প্রবীণ নীতিমালা মতে, ৬০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের ব্যক্তিকে প্রবীণ হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে দেঁড় কোটি প্রবীণ জনগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের বয়স ৬০ বা তার বেশি যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮%।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপির হিসেবে ২০২৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশে প্রবীণদের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি হয়ে যাবে। আর ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রবীণদের জনসংখ্যা অপ্রাপ্তবয়স্ক ও তরুণদের ছাড়িয়ে যাবে।
প্রবীণদের অনেকে বুঝতে চান না। তাঁদের কল্যাণে কাজ করতেও চান না। হতাশা, বিষণœতা ও নিঃসঙ্গতায় চলে প্রবীণদের জীবন। দ্রুত আর্থ-সামাজিক ও জনতাত্ত্বিক পরিবর্তন, ব্যাপক দারিদ্র্য, ক্ষয়িষ্ণু সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব এবং অন্যান্য কারণে ঐতিহ্যবাহী যৌথ পারিবারিক ও সামাজিক দেখাশোনার পদ্ধতি ভেঙে পড়েছে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রবীণ মানুষই কতগুলো মৌলিক মানবিক সমস্যার শিকার হচ্ছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে অপর্যাপ্ত আর্থিক সংস্থান, বার্ধক্যজনিত রোগ এবং যথোপযুক্ত সেবা ও চিকিৎসা সুবিধার অভাব, একাকিত্ব ও অবহেলা, বঞ্চনা এবং আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী সিনিয়র সিটিজেনদের ১৫% মানসিক রোগে ভোগেন এবং বৃদ্ধির হার ৪.৪১%। গড়পড়তা বাংলাদেশি পরিবারে প্রায়শই বয়স্ক লোকদের বোঝা হিসেবে গণ্য করা হয়। দুর্বল স্বাস্থ্য আর উপার্জনহীন একজন প্রবীণ সবার কাছে অবহেলিত, উপেক্ষা ও দুর্ব্যবহারের শিকার।
তাঁদের ভরণ-পোষণ, সেবা-যত্ন, চিকিৎসা ও আবাসন সমস্যা দেখা দেয়। অগণিত প্রবীণ হতাশার মধ্যে এবং রোগ-শোকে ভুগে কোনো সেবা ও সাহচর্য ছাড়াই দিন কাটান।
প্রতিবন্ধিতা ও পক্ষাঘাত প্রবীণদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্ট্রোক বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর তৃতীয় কারণ; এর ফলে প্রতিবন্ধিতায় পড়ছেন লাখো প্রবীণ। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে চর্বির উপস্থিতি, অপুষ্টি, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা অনেক বড়ো রোগের কারণ।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি ও হজমশক্তি লোপ পায়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে না। রক্তচাপ ও হার্টের সমস্যা দেখা দেয়।
বিভিন্ন কারণে পরিবারের লোকেরা প্রবীণদেরকে নানা রকম নিয়মকানুন মানতে বাধ্য করেন। তাঁদের চাওয়া-পাওয়ার দিকে নজর বেশি না দিয়ে পরিবারের লোকদের সুবিধা অনুযায়ী তাঁদের ওপর এসব নিয়ম চাপিয়ে দেন।
কড়া নিয়ম-কানুনের ভেতর চলে তাঁদের জীবন। এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না, এখানে যাওয়া যাবে না, ওখানে যাওয়া যাবে না, এই সময়ে ঘুমাতে যেতে হবে, ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে হবে, ঘড়ির সময় ধরে ওষুধ খেতে হবেÑএমন হাজার নিয়ম মেনে চলতে হয়।
এছাড়াও রয়েছে পছন্দের খাবার বা বাইরের খাবারে মানা, ঘরে ভালো কিছু রান্না হলেও সেগুলো খেলে রোগ বেড়ে যাবে এই অযুহাতে তাঁদেরকে খেতে না দেয়া, অনেক সময় তাঁদের নাতি-নাতনিদের নিয়ে বাইরে বা ঘরে সময় কাটাতে চাইলেও অনেক মা-বাবাই তা করতে না দেয়া।
জন্মদিন বা বিয়ে বাড়ি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁরা যেতে চাইলেও তাঁদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় না। অনেকেই ঠিকমতো মুখে খাবার তুলে খেতে পারেন না। বিভিন্ন রোগের কারণে তাঁদের হাত-পা কাঁপে। খাবার পড়ে যায়। ফলে বিভিন্ন কটু কথা শুনতে হয় তাঁদের। এর ফলে তাঁরা নিজেদেরকে অন্য মানুষের জন্য বোঝা বলে মনে করেন।
শারীরিক, আর্থিক ও মানসিকভাবে সন্তান বা অন্যদের ওপর নির্ভরতা প্রবীণদের স্বনির্ভরতা ও সম্মানের পথে একটি বড়ো বাধা। তাঁদের কোনো নিয়মিত আয়ের উৎস নেই এবং এর ফলে তাঁরা খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয় এবং স্বাস্থ্য সেবার জন্য ব্যাপকভাবে অন্যের ওপর নির্ভরশীল।
প্রবীণরা প্রায়শই নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন, একাকী এবং অবহেলিত বলে মনে করেন। কারণ সাধারণত তাঁদের পুত্র-কন্যাগণ তাঁদের সঙ্গে থাকে না এবং নিজ নিজ কাজে নিজস্ব পরিণ্ডলে ব্যস্ত থাকে। তাঁরা হয়ত কোনো পরিচারিকার দেখাশোনার দায়িত্বে থাকেন এবং কঠোর নিয়মের ভেতর থাকেন। এটা তাঁরা মেনে নিতে পারেন না এবং অনেক সময় মরে যেতে চান। জীবনের বিরাট অংশের দায়দায়িত্ব শেষে একাকিত্ব, অর্থসংকট, শারীরিক জীর্ণতার বোঝা চেপে বসে।
অতি নিয়ন্ত্রণের কারণে হতাশা, খিটখিটে মেজাজ, বিরক্তি প্রকাশ, ঘুমের সমস্যা, রাগ বেড়ে যাওয়া, ভাঙচুর করা, নিজের প্রয়োজনের কথা ঠিকমতো বলতে না পারা, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, অতিরিক্ত টেনশন করা, বারবার একই কথা বলে কাছের মানুষদের বিরক্ত করা।
অনেক সময় বিভিন্ন মানসিক রোগের কারণে অসংলগ্ন কথা বলা, একা একা বিড়বিড় করা ইত্যাদি নানারকম সমস্যা তাঁদের দেখা দেয়। ফলে তাঁদের প্রতিদিনের কাজের ব্যাঘাত ঘটে। বিভিন্ন কারণে প্রবীণরা হন অবহেলার শিকার।
আজকাল যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার অধিক জনপ্রিয় হওয়ার একটি কারণ। আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে প্রবীণরা উপার্জন করতে পারেন না। মানসিক রোগ শারীরিক রোগের মতো এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি সমাজের মানুষদের কাছে। ফলে এসব রোগের লক্ষণগুলো অতটা পরিচিত নয় সব মানুষের কাছে।
একা থাকা, চুপচাপ থাকা, রাগ করা, মেজাজ দেখানো, লোকজন পছন্দ না করা এগুলোকে অনেক মানুষই কোনো রোগের লক্ষণ বলে মনে করেন না। অনেক সময় বিভিন্ন শারীরিক রোগের বহিঃপ্রকাশ মানসিক রোগের লক্ষণ হিসেবে দেখা যায়।
আবার মানসিক রোগের লক্ষণ শারীরিক উপসর্গ হিসাবে প্রকাশ পায়। এগুলোর প্রতি সবার নজের দেয়া উচিত। সঠিক সময়ে চিকিৎসা হলে ফলাফল ভালো পাওয়া যায়। বৃদ্ধ বয়সে জীবনযাত্রার মানের উন্নতি হয়। বার্ধক্য হলো জীবনচক্রের শেষ ধাপ। জীবনের নাজুক ও স্পর্শকাতর অবস্থা। বেঁচে থাকলে প্রত্যেক মানুষকে বার্ধক্যের সম্মুখীন হতেই হবে।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী জন্মের পর বাংলাদেশের গড় আয়ু হচ্ছে ৭০.০৬ বছর। এর মধ্যে পুরুষদের আয়ু ৭০.০৬ বছর, নারীর ৭১.৯৮ বছর। আর ৬০ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ বসবাস করছে।
এদের কেউ কেউ ১০০ বছরের মতো বয়সের দীর্ঘ জীবনযাপন করছেন। এর মধ্যে নারী প্রবীণরা দীর্ঘজীবী হলেও তাঁদের বেশির ভাগই মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হন অতি নিয়ন্ত্রণের কারণে।
এ দুঃসহ জীবনযাপন শুধু অসহায়ত্ব ও দুর্ভাগ্যজনক ছাড়া আর কিছু নয়। তাঁরা পরিবারে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন, এটা সবার বোঝা উচিত। তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। প্রবীণদের শারীরিক বা মানসিক পরিবর্তনগুলো দেখা দিলে দেরি না করে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া উচিত।
ডা. ফাতেমা জোহরা
সহকারী অধ্যাপক, মানসিক রোগ বিভাগ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিক্যাল কলেজ।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে