Attachment Parenting(AP) বিষয়টি অপেক্ষাকৃত নতুন একটি ধারণা। Attachment শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হল ভালোবাসা, সংযুক্তি, মমতা, টান, প্রণয়, অনুরাগ ইত্যাদি। Attachment Parenting এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেন বিখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ William Sears এবং তার স্ত্রী Martha Sears। Attachment Parenting হল সন্তান প্রতিপালনের একটি দর্শন যেটা বিকাশ মনোবিজ্ঞানের Attachment Theory এর উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। John Bowlby ১৯৬৯ সালে বিকাশ মনোবিজ্ঞানে Attachment Theory প্রদান করেন; তার তত্ত্বে তিনি বলেন যে, শিশুরা তাদের প্রথম দু-এক বছর অন্য ব্যক্তির সংস্পর্শে বা খুব কাছাকাছি থাকতে চায় এবং সেই ব্যক্তি তার কাছে থাকলে সে নিরাপদ অনুভব করে।
AP অনুসারে, শৈশবে শিশুরা তাদের কেয়ার গিভারদের সাথে একটি শক্তিশালী আবেগীয় বন্ধন তৈরি করে যা সারা জীবনব্যাপী ব্যক্তির জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। Attachment Parenting এর খুব কাছাকাছি আরো কিছু বিষয় হল Empathetic Parenting, Natural Parenting ইত্যাদি।
William Sears এবং Martha Sears এর মতে, AP এর মূলকথা হল বাচ্চাদের বা সন্তানের বিভিন্ন সংকেতকে দ্রুত বুঝতে পারা এবং তদানুযায়ী প্রতিক্রিয়া করা বা সাড়া দেওয়া। AP হল বাচ্চা বা শিশুকেন্দ্রিক (child centered), পিতা মাতা কেন্দ্রিক নয়। যেমন ধরুণ আমেরিকান সমাজে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়ার ক্ষেত্রে পিতামাতা জোর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কিন্তু তখন তাদের সন্তানদের ঘুম পাচ্ছে কিনা সেটা তারা গুরুত্ব দেননা। আবার ইতালিয়ানরা তাদের সন্তানদের তখনই ঘুমাতে পাঠান যখন তাদের ঘুম পায়। ইতালিয়ান বাবা মায়ের কাছে তাদের সন্তানের ঘুম ঘুম ভাব একটা সংকেত হিসেবে কাজ করে। তারা যখন এই সংকেত দেখতে পান তখন তারা সেই সংকেতের প্রতি সাড়া দেন। এক্ষেত্রে বলা যায় সন্তানদের ঘুমাতে পাঠানোর ক্ষেত্রে ইতালীয় বাবা মায়েরা শিশুকেন্দ্রিক তত্ত্বকে অনুসরণ করেন।
পিতামাতারা তাদের শিশুদের প্রতিপালন করতে গিয়ে তাদের বেশ বেগ পেতে হয়। যেমন ধরি বাচ্চা যখন কান্না করছে, জিদ করছে, রাগ করছে, কষ্ট পাচ্ছে, ভয় পাচ্ছে ইত্যাদি। এগুলো হল শিশুদের কিছু নেতিবাচক আবেগ। সাময়িকভাবে এগুলো শিশুদের মধ্যে দেখা দিতে পারে এবং সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু যদি শিশু এধরনের নেতিবাচক আবেগের সম্মুখীন হয় এবং পিতামাতা যদি দ্রুত তাদের এসব নেতিবাচক আবেগগুলো প্রশমিত করার চেষ্টা না করেন তবে শিশুদের উপর ভীষণ শারীরিক ও মানসিক চাপ অনুভূত হয়, তাদের সুস্থ্য বা স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়, তাদের মস্তিষ্কে বড় আকারের ক্ষতি সাধিত হয়। (Sears and Sears, 2001)
Attachment Parenting এমন একটি প্যারেন্টিং প্রাকটিস যেটা শিশুদের এসব স্ট্রেস বা চাপ কমাতে সাহায্য করে এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। সবচেয়ে বড় উপকারীতা হল শিশুদের নেতিবাচক আবেগীয় অবস্থার দ্রুত প্রশমন ঘটানো। শিশুদের ক্ষেত্রে Attachment Parenting বলতে কয়েকটি বিষয়কে বোঝানো হয়; যেমনঃ একত্রে ঘুমানো, শিশুর চাহিদামত মায়ের বুকের দুধ পান করানো, বেশি বেশি শারীরিক সংস্পর্শে রাখা, শিশু যখন কোনো কিছুর জন্য কান্না করে তখন দ্রুত তাদের দিকে নজর দেওয়া এবং দ্রুত সাড়া দেওয়া, জন্মের পরের কয়েক ঘন্টা যেন মায়ের পাশে থাকতে পারে সেদিকে জোর দৃষ্টি রাখা কারণ এই সময়ে মায়ের সাথে শিশুর যে বন্ধন গড়ে ওঠে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। Attachment Parenting এর মূল লক্ষ্য হল শিশুরা যাতে কম নেতিবাচক আবেগীয় অবস্থার সম্মুখীন হয় যাতে তাদের মস্তিষ্কের বিকাশ ভালোভাবে হতে পারে এবং মানসিক ভাবে সুস্থ্য স্বাভাবিক হতে পারে।
Attachment Parenting এ পিতামাতারা যে তাদের শিশুদের নেতিবাচক আবেগের সম্মুখীন কম করানোর চেষ্টা করেন সেটা মূলত কার্যকরী হয় পিতামাতার সংবেদনশীলতার মাত্রার উপর। বুকের দুধ না খাইয়ে কৌটার দুধ খাওয়ালে বা একই বিছানায় সন্তানকে না রেখে একই ঘরে ভিন্ন বিছানায় ঘুমালে তারা যে উচ্চ সংবেদনশীল থাকছেন না সেটা বলা যাবেনা। এগুলো করার পরও একজন মাতা উচ্চ সংবেদনশীল হিসেবে গন্য হতে পারেন। এই প্যারেন্টিং স্টাইল অনুসরণ করলে সন্তানেরা তাদের সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যেমনঃ তাদের রাগ, ভয়, যন্ত্রণাদায়ক অবস্থা, বেদনা ইত্যাদি। শিশুর সাথে তার কেয়ার গিভার এর সম্পর্ক ভালো না হলে তাদের মাঝে নানা ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমনঃ বিষন্নতা, উদ্বেগ ইত্যাদি। তবে পিতামাতা বা কেয়ার গিভারের সাথে শিশুর বন্ধন ভালো হলে তারা তাদের সংস্পর্শে নিরাপদ অনুভব করে। শিশুদের বিভিন্ন সংকেতের প্রতি সংবেদনশীল থাকলে; যেমন কান্না করলে দ্রুত সাড়া দেওয়া, দুধ খাওয়ার জন্য কান্না করলে দ্রুত দুধ খেতে দিলে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ভালো হয় এবং শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ভালো হয়।
Attachment Parenting এর আর একটি উপকারিতা হল Secure attachment। অর্থাৎ এসব শিশুরা তাদের পিতামাতা বা কেয়ার গিভার এর সংস্পর্শে বড় ধরনের সমস্যার সমাধান করতে পারে। তাদের বিভিন্ন নেতিবাচক আবেগের সময় তারা তাদের কেয়ার গিভার এর কাছাকাছি থাকলে ভালো অনুভব করে। এছাড়া এসব শিশুরা তাদের স্কুলের পরিবেশে নিজেদের সহজে মানিয়ে নিতে পারে।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।