বার্ধক্যে যৌনস্বাস্থ্য

সম্প্রতি কুমিল্লা বার কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি প্রবীন আইনজ্ঞ জনাব ইসমাইল সাহেব বিয়ে করলেন। তার এই বিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী সামাদ আজাদও তার শেষ বয়সে স্ত্রীর মৃত্যুর পর বিয়ে করেছিলেন।

বৃদ্ধ বয়সে নি:সঙ্গ জীবনের বিয়ের অন্যতম কারণ একাকীত্ব। তবে যৌনতা ছাড়া দাম্পত্য জীবন একদম ভাবা যায় না। যৌনতার প্রতি আমাদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এই বিষয়টি নিয়ে আমরা সাধারণত কথা বলতে চাই না। বার্ধক্যে যৌনতাকে আমরা বলি ভীমরতি। কিন্ত আসলেই কি তাই?

আমাদের অর্থনৈতিক জীবনের পরিবর্তন আসছে। স্বাস্থ্যগত দিক থেকে আমাদের গড় আয়ু বাড়ছে। যদিও আমাদের দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তরুণ তবুও একথা মানতেই হবে পূর্বের তুলনায় আমাদের বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়।

প্রবীনদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবতে গেলে তাদের যৌনজীবন, দাম্পত্য সমস্যার দিকগুলোও ভাবতে হবে। প্রবীন বয়সে সেক্সচুয়াল কর্মকান্ডে জড়িত হতে না চাওয়া যেমন স্বাভাবিক তেমনি কেউ জড়িত হতে চাইলে তাকে নিবৃত করাও অমানবিক যদি তার সামর্থ্য থাকে এবং বৈধতা থাকে।

মি. কবির সাহেব (ছদ্ম নাম) একজন অবসর প্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা ,তার স্ত্রী নাসরিন বেগমও (ছদ্ম নাম) অবসরে গেছেন। বাড়ীতে লোক বলতে তারা দুজনই। ছেলে বিয়ে করার পর বৌ নিয়ে আলাদা থাকেন। মেয়ে থাকেন বিদেশে। দুজনের জীবনে নিয়ম মাফিক দিন হয়, রাত হয়। জীবন ক্রমশ একঘেয়ে হয়ে উঠেছে।

ছেলের জন্য অপেক্ষা, মেয়ের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া তাদের হাতে আর কোনো কাজ নেই। কিছুদিন হলো কবির সাহেবের স্ত্রী লক্ষ করছেন যে কবির সাহেব শুতে গেলে তার স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হতে চান। বার্ধক্য দুজনের শরীরেই বাসা বেঁধেছে এ অবস্থায় যৌন মেলামেশার ধকল তিনি সহ্য করতে পারবেন কিনা সন্ধিহান।

পড়ুন….
নারীর যৌন সমস্যা ও কিছু কথা

হাড়ের ক্ষয়, অস্থি সন্ধিতে ব্যাথা সেই সাথে শুকনো যোনীর সমস্যা তো আছেই। তবুও স্বামীকে ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধের কারণে তিনিও চান ঘনিষ্ঠতা হোক। কিন্ত সেটা সম্ভব হয় না। কারণ কবির সাহেবের লিঙ্গ উত্থিত হয় না। এই সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যেতে বিব্রত বোধ করেন। তাই দুজন মানুষ নীরবেই কষ্টগুলো সহ্য করে যাচ্ছিলেন।

ইউটিউবে আমার একটি ভিডিও দেখে ওনারা আগ্রহী হন আমার সাথে কথা বলতে। আমার মনে আছে যেদিন ওনারা আমার চেম্বারে আসেন সেদিন সব রোগী দেখার পর ওনারা আমার চেম্বারে প্রবেশ করেন সন্তর্পণ পায়ে। কথা বলেন নীচু স্বরে, যেন কেউ শুনে না ফেলে। শারীরিকভাবে ফিট আছে কিনা জানার জন্য বার বার পরীক্ষা নিরীক্ষার অনুরোধ করেন।

স্বামী স্ত্রী দুজনের কারোরই ডায়াবেটিকস, হাইপারটেনশন ছিলো না, হরমোন লেভেলও স্বাভাবিক, রক্তে চর্বির মাত্রা বা কোলেস্টেরল স্বভাবিক। ভদ্রলোকের পেনিসের আল্ট্রাসনোগ্রাম বা ডুপ্লেক্স স্টাডি অব পেনিস করিয়ে ছিলাম। সেটাও নরমাল এসেছে।

যৌন এই সমস্যার পাশাপাশি কোনো মানসিক সমস্যায়ও ভুগছেন কিনা জানার জন্য খোঁজ নিলাম। দেখা গেলো, তিনি বিষন্নতায় ভুগছেন। বিষন্নতার কারনে তিনি নিদ্রাহীনতায়ও ভুগছেন। যৌনতার বিষয় এসেছে এই নিদ্রাহীনতা বা ইনসোমনিয়া থেকে। ঘুমে ধরে না বলে তিনি সেক্স করতে চাচ্ছিলেন। যেহেতু সেক্স করার পর অনেকেরই ঘুম আসে তাই তিনি সেক্স করতে চাচ্ছিলেন, যা ঠিক যৌন উত্তেজনার কারণে নয়।

তার বিষন্নতার চিকিৎসা দেওয়া হলো। তাদের জীবনে আবার ছন্দ ফিরে এলো। যৌন বিষয়েও কিছু টিপস দেওয়া হলো। এই বয়সে লিঙ্গের উত্থান এবং যোনীর পিচ্ছিলতা আসা যে ধীর প্রক্রিয়া সেটাও বুঝিয়ে বলা হল। তারা তাদের সমস্যা থেকে মুক্তি পেলেন। ধন্যবাদ জানাতে একদিন চেম্বারে এসে দেখাও করে গেলেন।

বার্ধক্যে বেশ কয়েকটি বিষয় যৌনতার জন্য বাঁধা হয়ে দাড়ায়, যেমন- আর্থাইটিস, ক্রনিক পেইন বা দীর্ঘমেয়াদী ব্যাথা, ডিমেনশিয়া, ডায়াবেটিকস, হৃদরোগ, মূত্রথলির সমস্যার কারণে প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা, পক্ষাঘাত বা স্ট্রোক, বিষন্নতা, পার্কিনসন্স ডিজিস ইত্যাদি। তাই এই বয়সে যৌনতার কথা ভাবতে গেলে এই বাঁধাগুলোর কথাও ভাবতে হবে।

এটাও পড়ুন….
যৌন স্বাস্থ্য বা দাম্পত্য সম্পর্কে অতি চঞ্চলতার প্রভাব
অন্তরঙ্গ সম্প‌র্ক ও সহিংসতা : ফলাফল, কারণ ও করণীয়

যৌনতা অনেক সময়ই শরীর ও আবেগের সূক্ষ্ম সাম্যবস্থার ওপর নির্ভর করে। আপনি কেমন অনুভব করছেন তার ওপর নির্ভর করছে- আপনি কী করছেন বা কী করতে চাচ্ছেন। অনেক বৃদ্ধ দম্পতি বার্ধক্যে এসে যৌনতাকে তারুন্যের চেয়েও বেশী উপভোগ্য মনে করতে পারেন।

দাম্পত্য জীবনের কিছু ধাপ থাকে। দাম্পত্য জীবনের শুরুটা রোমান্টিকতায় শুরু হলেও কিছুদিন বাদে টানাপোড়েনের সময় আসে। সেটা অতিক্রান্ত হলেই আসে স্থিতির পর্ব। এই স্থিতি পর্বে এসে দম্পতি পরস্পরকে তার সীমাবদ্ধতা সহ মেনে নিতে শুরু করে।

বার্ধক্যে তাই যৌন সম্পর্কটা একটা ভিন্ন রূপ পায়। শারীরিক সীমাবদ্ধতা থাকলেও মানসিক সীমাবদ্ধতা অনেক কমে যায়। মনে রাখবেন, বার্ধক্যে পারফরম্যান্স বড় নয়; বড় হচ্ছে জীবনসঙ্গীর সাথে থাকতে চাওয়া বা থাকা।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র : মাসিক মনের খবর মার্চ ২০২২ সংখ্যা

লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন এখানে : 

  • মাসিক মনের খবর প্রিন্ট ম্যাগাজিন সংগ্রহ করতে চাইলে কল করুন : 01797296216 এই নাম্বারে। অথবা মেসেজ করুন পেজের ইনবক্সে। লেখা পাঠাতে পারেন monerkhaboronline@gmail.com বা এই 01844618497 হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে।

/এসএস/মনেরখবর/

Previous articleঅপরাধপ্রবনতা ও অনুশোচনা : হ্যারী হুডিনির মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ
Next articleসুখের পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার কেন এতো তাড়া….!
ডা. এস এম আতিকুর রহমান
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here