দেশের সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনায় আমরা খুবই উদ্বিগ্ন বোধ করছি। প্রকাশ্য দিবালোকে একজন আরেকজনকে কুপিয়ে মারার ক্ষত শুকাতে না শুকাতে “ছেলেধরা” সন্দেহে নিরীহ মানুষদের মেরে ফেলছি বা মারাত্মকভাবে আহত করছি। এতে শিশুর পিতা, মাতা এবং মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। কেন হঠাৎ আমরা এতো আক্রমণাত্মক বা আগ্রাসী আচরণ করছি। এটা কী আমাদের স্বভাবজাত না অন্য কোন ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। মনোবিজ্ঞানের আলোকে চলুন ব্যাখ্যা করা যাক।
আক্রমণাত্মক আচরণ তখনই বলা হয় যখন কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অন্য কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা বস্তুকে ক্ষতি করতে নির্দেশ দেয় বা নিজে অংশগ্রহণ করে।
এই আগ্রাসী আচরণ জন্মগত না চারপাশের বিরূপ পরিবেশের শিক্ষা থেকে পাওয়া তা নিয়ে মনোবিজ্ঞানীদের মাঝে মতানৈক্য র্দীঘদিন ধরে চলে আসছে। পুরনো থিউরি বা তত্ত্ব অনুযায়ী আগ্রাসী আচরণ জন্মগত, আর আধুনিক তত্ত্ব অনুযায়ী এই আচরণ চারপাশের বিরূপ পরিবেশের শিক্ষা।
সপ্তদশ শতকে রাজনৈতিক দার্শনিক থমাস হবস বলেন, “মানুষ মূলত প্রতিযোগিতামূলক ও শত্রু ভাবাপন্ন। তারা শুধুমাত্র অন্যের উপর নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে ও অন্যের থেকে সুবিধা নিতেই আগ্রহী। তাদের এই দ্বান্দ্বিক ও পারস্পারিক ধ্বংসের মনোভাব নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাষ্ট্রীয় বা সরকার ব্যবস্থা প্রয়োজন।“
সিগমুন্ড ফ্রয়েডের থিউরীতেও একই রকম নেতিবাচক মনোভাবই ফুটে উঠে। ফ্রয়েড প্রথম দিকে মানব মনের চালক হিসেবে একটা জিনিসের কথা বেশি বলেছেন , তা হলো eros (ইরোস), অর্থাৎ মানুষ মূলত তার আনন্দ লাভের জন্য সব কিছু করে। পরবর্তিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার পর তিনি মানব মনের দ্বিতিয় চালনা শক্তির কথা বলেন। সেটা হলো thanatos (থ্যানাটস), যা মানুষকে নিজের ধংসের এবং মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। ফ্রয়েড অনুভব করেন, মানুষ যখন তার নির্জীব, জর বস্তুর ন্যায় জীবনে আনন্দ খুঁজে পায় না তখন তার ভিতর থ্যানাটস কাজ করে এবং নিজেকে ধংসের মধ্য দিয়ে আনন্দলাভের চেষ্টা করে। ফলশ্রুতিতে অন্যের প্রতি আক্রমণাত্মক বা আগ্রাসী আচরণ করে। যদি এই থ্যানাটস প্রকাশ করার সামাজিকভাবে স্বীকৃত কোন উপায় না থাকে, তাহলে তা নির্দিষ্ট সময়ে তার চাহিদা অনুযায়ী প্রকাশ পায়। এভাবে ফ্রয়েড ব্যাখ্যা করেন যে, মানুষের ভিতরকার আক্রমণাত্মক আচরণ ও ধ্বংসাত্মক ইচ্ছা যথাযথভাবে প্রকাশ পেতে হয়, যেমনটা তাদের ক্ষুদা, তৃষ্ণা এবং যৌনতার চাহিদা মিটাতে হয়।
১৯৩৯ সালে , ফ্রয়েডের মৃত্যুর এক বছর পর মনোবিজ্ঞানী জন ডলার্ড এবং তার সহযোগীরা Frustration and Aggression (হতাশা ও আগ্রাসী আচরণ) থিউরি দেন। তাদের মতে, হতাশা বা নৈরাশা সবসময় আগ্রাসী আচরণের দিকে ধাবিত করে এবং আগ্রাসী আচরণ সবসময় হতাশা বা নৈরাশার ফল। যদিও আক্রমণাত্মক বা আগ্রাসী আচরণ জন্মগত, কিন্তু তা একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রকাশ পায়। মানুষ যখন তার গুরুত্বর্পূণ চাহিদা যেমন, খাদ্য, পানি, সামাজিক মর্যাদা অথবা অর্জন পেতে ব্যর্থ হয় তখন মানুষের মনে চরম হতাশা কাজ করে, আর এই হতাশার কারণেই সে আক্রমণাত্বক আচরণ করে।
এই থিউরি নিয়ে অনেক পরীক্ষা নীরিক্ষা হয়। এতে দেখা যায়, যে ব্যক্তি বা বস্তুর কারণে হতাশা তৈরি হয় আগ্রাসী বা ধ্বংসাত্মক আচরণ সবসময় সে দিকে ধাবিত হয় না। মানুষ তার ধ্বংসাত্মক আচরণ সাময়িকভাবে নিরাপদ ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য কোন উপায়ে তা প্রকাশ করে। এটাকে স্কেপগোট (Scapegoat) বা বলির পাঁঠাও বলা হয়, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভিন্ন সম্প্রদায়ের এবং অসহায় মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয়।
আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা এই আগ্রাসী বা ধ্বংসাত্মক আচরণকে জন্মগত মানতে নারাজ। তাদের মতে এটা মানুষ সমাজ থেকে শিখে। Social Learning বা সামাজিক শিক্ষা তত্ত্ব অনুযায়ী আক্রমণাত্মক বা আগ্রাসী আচরণ মানুষ উৎসাহদান ও অনুকরণের মাধ্যমে শিখে। শিশুরা যখন পরিবারে, সমাজে বা রাষ্ট্রে আক্রমণাত্মক বা আগ্রাসী আচরণ ঘটতে দেখে, নিজেরা তা শিখে, এবং অন্যের উৎসাহে তা আরো বৃদ্ধি করে থাকে। বর্তমান সময়ে টেলিভিশন, মোবাইল, ইন্টারনেট ও ধ্বংসাত্মক গেমের মাধ্যমে আমাদের শিশু ও তরুণরা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের আগ্রাসী আচরণ ও বিচারবহির্ভুত হত্যার ফলে আমরা সকলেই আক্রমণাত্মক আচরণ শিখছি। এবং মনের এই ধ্বংসাত্মক বোধের চাহিদা অনুযায়ী তা যেকোন দুর্বল মুহুর্তে প্রকাশ করছি।
আক্রমণাত্মক বা আগ্রাসী আচরণ পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই ছিলো। অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে এই আক্রমণাত্মক আচরণ তাদের আত্মরক্ষার প্রধান হাতিয়ার। কিন্তু মানুষ তাদের মেধার ক্রমবিকাশের মাধ্যমে সভ্য প্রাণীতে পরিণত করেছে। তারপরও মৌলিক প্রবৃত্তি অনুযায়ী আমাদের ভিতরে এটা সব সময়ই রয়েছে। আমরা যদি আমাদের এই প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, তাহলে পারিবারিক ও সামাজিক সুশিক্ষা ও আদর্শ নীতির যেমন প্রয়োজন, পাশাপাশি রাষ্ট্রকেও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা ও নাগরিকের যৌক্তিক চাহিদা পূরণ করা প্রয়োজন। এছাড়া আমরা সঠিক ও মানবিক কাজকে উৎসাহদানের ও অনুকরণের মাধ্যমে এবং অন্যায় ও আগ্রাসী আচরণকে নিরুৎসাহিত করার মাধ্যমে আমাদের শিশুদেরকে সভ্য ও মানবিক করে গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই কেবল একটি সুন্দর, মানবিক বাসযোগ্য পৃথিবী আমরা পেতে পারি।