ভালোবাসতেন এক তরুণীকে। প্রেমের সম্পর্ক বেশিদিন টিকেনি। নিজের প্রিয় মানুষকে হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এমনকি আত্মহত্যার চেষ্টা পর্যন্ত করেন। আস্তে আস্তে আক্রান্ত হয়ে পড়েন মানসিক রোগে।
- তবে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। প্রেমে ব্যর্থতাই জসিমের মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণ নয়। এর পেছনে রয়েছে অন্য কোনো কারণ।
জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ঘোষেরপাড়া ইউনিয়নের চাড়ালকান্দি গ্রামের মৃত নিজাম উদ্দিনের ছেল জসিম উদ্দিন (২৬)। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে দুই বছর আগে বিষপান করে পাশের একটি গ্রামে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। জসিমকে উদ্ধার করে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়ার পর বেঁচে যান। জীবন ফিরে পেলেও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে জসিম। গত দুই বছর ধরে শিকলবন্দি পড়ে আছে তার জীবন।
এলাকাবাসী জানান, জসিম উদ্দিন পড়াশোনায় ছিলেন অদম্য মেধাবী, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় রেজাল্টও ভালো করেছিলেন। জসিম স্বাভাবিক থাকা অবস্থায় ভালোবেসে ছিলেন এক মেয়েকে। সম্পর্ক বেশি দিন পর্যন্ত গড়ায়নি। প্রেমের ব্যর্থ হয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। ভুলে থাকার সহজ সমাধান খুঁজতে আসক্ত হয়ে পড়েন নেশায়। পারিপার্শ্বিক নানা মানসিকচাপের পাশাপাশি শারীরিক নির্যাতনও চলে তার ওপর।
২০১৬ সালে চলাফেরা অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে তার। হঠাৎ বিষপান করে পাশের একটি গ্রামে গিয়ে। সেখান থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে চিকিৎসা করে বাড়ি ফিরে আনলে পুরোপুরিভাবে হারিয়ে ফেলেন মানসিক ভারসাম্য। তারপর থেকেই শিকলে বাঁধা পড়ে মেধাবী জসীম।
ছোট্ট একটি বাঁশের চাটাই দিয়ে তৈরি একটি ঘরে নোংরা একটি কাপড় গায়ে দিয়ে শুয়ে আছেন জসিম। দুই পাশে বেড়া দিয়ে রয়েছে, আর কোনো বেড়া নেই। পায়ে শিকল লাগিয়ে একটি খুঁটির সঙ্গে বাঁধা রয়েছেন। কোনো কথা বলছেন না। এদিক-সেদিক শুধু তাকাচ্ছে। চারপাশে মশার উপদ্রব। কিন্তু সেখানে মশা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। বৃষ্টি এলে ভিজতে হয়। জসিমকে পুরনো কোনো স্মৃতির কথা বললে লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলে।
- জসিম উদ্দিনের বাবা নিজাম উদ্দিন তিন বছর আগে মারা গেছে। বাড়িতে বড় এক ভাই ও মা থাকেন। চার ভাই বোনের মধ্যে জসিম উদ্দিন হলেন সবার ছোট।
মা জরিনা বেগম বলেন, জসিম উদ্দিন ৬ বছর ধরে পাগল হয়েছে, আমার ছেলে আর নেই, জীবিত থেকেও মরা। আগে কিছুটা ভালো ছিলো এখন আরও অবস্থা খারাপ। ছেলে বেলা থেকেই পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলো। এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগে এই সমস্যা শুরু হয়। অসুস্থ হয়েও এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল; ভালো রেজাল্ট করেছে।
তিনি বলেন, ছেলের চিকিৎসায় সংসারের সবকিছু শেষ করেছি। তাকে চিকিৎসা করার মতো আমাদের আর কিছুই নেই। বেসরকারি হাসপাতালে কিছুদিন চিকিৎসা করেছি ১ লাখ টাকা লেগেছিল। কিছুটা ভালো হয়েছিল। টাকার অভাবে সেখান থেকে আবার নিয়ে আসতে হয়েছে। সেখানে কিছুদিন চিকিৎসা করলে ভালো হবে। কিন্তু অর্থের অভাবে আর চিকিৎসা করাতে পারছি না। মানুষজন দেখলেই মারধর গালাগালি ও বাড়িতে ভাঙচুর শুরু করে। এই কারণে তার পায়ে শিকল পরিয়ে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে।
জসিম উদ্দিনের চাচা আমজাদ আলী বলেন, ছোটবেলা থেকে সে খুবই শান্ত ও মেধাবী ছিল। হঠাৎ করেই জসিম উদ্দিন পাগল হলো। ৩ বছর আগে তার বাবাটা ও মারা গেছে। অভাব অনটনের সংসারে ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারছেন না। চিকিৎসা পেলে সুস্থ হতে পারে জসিম।
প্রতিবেশী মো. আলমগীর হোসেন বলেন, কয়েক বছর আগেও তিনি একটু ভালো ছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা বন্ধ হওয়ায় আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। উন্নত চিকিৎসা করা হলে সুস্থ হয়ে উঠবে।
মেলান্দহ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সেলিম মিঞা বলেন, জসিমের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে ওই পরিবার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছে, সার্বিকভাবে সহায়তা করা হবে।
- এ ব্যাপারে কথা বলি মনের খবর সম্পাদক, বিএসএমএমইউ এর মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সালাহ্ উদ্দিন কাউসার বিপ্লব এর সাথে।
তিনি বলেন, বিষয়টিকে প্রেমে ব্যর্থতা বা প্রেমের সাথে সম্পর্ক করে তার অসুস্থতাকে ছোট করা বা অসুস্থতাকে বাদ দেওয়াটা ঠিক হবে না। যে কারণেই হোক তার রোগ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তার মানসিক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা দুইটা। একটা হল নেশায় আসক্ত হওয়া বা নেশার রোগ অথবা সিজোফ্রেনিয়া। যে কোনোটাই হোক, অনেক সময় এই রোগগুলোর দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা করতে হয়। এখন আমরা যদি তার অসুস্থতাকে কোনো একটা কাহিনীর সাথে সম্পর্ক করে দেই তাহলে এটাতে আরো বেশি স্টিগমা বা কুসংস্কার চলে আসবে। যে ও এরকম একটা কাজ করেছে বলে এরকম হচ্ছে। এরকম অনেকে মনে করতে পারে কিন্তু এটা করা যাবে না।
- তিনি বলেন, একটা সম্ভাবনাময় সুন্দর ছেলে, পড়াশুনা ভালো ছিলো। তার অবশ্যই ভালো থাকার সম্ভাবনা আছে। তাকে ভালো থাকার জন্য চিকিৎসার অধীনে নিয়ে আসতে হবে। হ্যাঁ, তার মা যে বলেছে পরিবার অনেক টাকা খরচ করেছে, চিকিৎসার জন্য অনেক খরচ হয় এটা সত্যি। তবে এখন প্রায় সব সরকারি হসপিটালে অত্যন্ত কম খরচে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে প্রাইভেট বিভিন্ন হাসপাতালেও মাসে বা সপ্তায় সাইক্রিয়াটিকরা যান, বিভিন্ন জায়গায় একদিন বসেন সেখানেও কিন্তু খুব বেশি টাকা লাগবে তা না। কারণ প্রতি মাসে বা প্রতি সপ্তাহে তো এটার জন্য দেখাতে হবে না। প্রথমে এক দুই মাস হয়তো ঘন-ঘন দেখাতে হবে তারপর পরবর্তী কিন্তু কন্ট্রোলে চলে আসলে এক মাস পরে বা দুই মাস পরে বা তিন মাস পরে পরে দেখানো যায়।
আর এখনকার চিকিৎসা আগের যে কোনো চিকিৎসার চেয়ে অনেক ভালো। সুতরাং আমি রিকোয়েস্ট করব পরিবারকে বলে তাকে চিকিৎসার আওতায় আনা।
তিনি আরো বলেন, গভমেন্ট হসপিটালে বা যদি সম্ভব হয় প্রাইভেট হসপিটালে চিকিৎসা করানো উচিত। তাহলে ওর আরও ভালো থাকার সম্ভাবনা অবশ্যই আছে।
ডা. বিপ্লব জানান, আগেরকার যে কোনো চিকিৎসা এবং চিকিৎসার রেজাল্টের থেকে এখনকার চিকিৎসা ও রেজাল্ট অনেক ভালো।
‘সুতরাং পরিবারকে অনুরোধ করবো কষ্ট হলেও যেন তাকে চিকিৎসার আওতায় আনা হয়’ বলছিলেন, অধ্যাপক ডা. সালাহ্ উদ্দিন কাউসার বিপ্লব।
/এসএস/মনেরখবর