একবছরে ৫৩২ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ৪৪৬ : আঁচল

বিদায়ী বছরে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫৩২ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এরমধ্যে শুধুমাত্র স্কুল-কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থী ৪৪৬ জন। বাকীরা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের। চাঞ্চল্যকর এ তথ্য উঠে এসেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণায়।

বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত আত্মহত্যার খবর ও অন্যান্য তথ্য বিশ্লেষণ করে এ পরিসংখ্যান জানিয়ে আজ শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়েছে সংগঠনটি।

এর আগে শুক্রবার ‘স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা; সমাধান কোন পথে’ শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে ‘আঁচল ফাউন্ডেশন’। সংবাদ সম্মেলনে অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক তাহমিনা ইসলাম এবং চট্টগ্রামের মনোসামাজিক সহায়তা কেন্দ্র সেরেনিটি’র পরামর্শক মনোবিজ্ঞানী, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট শাহরিনা ফেরদৌস।

সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন আঁচল ফাউন্ডেশনের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ইউনিটের টিম লিডার ফারজানা আক্তার।

সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ জানান, দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে তারা আত্মহত্যা–সংক্রান্ত সমীক্ষাটি করেছেন। এতে স্কুল-কলেজের ৪৪৬ শিক্ষার্থী ছাড়াও ৮৬জন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে আত্মহত্যা মোকাবিলা করতে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ বাড়ানো; সন্তানদের মানসিক বিকাশ এবং তাদের কথা সহানুভূতির সঙ্গে শুনতে ও বুঝতে অভিভাবকদের জন্য প্যারেন্টিং কার্যক্রম চালু করা; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষক-কর্মচারীদের আচরণ ও পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ণে কৌশলী ও সহানুভূতিশীল হতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা; স্কুল, কলেজপর্যায়ে আত্মহত্যা প্রতিরোধী পোস্টার প্রদর্শন করা; প্রেম-প্রণয় ঘটিত সম্পর্কে বা অজ্ঞাতসারে ধারণ করা গোপন ছবি, ভিডিও ইত্যাদি প্রচার তথা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ ও সাইবার অপরাধের বিষয়ে শাস্তি উল্লেখ করে বিশেষ প্রচারণাভিযানসহ ১১ দফা সুপারিশ করা হয়।

গবেষণা বলছে, গত বছর আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বড় একটি অংশ (২৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ) এই পথ বেছে নিয়েছে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মান-অভিমানের কারণে। ২৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন অভিমানের করে। এ ছাড়া প্রেমঘটিত কারণে ২৩ দশমিক ৩২ শতাংশ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। আবার আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ায় ৪ জন, শিক্ষকের মাধ্যমে অপমানিত হয়ে ৬, গেম খেলতে বাধা দেওয়ায় ৭, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ২৭ জন আত্মহত্যা করেছে। এ ছাড়া মুঠোফোন কিনে না দেওয়ায় ১০ জন, মোটরসাইকেল কিনে না দেওয়ায় ৬ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।

জানা যায়, ২০২২ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৩৭ জন স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। শুধুমাত্র স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৩.৯০ শতাংশ তথা ২৮৫ জন নারী এবং পুরুষ ১৬১ জন তথা ৩৬.১ শতাংশ।

অন্যদিকে শুধু স্কুলগামী ৩৪০জন শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মহত্যাকারী নারী শিক্ষার্থীর পরিমাণ ৬৫.৩০ শতাংশ   এবং পুরুষ শিক্ষার্থী ৩৪.৭০ শতাংশ। শুধু কলেজ পড়ুয়া ১০৬ শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মহননকারী নারী ৫৯.৪৪ শতাংশ এবং পুরুষ ৪০.৫৬ শতাংশ রয়েছে। এদের মধ্যে মাদরাসা শিক্ষার্থী ৫৪জন।

এরমধ্যে জানুয়ারিতে ৩৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৯ জন, মার্চে ৪১ জন, এপ্রিলে ৫০ জন, মে মাসে ৪৫ জন, জুনে ৩১ জন, জুলাইয়ে ৪০ জন, আগস্টে ২১ জন, সেপ্টেম্বরে ৩২ জন, অক্টোবরে ৩০ জন, নভেম্বরে ৪৯ জন এবং সবশেষ ডিসেম্বরে ৩৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। অর্থাৎ সর্বোচ্চ সংখ্যাক ৫০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন এপ্রিল মাসে।

আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে বিভাগওয়ারী হিসাবে ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ২৩.৭৭ শতাংশ, এরপর রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে ১৭.২৭ শতাংশ এবং রাজশাহী বিভাগ যা ১৬.৮১ শতাংশ। এ ছাড়া খুলনা বিভাগে ১৪.১৩ শতাংশ, রংপুরে ৮.৭৪ শতাংশ, বরিশালে ৮.৫৩ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৬.২৭ শতাংশ এবং সিলেটে ৪.৪৮ শতাংশ স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থী রয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক তাহমিনা ইসলাম বলেন, ‘‘শিক্ষার্থীদের এ আত্মহত্যার তথ্যের মধ্য দিয়ে সচেতন সমাজের কাছে বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে শিক্ষার্থীরা ‘সাফার’ করছে। এ জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ব্যবস্থা থাকা দরকার, যেখানে বা যার কাছে শিক্ষার্থীরা তাদের কষ্টের কথাগুলো বলতে পারে। কেননা, আত্মহত্যার আগে শিক্ষার্থীরা প্রচণ্ড মানসিক কষ্টে থাকে। ওই সময় কোনো শিক্ষকের কাছে কষ্টের কথা বলার সুযোগ পেলে আত্মহত্যার প্রবণতা কমবে। এ ছাড়া মা–বাবা হিসেবে সন্তানকে সময় দেওয়া এবং তাদের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার প্রতিও জোর দেন তিনি।’’

ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট শাহরিনা ফেরদৌস সংবাদ বলেন, ‘‘চকলেট, জুসসহ শিশুরা যখন যা চায়, তখনই তা কিনে দিলে শিশুরা ধৈর্য ধারণ করতে শেখে না। পরবর্তী সময় তারা কিছু চেয়ে না পেলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তাই ইতিবাচকভাবে সন্তান লালন–পালনের প্রতি জোর দিয়ে তিনি বলেন, সন্তানকে যেকোনো পরিবেশে টিকে থাকা শিখাতে হবে ছোটোবেলা থেকেই।’’

/এসএস/মনেরখবর/

Previous articleদশ বছরে মনোচিকিৎসক মোহিত কামাল সম্পাদিত ‘শব্দঘর’
Next articleমানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মাধ্যমিকে ১২৮ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ কর্মসূচি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here