যক্তি হয়তো আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেছেন।
এমন লক্ষণ দেখতে পাওয়া মানুষের পাশে সমাজ ও পরিবারকে সবসময় থাকতে হবে বলে জানাচ্ছে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট। সরকারি এ প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিয়ে অনেক মানসিক রোগী এখন সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরেছেন। আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। জীবনকে ভালোবাসতে হবে।
সূত্রঃ ইন্টারনেট
করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে