অর্থনৈতিক অসমতা ও শিশুর বিকাশ পারিপার্শ্বিকতা সুস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে

0
53

১০ অক্টোবর, ২০২১ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়: ‘বৈষম্যপূর্ণ বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’ ‘Mental Health is an Unequal World.’ দারিদ্র্য এবং অসমতা হলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক শক্তির প্রকাশ যা সমাজকে গঠন করে। যা শিশুদের জীবন-সংস্থান এবং সুযোগের বণ্টন, জাতিসত্তা বা বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ, শহুরে/গ্রামীণ অবস্থান, যুদ্ধ, মহামারি, বয়স, প্রজন্ম ইত্যাদির সাথে জড়িত। শিশুর বিকাশে শারীরিক, মানসিক এবং আবেগীয় পরিবর্তন জড়িত থাকে যা মানুষের মধ্যে জন্ম থেকে কৈশোরের শেষ সময়ের মধ্যে ঘটে। শৈশব ৩টি ধাপে বিভক্ত। যেমন: শৈশব, মধ্য শৈশব এবং কৈশোর।

অ্যাশলি লোগান (এমএড) এবং রবার্ট পার্না (পিএইচডি) বলেন, মানুষের মস্তিষ্কের অধিকাংশ বৃদ্ধি ঘটে জীবনের প্রথম ৬ বছরে। শৈশবকাল পর্যন্ত প্রসারিত, এমন অনেকগুলি কারণ রয়েছে যা মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য প্রাসঙ্গিক। উচ্চ মাত্রার পুষ্টি, যথাযথ উদ্দীপনা, মনোযোগ এবং মানসিক সমর্থন সবই সুস্থ মস্তিষ্কের বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে সাহায্য করে। শিশুর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং ভবিষ্যতে শেখার ক্ষমতার জন্য মনকে প্রস্তুত করে। একটি শিশুর পরিবেশের অনেকগুলো দিক মস্তিষ্কের সর্বাধিক কার্যকারিতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। দুটি উল্লেখযোগ্য-

নেতিবাচক পরিবেশগত কারণ

দারিদ্র্য এবং অবহেলা

গবেষণায় দেখা যায়, শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ, নতুন কিছু শেখা এবং একাডেমিক কর্মক্ষমতাতে দারিদ্র্যের নেতিবাচক প্রভাব বিদ্যমান। দুই বছরের কম বয়সী কম আয়ের শিশুরা বুদ্ধিবৃত্তিতে পিছিয়ে থাকে (ডানকান অ্যান্ড ব্রুকস-গান ১৯৯৭; ফাইনস্টাইন ২০০৩)। স্মিথ এবং সহকর্মীরা (১৯৯৭), দুটি জাতীয় ডেটাসেটের তথ্য ব্যবহার করে দেখিয়েছেন যে, প্রি-স্কুল বয়সী শিশুদের (তিন থেকে চার বছর) জ্ঞানীয় এবং একাডেমিক প্রস্তুতিতে পারিবারিক দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্যভাবে কম স্কোরের সাথে সম্পর্কযুক্ত।

শিশুরা স্কুলে প্রবেশ করে এবং অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে দরিদ্র পরিবারে বসবাসকারী শিশুরা স্কুল পারফর্মেন্স আরও খারাপ করতে থাকে। বিশেষ করে, দরিদ্র শিশুদের একই ক্লাসে পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ ছিল, স্কুল থেকে বহিষ্কৃত বা স্থগিত করা হয়েছিল, অথবা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। দরিদ্র শিশুরা তাদের অ-দরিদ্র সহকর্মীদের তুলনায় প্রাথমিক বা উচ্চ বিদ্যালয়ে শেখার অক্ষমতা হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা ১:৪ গুণ ছিল।

পিতা-মাতার শিক্ষাগত যোগ্যতা, মায়ের নিজের আইকিউ, বুদ্ধিমত্তা, শিক্ষা, পেশা, পারিবার কাঠামো তথা আর্থ-সামাজিক অবস্থা শিশুর জ্ঞানীয় ক্ষমতার পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যেসব শিশুর মায়েরা চাকরি/ব্যবসায় ভালো করেন, তারা সন্তানকে স্টিমুলেশন হিসেবে খেলনা, ছবির বই, বেড়াতে যাওয়া, পুষ্টিকর খাবার ইত্যাদি দিতে সক্ষম হন। এতে শিশুরা উন্নত মৌখিক দক্ষতা অর্জনের সম্ভাবনা রাখে। আবার যেসব কর্মজীবী মা উচ্চতর আর্থ-সামাজিক মর্যাদার অধিকারী তারা অনেক সময় বেশি অসুবিধার সম্মুখীন হন কারণ তাদের সন্তান পরিচর্যার চেয়ে অন্যান্য কাজে সময় দিতে হয় বেশি। শিশুটি হয়ত তখন বাসায় কাজের লোকের কাছে একা থাকে কিংবা সারাদিন ডে-কেয়ার সেন্টারে থাকে। পিছিয়ে পড়ে শিশুর ভাষার বিকাশ, আবেগীয় এবং সামাজিক বিকাশ। স্পষ্টতই, শিশু যত্নের মান বিবেচনা করা একটি বিষয়। স্বল্প আয়ের শিশুদের দাদা-দাদি বা বর্ধিত পরিবারের দ্বারা দেখাশোনা করা হয় এবং তাই পরিবারের সাথে দৃঢ় বন্ধন গড়ে উঠে। গবেষণায় দেখা যায় শিশু জন্মের প্রথম বছরের মধ্যে মায়ের পূর্ণকালীন কাজ এবং শিশু বিকাশের মধ্যে একটি নেতিবাচক সম্পর্ক পাওয়া যায়। যে শিশুর মায়েরা বাইরে কাজ করে হোক তা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি কিংবা, সারাদিন রোদে পুড়ে ইট ভাঙার কাজ তাদের সময়মতো শিশুর পরিচর্যা এবং নিয়মিত শিশুকে স্তন্য পান করানোর সম্ভাবনা কম থাকে, যা শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের জন্য একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ। যখন বাবামায়েরা শিশুর জীবনের প্রথম বছরের মধ্যে পূর্ণকালীন কাজ শুরু করেন তখন প্রভাবগুলো আরও জোরালোভাবে অনুভূত হয়।

নিম্ম-আয়ের পরিবারগুলোতে বাসস্থান সীমাবদ্ধতা, আর্থিক চাপ, নির্যাতন, সহিংসতা ইত্যাদির কারণে তাদের বাচ্চাদের একটি উত্তম বাড়ির পরিবেশ দেয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। ৫/৬ বছর বয়সে শিশুটিকেও অর্থ উপার্জনে যেতে হয়। আমরা প্রায়ই দেখি বাড়িতে সাহায্যকারী হিসেবে, হোটেলে টেবিল মোছার কাজে, টেম্পুর হেল্পারিতে, বাস/রেল স্টেশনে কুলির কাজে, বাজারে টুকরি মাথায় শিশুরা কাজ করে। যে সময়টা তার হেসে খেলে মায়ের কোলে, বাবার কাঁধে কাটানোর কথা। রঙিন ব্যাগ, টিফিন বক্স নিয়ে স্কুলের বেঞ্চে বন্ধুদের সাথে দুষ্টমি করার কথা। যদিও শিশু অধিকার আইনে আছে ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশু ভারী কাজ করবে না। কিন্তু বেঁচে থাকার তাগিদেই বিভিন্ন পেশা বেছে নিতে হয়। সাধারণত অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং পিতামাতার সম্পৃক্ততার অভাব, দুর্বল পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক, আচরণগত, শিক্ষাগত, জ্ঞানীয় শিক্ষা না থাকায় এই শিশুদের একাডেমিক অর্জন ব্যাহত হয়। নৈতিক শিক্ষার অভাবে চুরি, ছিনতাই, ইন্টারনেটের অপব্যবহার, পর্ন আসক্তি, নেশা থেকে শুরু করে অন্ধকার জগতে জড়িয়ে পড়ে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, সুবিধাবঞ্চিত পরিবার এবং শিশুরা প্রতিকূলতার জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা এবং অন্যান্য ফলাফলের ক্ষেত্রে দ্রুত পিছিয়ে পড়ে। নৈতিক শিক্ষার অভাব, কুসংস্কার ইত্যাদির প্রভাবে অন্যায়ের সাথে শিশু জড়িয়ে পড়ে। উচ্চ আয়ের পরিবার শ্রেণিকক্ষের ভেতরে এবং বাইরে শেখার সুযোগে সক্ষম। দারিদ্র্য-পীড়িত শিশুদের বিনোদনের সুযোগ কম হয়। লাইব্রেরি বা যাদুঘরে বেড়ানোতে সীমাবদ্ধ থাকে। অনেক সময় একাডেমিক রেজাল্ট ভালো করতে একজন শিক্ষক দিতেও অক্ষম হয়। নিম্ম আয় কিংবা দারিদ্র্য, শিশু বিকাশকে প্রভাবিত করার জন্য আরও অনেক সমস্যার কারণ হতে পারে। যেমন: দুর্বল একাডেমিক ফলাফল, দুর্বল পারিবারিক বন্ধন, রক্ত স্বল্পতা, রোগ সংক্রমণ, উদ্দীপনার অভাব, অপুষ্টি এবং সীসা বিষক্রিয়া ইত্যাদি।

একটি ইতিবাচক বাড়ির পরিবেশ হল সুস্থ মস্তিষ্কের বিকাশের ভিত্তি। শিশুদের পারিপার্শ্বিকতা তাদের সুস্বাস্থ্যের ওপর বিশাল প্রভাব ফেলে। একটি শিশুর বেড়ে ওঠা, শেখা এবং জ্ঞান অন্বেষণের জন্য একটি সুস্থ, নিরাপদ বাড়ি অপরিহার্য। একটি সমস্যাযুক্ত বাড়ির পরিবেশ, শিশুর মেধা, সামাজিক এবং মানসিক বিকাশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে জীবনের প্রম বছরগুলোতে ঘরের নেতিবাচক পরিবেশ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, যার মধ্যে রয়েছে:

দুর্বল ভাষা দক্ষতা

আচরণগত সমস্যা

স্কুলের প্রস্তুতির ঘাটতি

ব্রেইন ইমেজিং গবেষণায় বলা হয়েছে যে একটি অনগ্রসর বা চাপপূর্ণ পরিবেশে বেড়ে ওঠার ফলে মস্তিষ্ক ভিন্নভাবে বিকশিত হতে পারে। দরিদ্র এবং নিম্ম আয়ের মায়েরা মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যা ইতিবাচক অভিভাবকত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। উন্নত শিক্ষিত পিতামাতারা আরও ইতিবাচক বাড়ির পরিবেশ তৈরি করেন। মাতৃশিক্ষা, অভিভাবকত্বের জ্ঞান এবং বিশ্বাস বাড়ির পরিবেশের গুণমানকে প্রভাবিত করে।

তারপরও আমরা প্রায়ই দেখি দরিদ্র ঘরের সন্তানের উচ্চশিক্ষা লাভ কিংবা উচ্চ পদস্থ চাকুরিরত অবস্থান এবং উল্টো দিকে ধনীর দুলালের নামে হত্যা, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের নোটিশ। প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে উঠেও আপনার সন্তান হতে পারে দেশ ও দশের একজন যদি বাবা-মা হিসেবে তাকে প্রকৃত নৈতিক শিক্ষা, কঠোর পরিশ্রম করার তাগিদ সর্বোপরি মানবিক গুণাবলী শিক্ষা দেয়া যায়। আপনি যে সন্তানকে ভালোবাসেন এটা তাকে বুঝতে দিন। আপনার ভালোবাসা এবং মধুময় শৈশবকালীন স্মৃতিগুলো হতে পারে তার জীবনের মূল চালিকাশক্তি, বেঁচে থাকার প্রেরণা যা কোনো দামি খেলনাও এনে দিতে পারবে না। মনে পরে যায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ‘দারিদ্র্য’র পঙ্ক্তিমালা,

হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান।

তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান

কণ্টক-মুকুট শোভা। দিয়াছ, তাপস,

অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;

উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার,

বীণা মোর শাপে তব হ’ল তরবার!

 

ফারজানা ফাতেমা (রুমী)

মনোবিদ, শৈশবকালীন প্রতিকূলতা ও নিউরো ইমেজিং স্টাডি বাংলাদেশ,

আইসিডিডিআরবি।

সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৯ম সংখ্যায় প্রকাশিত।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪
Previous articleবিএপি’র উদ্যোগে সদ্য পাশ করা মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের অভ্যর্থনা ও সায়েন্টিফিক সেমিনার
Next articleশীতকালীন মানসিক সুরক্ষার উপায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here