মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
হ্যারী হুডিনি ২৪ মার্চ, ১৮৭৪ সালে হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট শহরে ইহুদি পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। ছোটবেলায় সপরিবারে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিনে। মাত্র বারো বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন, যদিও পরে আবার পুনর্মিলিত হন। সতেরো বছর বয়সেই পুরোদমে যাদুবিদ্যার কৌশল দেখানোকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন।
তিনি এই কাজে এতোটাই দক্ষ হয়েছিলেন যে ইসকেপ আর্ট দেখানো শুরু করেছিলেন। ইসকেপ আর্ট হচ্ছে কঠিন বন্দীদশা থেকে মুক্ত হওয়ার কৌশল দেখিয়ে দর্শককে আনন্দিত করা! এই কাজ শুরু করার পরই মূলত তার খ্যাতি ছড়াতে শুরু করেছিল। নাম পেয়েছিলেন- ‘হ্যারী হ্যান্ডকাফ হুডিনি’!
প্রথমে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে ভ্রমণে বের হয়ে বিভিন্ন শহরের পুলিশদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতেন তাকে আটকে রাখার! এরপর সেখান থেকে মুক্ত হয়ে তাক লাগিয়ে দিতেন সবাইকে। তার আসল নাম ছিল এরিক উইজ। যাদুবিদ্যা দেখানোর কাজ শুরু করার পর তৎকালীন দুই বিখ্যাত যাদুকর জা রবার্ট হুডিনি এবং হ্যারী কেলারের নাম থেকে অংশ ধার করে নিজের নতুন নামকরণ করেছিলেন!
খ্যাতি পাওয়ার পর একের পর এক দুঃসাহসিক কাজ করার ঝুঁকি নিয়েছিলেন, যেমন- স্কাই স্ক্রাপার থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় মুক্ত হওয়া, জীবন্ত অবস্থায় কবর দেয়ার পর সেখান থেকে মুক্ত হওয়া! আরেকটি জনপ্রিয় শো ছিল হাত পা বেঁধে পানির জারে ডুবিয়ে দেয়া! সেখান থেকেও বেরিয়ে আসতেন তিনি।
জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তি হয়েছিলেন। পৌঁছে গিয়েছিলেন সাফল্যের চূড়ায়! উনিশ বছরে বয়সে তার সহযোগী শিক্সা বেস-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন! পুরোটা জীবন মা ও স্ত্রীর প্রতি দায়িত্বশীল ছিলেন। মায়ের মৃত্যুর পর পাওয়া শোক আজীবন বহন করতে হয়েছিল তাকে।
ফ্রয়েডিয়ান সাইকোএনালিস্টদে্র অনেকে মত প্রকাশ করেছিলেন হুডিনির ইডিপাল কমপ্লেক্সের সমস্যা ছিল কিনা! তার বাবা যিনি একজন ইহুদি ধর্মযাজক ছিলেন নতুন দেশে আসার পর জীবনে আর সফলতার মুখ দেখেননি। যদিও পরিবারের পরিসরে তাকে সফল নায়কোচিত মানুষ হিসেবে দেখানোর প্রবণতা ছিল!
তাকে উপস্থাপন করা হতো একজন শক্তিশালী মানুষ হিসেবে যে এক অভিজাতকে হত্যা করে হুডিনির মাকে ছিনিয়ে এনেছিল! তরুণ উইস যিনিই পরবর্তী কালে হুডিনি নামে পরিচিত হয়েছিলেন, মাত্র বারো বছর বয়সে বাড়ি ছেড়েছিলেন। এই গৃহত্যাগ কোনো ক্ষণস্থায়ী ঘটনা ছিল না, বরং কয়েক বছর তিনি বাইরে কাটিয়েছিলেন।
এই ঘটনা ইডিপাল কমপ্লেক্স কিংবা বাবাকে ভয় পেয়ে ঘটার সম্ভাবনা খুব কম! আরো বাস্তব কিছু সমস্যা তার ছিল। হয়ত স্কুলের পড়াশোনায় খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না! এই ঘটনা ছিল ১৮৮৬ সালের যখন কিশোররা অনেক কম বয়সেই জীবিকার জন্য পথে নেমে পড়ত। হয়তো সৌভাগ্যের খোঁজে পথে নেমেছিলেন হুডিনি।
এরিক এরিকসনের মতে এটা ছিল আইডেনটিটি ক্রাইসিস যেটা তাকে হুডিনি বানিয়েছিল। কিশোর বয়সের খুব স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে নিজের জন্য হিরো বা ইগো আইডিয়াল খুঁজে বের করা। কিশোর উইস এর ক্ষেত্রে এই প্রবণতা অত্যধিক তীব্র ছিল।
তিনি যাদুকর রবার্ট হুডিনের আত্মজীবনী পড়ে তাকে নিজের জন্য আদর্শ চরিত্র হিসেবে দাড় করিয়েছিলেন। যদিও ধীরে ধীরে সেটা ক্রমশ কমে গিয়ে বিপরীত রুপ নিয়েছিল। একসময় তেত্রিশ বছর বয়সে তার ইগো আইডিয়ালের তীব্র সমালোচনা করে বইও লিখেছিলেন।
হ্যারী হুডিনি এর কাছে মায়ের স্থান খুব উঁচুতে ছিল। তবে হয়ত কিছুটা বাড়াবাড়ি রকমের ছিল! তিনি মাকে রাণী ভিক্টোরিয়ার জন্য তৈরি পোশাক কিনে দিয়েছিলেন! মায়ের মৃত্যুর পর প্রচন্ড শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন! মৃত্যুর বহুদিন পর পর্যন্ত মায়ের গল্প শোনাতেন সবাইকে। এমনকি আত্মহত্যার পরিকল্পনাও করেছিলেন!
তার চরিত্রে সবকিছুকে নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করার প্রবণতা ছিল! মৃত্যুকে চ্যালেঞ্জ করতেন আর প্রচন্ড সহ্য ক্ষমতাও ছিল! মাত্র বিশ বছর বয়সে আবেগতাড়িত হয়ে বিয়ে করেছিলেন, যা আজীবন টিকেছিলো! তবে তার জীবনে মা এর স্থান সবসময় সবকিছুর উপরে ছিল।
মায়ের মৃত্যুর পর স্ত্রীর সাথে সমস্ত আবেগ অনুভূতি দেখাতেন। স্ত্রীর প্রতি আচরণ বেশ খানিকটা অপরিণত ছিল। তবে নির্ভরশীল ছিলেন স্ত্রীর উপর। হুডিনির চরিত্রের আরেকটা দিক হচ্ছে নৈতিকতা বা মোরালিটির কোড তীব্র ভাবে মেনে চলার প্রবণতা। এটার মাত্রা এতো বেশি ছিল যে ফিল্মে অভিনয়ের সময় অপরিচিত অভিনেত্রীর সাথে অভিনয়েও সমস্যা হতো!
অনেকে ধারণা করেন তিনি অবদমিত মানুষ ছিলেন; যিনি রোমান্টিক ভালোবাসা ও ইরোটিক ভালোবাসাকে কখনো আলাদাভাবে নিতে পারতেন না। অনেক সাইকোএনালিস্ট এর মতে তিনি যৌনতা ও ক্রোধকে এতো বেশি অবদমন করেছিলেন যে এটা তার ইসকেপ আর্ট বা বন্দীদশা থেকে মুক্ত হওয়ার পেশার মাধ্যমে যেন মুক্তির পথ খুঁজেছিল!
অপরাধ প্রবৃত্তির প্রতি হয়তো হুডিনির এম্বিভ্যালেন্স ছিল; অর্থাৎ ভালোবাসা ও ঘৃণা একইসাথে কাজ করত। শৈশবে ছিঁচকে চুরির ইতিহাস ছিল আবার পরবর্তী জীবনে বন্দীত্ব বা হ্যাণ্ডকাফ থেকে মুক্তি পাওয়ার তীব্র বাসনা ছিল। তিনি চাইলে এই দক্ষতাকে অনৈতিক কাজে ব্যবহার করতে পারতেন; কিন্তু করেননি!
হুডিনি অষ্টাদশ শতকের এক নামকরা প্রতারক ও ঠগ ক্যাগিলস্ট্রো এর পান্ডুলিপি সংগ্রহ করেছিলেন; তার জীবনাচরণের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। আবার দীর্ঘ সময় রবার্ট হুগিন নামক বিখ্যাত যাদুকরকে তার আদর্শ ভাবতেন। হয়তো হ্যারী হুডিনির চরিত্র ওই দুই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব থেকে কিছু কিছু অংশ ধার নিয়ে নিজের ভিতর আত্তীকরণ করেছিল! তার ভিতরের অপরাধ প্রবণতা সম্ভবত বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।
ফলশ্রুতিতে যা বের হয়ে এসেছিল তা হলো মঞ্চ কাঁপানো দক্ষতা, যা আইন রক্ষার পক্ষেই কাজ করেছিল। প্রতারকদের ক্ষেত্রে সাধারণত সুপার ইগো ত্রুটিপূর্ণ হয়, ইডিপাল কমপ্লেক্স অসমাধিত থাকে, নিজস্ব আইডেনটিটি নিয়ে সমস্যা থাকে। সুপার ইগো মানুষকে নৈতিকতাকে রক্ষা করার চেষ্টা করে।
হ্যারী হুডিনির সুপার ইগোও বারবার হতবিহবল হয়ে পড়তো তার ক্ষমতা, অর্থ, সম্পত্তির প্রতি আকাঙ্ক্ষার সামনে। সুপার ইগোর আরেকটি দূর্বলতা বোঝা গিয়েছিল পারিবারিক গোরস্থানে নিজের খোদাই করা চিত্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যে; কারণ সেটা ধর্মীয়ভাবে অনুমোদিত ছিল না!
আবার এটাও ঠিক মাঝে মাঝে তার বিবেকবোধ অতিরিক্ত জাগ্রত হতো। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে স্পিরিচুয়ালিজম, মৃতের সাথে কথোপকথন, প্যারাসাইকিক ক্ষমতা প্রভৃতি বিষয়ে তার প্রচন্ড আগ্রহ ছিল। এসব নিয়ে ব্যাপক পড়ালেখা করতেন, জানার চেষ্টা করতেন।
একসময় বুঝতে পেরেছিলেন এসবের নামে যা দেখানো হচ্ছিল সেগুলো ছিল লোক ঠকানো ধোঁকাবাজি! ক্যারিয়ারের পরের দিকে এই সব ধোঁকাবাজির মুখোশ উন্মোচনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। ছদ্মবেশে গিয়ে তাদের ধোঁকাবাজি ধরে ফেলতেন।
এইসব কৌশল নিয়ে লেখালিখিও করতেন। এমনকি বিজ্ঞান ব্যখ্যা করতে পারে না এমন কোনো ঘটনা কেউ ঘটাতে পারলে দশহাজার পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। যদিও কেউ তার সামনে এরকম ঘটনা ঘটাতে পারেনি শেষ পর্যন্ত!
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তিনিও আসলে এরকম কৌশল ব্যবহার করতেন। নতুন কোন শহরে গিয়ে পারফর্ম করার আগে সিমেট্রিতে গিয়ে খোঁজ নিতেন কে মারা গিয়েছে সম্প্রতি! পরের শোয়ে তাদের নিয়ে কথা বলে দর্শকদের বিস্মিত করতেন।
যদিও এই কাজের জন্য আজীবন অনুতাপ ছিল তার। পরবর্তী জীবনে অনেকের কাছে চিঠি লিখে সব স্বীকার করে নিয়ে ক্ষমাও চেয়েছিলেন। হয়ত এই অপরাধবোধ তাকে অলৌকিকতা বা সাইকিক পাওয়ারের নাম মানুষের সাথে করা বিভিন্ন ধোঁকাবাজির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।
১৯২৬ সালের ২২ অক্টোবর, গর্ডন হোয়াইটহেড নামক জনৈক ব্যক্তি তার পেটে সজোরে ঘুষি চালালে প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হয়। পরবর্তীতে হাসপাতালে ভর্তি হলে ধরা পড়ে বার্স্ট এপেনডিক্স! তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল সেরে উঠবেন।
কিন্তু ৩১ অক্টোবর পেরিটনাইটিসের জটিলতা নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন এই কিংবদন্তি। মৃত্যুর সময় তার শেষ কথা ছিল- ‘আমি যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত! আর যুদ্ধ করতে চাইনা!’
সূত্র : মাসিক মনের খবর মার্চ ২০২২ সংখ্যা
- মাসিক মনের খবর প্রিন্ট ম্যাগাজিন সংগ্রহ করতে চাইলে কল করুন : 01797296216 এই নাম্বারে। অথবা মেসেজ করুন পেজের ইনবক্সে। লেখা পাঠাতে পারেন monerkhaboronline@gmail.com বা এই 01844618497 হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে।
/এসএস/মনেরখবর/
/এসএস/মনেরখবর/