শীতকাল হলো পিঠাপুলি আয়োজন আর উৎসবে মাতোয়ারা হবার সময়। কিন্তু আমরা কি জানি শীতে ঝড়া পাতার মতো যেমন আমাদের ত্বক খসখসে হয়ে যায় তেমনি আমাদের শীতকালীন বিষণ্নতাও হতে পারে। হয়ত আমরা অনেকেই জানি না, কিন্তু বিষণ্নতা হয়। তবে মনে রাখতে হবে যে, কোনো বিষয়ে মন খারাপ হলেই তা বিষণ্নতা নয়।
চলুন তাহলে জেনে নেই এই ঋতুভিত্তিক বিষণ্নতা আসলে কী?
সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার (SAD) হল এক ধরনের বিষণ্নতা যা ঋতু পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত। এতে আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষের উপসর্গগুলো শরতকালে শুরু হয় এবং শীতের মাসগুলোতে চলতে থাকে। কোনো কাজে আনন্দ না পাওয়া, ঘরে বাইরে কোনো কিছু উপভোগ করতে না পারা, খেতে, ঘুমাতে ভালো না লাগা, শরীরের শক্তি হ্রাস, বদমেজাজি হয়ে উঠা, সামাজিক দূরত্ব, স্কুল বা কাজের সমস্যা, নেশা, অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধি যেমন উদ্বেগ বা খাওয়ার ব্যাধি, আত্মঘাতী চিন্তা বা আচরণ ইত্যাদি লক্ষণগুলো হতে পারে। আবার এই উপসর্গগুলো প্রায়ই বসন্ত এবং গ্রীষ্মের মাসগুলোতে দূর হয়ে যায়। এই বাৎসরিক অনুভূতিকে “Winter Blues” বলা হয়।
এর নির্দিষ্ট কারণ অজানা। তবে কার্যকরী কিছু কারণ হলো :
১। জৈবিক ঘড়ি (Circadian rhythm ): শীতকালে সূর্যের আলো কমে যায়। এতে শরীরের অভ্যন্তরীণ ঘড়ির নিয়ম ব্যাহত হতে পারে এবং বিষণ্নতার অনুভূতির দিকে যেতে পারে।
২। সেরোটোনিনের মাত্রা : সেরোটোনিন হরমোন, মস্তিষ্কের রাসায়নিক নিউরোট্রান্সমিটার, যা মেজাজকে প্রভাবিত করে এবং ‘হ্যাপি হরমোন’ নামে পরিচিত। সূর্যের আলোর সংস্পর্শে এলে ত্বকে ভিটামিন-ডি তৈরি হয়। ভিটামিন-ডি সেরোটোনিন কার্যকলাপ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। তাই কম সূর্যালোক এবং খাবার এবং অন্যান্য উৎস থেকে পর্যাপ্ত ভিটামিন-ডি না পাওয়ার ফলে শরীরে ভিটামিন-ডি এর মাত্রা কম হতে পারে যা বিষণ্নতার কারণ হতে পারে।
৩। মেলাটোনিনের মাত্রা : ঋতু পরিবর্তন শরীরের মেলাটোনিনের স্তরের ভারসাম্যকে ব্যাহত করতে পারে, যা ঘুমের ধরণ এবং মেজাজে ভূমিকা পালন করে।
৪। নারী-পুরুষ ভেদে : এটি পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মাঝে প্রায়শই দেখা যায়। এবং বয়স্ক, প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় অল্প বয়সিদের মাঝে বেশি দেখা যায়।
৫। পূর্ব ইতিহাস :যাদের আগে থেকে বিষণ্নতা বা বাইপোলার ডিসঅর্ডারের লক্ষণগুলো রয়েছে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঋতু অনুসারে আরও খারাপ হতে পারে।
করণীয় :
১। সারা বছর ধরে আপনার মেজাজ ঠিক রাখা এবং নিজেকে অনুপ্রেরণা দেয়ার মতো কিছু পদক্ষেপ নিন। দৈনিক রুটিন মেনে চলুন এবং নিয়মের মধ্যে থাকার চেষ্টা করুন।
২। এই সময় কুয়াশা এবং দিন ছোট হওয়ায় ঘরে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। পর্যাপ্ত গরম কাপড় পরুন এবং প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে ‘ডিপ ব্রিথিং’ (শ্বাসের ব্যায়াম) অনুশীলন করুন।
৩। অনর্থক লেপ মুড়ো দিয়ে ঘুমানোর চেয়ে কিছু সৃজনশীল কিম্বা সামাজিক যোগাযোগ, বেড়ানো ইত্যাদি কাজের পরিকল্পনা আগেই করে রাখতে পারেন। ঠান্ডায় বের হতে না চাইলে ঘরে বসে বই পড়ুন, ডাইরি লিখুন কিম্বা বিনোদনের জন্য নাটক, সিনেমা দেখুন।
৪। শীতকালে পানির পিপাসা তেমন হয় না তাই পানি পানের তাগিদ কম থাকে। পর্যাপ্ত পানি গ্রহণ, ভিটামিন-সি, শাক-সব্জি, ফলমূল, ভেষজ চা খেয়ে নিজেকে চাংগা রাখতে চেষ্টা করতে পারেন সাথে হাল্কা ব্যায়াম, ব্যাডমিন্টন খেলার মতো খেলাধুলা করতে পারেন।
৫। SAD এর চিকিৎসার মধ্যে ফটোথেরাপি, সাইকোথেরাপি এবং ওষুধ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। সাধারণত শীতকালে লক্ষণগুলো শুরু হওয়ার আগে চিকিৎসা শুরু করা সহায়ক হতে পারে। মনোচিকিৎসা কিম্বা মনোসেবা প্রয়োজনে দু’টোই নিতে হবে।
যদিও আমাদের দেশে শীত প্রধান দেশগুলোর মতো তুষারপাত হয় না এবং একটানা সূর্যের দেখা নেই এমনটা হয় না। তারপরও যদি সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডারের উপসর্গগুলো দেখা দেয় তবে তা গুরুত্ব সহকারে নিন। অন্যান্য বিষণ্নতার মতো, এসএডি আরও খারাপ হতে পারে যদি এর চিকিৎসা না করা হয়।
-ফারজানা ফাতেমা (রুমী)
মনোবিজ্ঞানী
প্রতিষ্ঠাতা, সোনারতরী
/এসএস/মনেরখবর/