১০ই অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। ১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে সবার মানসিক স্বাস্থ্য ও ভালো থাকাটাই হোক বৈশ্বিক অগ্রাধিকার।
বিশ্বমারী কোভিড ১৯ আমাদের সামনে তুলে ধরেছে বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা, হতাশা, মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ এর চিত্র। কোভিড পরবর্তী ভঙ্গুর পৃথিবীতে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন এবং সুস্থ্যতার মাত্রা আমাদের কাছে নতুনভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
প্রতিপাদ্যের প্রথম অংশে বলা আছে, সবার জন্যে মানসিক স্বাস্থ্যের কথা। দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে এটি বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের কী করা উচিত বা কী উদ্যোগ প্রয়োজন। অর্থাৎ আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে, NO HEALTH WITHOUT MENTAL HEALTH মানে মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতা ব্যাতিরেকে সুস্থ মানুষ, সমাজ, দেশ এবং জাতি সম্ভব নয়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র .৫ শতাংশ ব্যাবহার করা হয় মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে। ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ সার্ভে বলছে, দেশে ২ কোটি মানসিক রোগী বিদ্যমান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে যে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে বিশ্বে একজন মারা যায় মানসিক রোগে। অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন এবং শিশু বিকাশ সব সময়ই বাধাগ্রস্ত হয় এবং হচ্ছে। এই সময়ে অধিক বিনিয়োগ এবং আবাধ সুযোগ এর জন্যে আমরা কিছু উদ্যোগ এবং কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারি।
১. অধিক পরিমানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সেবিকা ও দক্ষ স্বাস্থ্য কর্মী তৈরি করতে হবে মনোরোগের জন্যে।
২. পাঠ্য পুস্তকে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার নিয়মাবলি এবং কিশোর কিশোরীদের শিক্ষা প্রদানের কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে তাদেরকে আগেভাগেই সচেতন করতে হবে এই বলে যে, এটি কোনো ঠুনকো বিষয় নয়। অনেক মানসিক রোগই জটিল এবং দীর্ঘ মেয়াদি ঔষধের প্রয়োজন হয়।
৩. আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইলেকট্রনিক প্রিন্ট মিডিয়াকে জনসচেতনতায় সম্পৃক্ত করতে হবে।সামাজিক দায়িত্বশীল ব্যাক্তিদের এক্ষেত্রে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
৪. এমবিবিএস বা গ্রাজুয়েশন এর সময় মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন এবং চিকিৎসার ব্যাপারটা খুব গুরুত্ব দিতে হবে।যদি চিকিৎসা শাস্ত্রের স্নাতক ডিগ্রীর সময়ই মানসিক স্বাস্থ্য, কাউন্সেলিং এবং বিহেভিয়ারাল সাইন্স নিয়ে যথেষ্ট দক্ষতা শিক্ষার্থীরা অর্জন করে তাহলে তা পরবর্তীতে আরো সফল চিকিৎসক হিসেবে তাদের তৈরি করবে।
৫. সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে কর্মপরিকল্পনা তৈরি এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।
৬. বয়স্কদের শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে। অবসাদ, বিষন্নতা, অস্থিরতা, অনিদ্রা বয়স্কদের মাঝে খুব বেশি দেখা যায়। এসব ক্ষেত্রে বয়স্কদের জন্যে মানসিক স্বাস্থ্য ক্লিনিক এবং সাইকোলজিকাল থেরাপির ব্যাবস্থা করতে হবে।
৭. মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে যাদের তাদের ব্যাপারে সমাজের মানুষের নেতিবাচক ধারণা দূর করা প্রয়োজন। একজন সিজোফ্রেনিয়া কিংবা বাইপোলার ডিজঅর্ডার এর রোগী কেউ সামনা সামনি না দেখলে কিংবা পরিবারে না থাকলে আমাদের পক্ষে রোগী এবং পরিবারের কষ্ট এবং যন্ত্রণা বোঝা সম্ভব নয়।
৮. গবেষণা এবং পলিসি নির্ধারণে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। কনভার্সন ডিজঅর্ডারকে অনেক সময় খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কিন্তু এক গবেষণায় দেখা যায় বার বার হাসপাতালে কনভার্সন ডিজঅর্ডার নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের শতকরা ৭০ ভাগ পরবর্তীতে বিভিন্ন নিউরোলজিকাল রোগে আক্রান্ত হয়।
৯. অন্ততপক্ষে প্রথমে জেলা এবং পরবর্তীতে উপজেলা পর্যায়ে কাউন্সিলিং এবং থেরাপির ব্যাবস্থা করা প্রয়োজন।
১০. সামাজিক সংশোধনাগার এবং আলোচনার ক্ষেত্র হিসেবে সাইকিয়াট্রি বিভাগকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, যেমনটা করা হয়েছে উন্নত বিশ্বে।
সফল হোক মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০২২। সবার মধ্যে সচেতনতা আরও বৃদ্ধি পাক। উন্নত, মানবিক, আধুনিক, সুস্থ সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্যে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার এবং উদ্যোগ গ্রহনের এখনই সময়। বৈশ্বিক অগ্রাধিকার হওয়া উচিত মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা।
লেখক : ডা. মোহাম্মদ হাসান
রেসিডেন্সি ফেইজ বি চিকিৎসক
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ।