মানসিক প্রশান্তির জন্য ক্ষমার অনুশীলন করুন

0
65

কবিগুরু রবিঠাকুরের ভাষায়, ‘ক্ষমাই যদি করতে না পারো, তবে তাকে ভালোবাসো কেন?’ পারস্পরিক সম্পর্কে ভুল-ত্রুটি ও ভালো মন্দ থাকবেই। তাই সম্পর্কের মানুষটি ভুল করলে তার প্রতি তীব্র ক্ষোভ ও বিরক্তি তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই ক্ষোভ মানসিক শান্তি বিনষ্ট করে, তাই মনের জ্বালা মেটাতে অনেকে রাগ প্রকাশ করেন, ক্ষোভ ঝাড়েন, নিজের জেদ প্রকাশ করেন এবং একসময়ে তীব্র উত্তেজিত হয়ে পড়েন।

এসব আচরণের কারণে মনে আপাত শান্তি হলেও দীর্ঘমেয়াদী হতাশা, মানসিক চাপ, ট্রমা বেড়ে শারীরিক ও মানসিক মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়। এই আচরণগুলোর কারণে নিজের মানসিক শান্তি নষ্ট হয়, সম্পর্ক নষ্ট হয়, একে অপরের প্রতি মতবিরোধ তৈরি হয়, এমনকি শারীরিক বিভিন্ন রোগ (ডায়বেটিকস, হাপানী, হাই ব্লাড প্রেসার ইত্যাদি) বাড়তে পারে। এই মতবিরোধ ও মতানৈক্যের ওপর ভিত্তি করে পরস্পরের মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষও হতে পারে। সুতরাং মানসিক শান্তি ও সুন্দর সম্পর্কের স্বার্থে ক্ষমার অনুশীলন কররতে হবে।

ক্ষমা করে পারস্পরিক সম্পর্কে বিরক্তিকর ক্ষোভ বা অনুভুতি ছেড়ে দিলেই মানসিক শান্তি পাওয়া যায়। যদিও মহাত্মা গান্ধি মনে করেন ‘দুর্বলরা কখনোই ক্ষমা করতে পারে না। ক্ষমা শুধু শক্তিশালীরাই করতে পারে।’ এর মাধ্যমে নেতিবাচক অনুভূতিগুলোকে মুক্তি দিয়ে নিজের শান্তির অনুভুতিগুলো আয়ত্ব করা যায়। ফলে সাধারণ মানুষও অসাধারণ ব্যক্তিসম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠতে পারেন। এর মাধ্যমে মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়, সম্পর্কগুলো আরো সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয় এবং ব্যক্তি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থতা অর্জন করতে পারেন।

Magazine site ads

তবে সবাই ক্ষমা করতে পারেন না, যাদের অন্যকে ক্ষমা করতে অসুবিধা হয় তাদের মানসিক শান্তির জন্য মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার মাধ্যমে ক্ষমা করার কৌশল আয়ত্ব করতে পারলে অন্যকে ক্ষমা করা সহজ হয়।

ইসলামে ক্ষমা: ইসলাম ধর্মে ক্ষমার গুরুত্ব অসীম। মহান আল্লাহ অত্যন্ত দয়ালু ও ক্ষমাশীল। তিনি নিজে ক্ষমা করতে ভালোবাসেন এবং যিনি অন্যকে ক্ষমা করেন তাকেও ভালোবাসেন। তিনি মানুষকে ক্ষমা করতে আদেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা সুসময়ে ও দুঃসময়ে ব্যয় করে এবং ক্রোধ সম্বরণ করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন।’ (সূরা আল-ইমরান, আয়াত: ১৩৪)

তিনি আরো এরশাদ করেন, ‘যদি তোমরা ভালো কিছু প্রকাশ করো কিংবা গোপন করো অথবা ক্ষমা করে দাও, তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, ক্ষমতাবান।’ (সূরা নিসা, আয়াত: ১৪৯)।

ক্ষমাকারীর জন্য আল্লাহ তায়ালা বিশেষভাবে পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। মানুষদের মধ্যে বিরোধ নিষ্পন্নকারীদেরও আল্লাহ পুরষ্কার দেবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর মন্দের প্রতিফল মন্দ। অতঃপর যে ক্ষমা করে দেয় এবং বিবাদ নিষ্পত্তি করে, তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে রয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ জালিমদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা শুরা, আয়াত: ৪০) ক্ষমা করলে কারো মর্যাদা কমে না। বরং বহু গুণে ক্ষমাশীল ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা. বলেন, ‘সদকা করলে সম্পদের ঘাটতি হয় না। যে ব্যক্তি ক্ষমা করে, আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আর কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনীত হলে, তিনি তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।’ (মুসলিম, হাদিস: ২৫৮৮)।

ক্ষমা করার মনোবৈজ্ঞানিক কৌশল: সাইকোলজিক্যালি অপরাধটিকে হ্রাস বা অস্বীকার না করেও কাউকে ক্ষমা করা সম্ভব। ক্ষমা করার ক্ষেত্রে অপরাধ গুরুতর হলে মাঝে মাঝে সময় লাগতে পারে।

যখন কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বা দুর্ঘটনাক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতি সাধন করে, তখন সেই ব্যক্তিকে ক্ষমা করা কঠিনও হতে পারে। যদিও একজন ব্যক্তি কীভাবে ক্ষমা করতে সক্ষম তা সেই ব্যক্তির নিজস্ব মানসিক সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। এছাড়া ইমপ্যাথিক্যাল হলে ক্ষমা করা সহজ হতে পারে।

প্রিয়জনকে নিম্নোক্ত পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে ক্ষমা করতে পারেন:

-কী কারণে আপনার প্রিয়জন ভুলটি করেছে, তা বুঝার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে তার সাথে বিষয়টি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করুন।

-অন্য ব্যক্তির অবস্থানটি ইমপ্যাথিক্যালি বোঝার চেষ্টা করুন। তার অবস্থানে গিয়ে নিজেকে ভাবুন।

-যে ব্যক্তি ভুল করেছেন তার প্রতি ক্রোধ বা হতাশা প্রকাশ থেকে বিরত থাকুন। কেননা ক্রোধ বা হতাশা প্রকাশ করলে তা বাড়তেই থাকবে এবং তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার ইচ্ছা নষ্ট হবে।

-আপনি যখন কাউকে মানসিক আঘাত করে ফেলেছেন, সেই সময়ে অন্য ব্যক্তি আপনাকে ক্ষমা করলে কেমন লাগতো সে সম্পর্কে ভাবলে আপনার জন্য ক্ষমা করা সহজ হবে।

মনের খবর ম্যগাজিনে

-আপনার ক্ষমা করার ইচ্ছা না হলেও অন্য ব্যক্তিকে বলুন যে, আপনি তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। এভাবে কয়েকবার বললে আপনি ক্ষমা করার যৌক্তিকতা খুজে পাবেন।

-ক্ষমার ধর্মীয়, মানবিক ও সামাজিক গুরুত্ব চিন্তা করুন।

-ক্ষমা করার ফলে নিজের লাভ ও ক্ষতি চিন্তা করুন।

-ক্ষমা করার ফলে নিজের কী কী মানসিক প্রশান্তি হবে সে সম্পর্কে চিন্তা করুন।

-ক্ষোভের কারণে কী কী নেতিবাচক চিন্তা আসে সেগুলো শনাক্ত করে চ্যালেঞ্জ করলে আপনার ক্ষোভ কমে যাবে।

 মাইন্ডফুলনেন্স প্রাকটিস করে বর্তমান সম্পর্কে সচেতন হউন, অতিত সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তা আসলে সেগুলো থেকে বিচার বিবেচনাহীনভাবে নিজের মনকে বর্তমানে নির্দিষ্ট করতে পারেন।

-এরপরেও না পারলে, সাইকোলজিক্যাল এক্সপার্টের সহায়তা নিন।

লেখক: জিয়ানুর কবির
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট।

Previous articleপ্রথমবারের মতো বাংলাদেশ হরমোন দিবস পালন উপলক্ষ্যে মনের খবর টিভির বিশেষ লাইভ ওয়েবিনার
Next articleসোশ্যাল ফোবিয়া প্রভাব ফেলে সম্পর্ক ও যৌন স্বাস্থ্যে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here