চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ (Early Childhood Development)। একটি “শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ” শুরু হয় শিশুটি মায়ের গর্ভে আসার পরপরই অর্থাৎ শুক্রাণু ও ডিম্বাণু নিষেকের পর ভ্রুন অবস্থায়। মাতৃগর্ভে প্রথম ৩ সপ্তাহের মধ্যে শিশুর মস্তিষ্ক তথা স্নায়ুতন্ত্র গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। গর্ভাবস্থায় প্রথম ২০ সপ্তাহেই এই মস্তিষ্কের ওজন হয় ১০০ গ্রাম। শিশুর ‘মস্তিষ্কের বিকাশ’ গর্ভের শিশুটির মস্তিষ্কের কোষ বা নিউরন ও নিউরনগুলোর মধ্যকার ‘আন্তঃসংযোগ’ (Connection/Synapse) এর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। যদিও “শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ” গর্ভাবস্থায় শুরু হয় কিন্তু নিউরনের মধ্যকার ‘আন্তঃসংযোগ’ প্রক্রিয়া জন্মের পর শুরু হয়ে প্রথম ৫ বছরেই শেষ হয়ে যায়।
একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কের ওজন ১৩০০-১৪০০ গ্রাম। এই ওজনের শতকরা ৩০ ভাগই জন্মের আগেই অর্জিত হয়। অর্থাৎ একটি স্বাভাবিক ওজনের নবজাতকের মস্তিষ্কের ওজন থাকে প্রায় ৪০০ গ্রাম। একটি পূর্ণবয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কের প্রায় ৮৫% ভাগ ৩ বছর বয়সেই তৈরি হয়ে যায়, অর্থাৎ ৩ বছর বয়সে মস্তিষ্কের ওজন থাকে প্রায় ১১০০ গ্রাম। মোটকথা, পূর্ণবয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কের ওজনের প্রায় বেশীর ভাগই ৩ থেকে ৫ বছর বয়সের মধ্যে অর্জিত হয়। এরপর মস্তিষ্কের ওজন বাড়ে শুধু ফ্যাট বা চর্বির কারণে। শিশুর মস্তিষ্কের নিউরনের সংখ্যা বাড়ানোর সবচেয়ে একটি বড় সুযোগ হল গর্ভাবস্থায় মায়ের নিয়মিত পরিচর্যা করা।
গর্ভাবস্থার ২য় ও ৩য় পর্যায়ে নিউরনগুলো আকারে বড় হয়, আস্তে আস্তে মাথার অংশে জমা হয়ে থাকে এবং অল্প মাত্রায় বিকশিত হতে শুরু করে। মস্তিষ্কের আবরণ জন্মের পর তৈরি হয়। গর্ভাবস্থার ৬ সপ্তাহ থেকে ৫ মাসের মধ্যে মানব মস্তিষ্কে প্রায় ১০০ বিলিয়ন নিউরন থাকে। জন্মের আগে এই নিউরনগুলো একে অপরের সাথে যুক্ত থাকে না। জন্মের পর থেকে প্রথম ৩ বছর সর্বোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত নিউরনগুলো একে অপরের সাথে অবিরাম যুক্ত হতে থাকে, যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ‘সিনেপস’ (Synapse) বা সহজ কথায় ‘আন্তঃকোষীয় সংযোগ’ (Connection) বলা হয়। জন্মের সময় এই ১০০ বিলিয়ন নিউরন ৫০ ট্রিলিয়ন পর্যন্ত ‘সংযোগ’ তৈরি করতে পারে। একটি নিউরন সর্বোচ্চ ১৫০০ টি পর্যন্ত ‘সংযোগ’ তৈরি করতে পারে। ৩ বছর বয়সের মধ্যেই প্রায় ১০০০ ট্রিলিয়ন ‘সংযোগ’ তৈরি হয়। এই ‘সংযোগ’গুলো একটি ‘স্নায়বিক নেটওয়ার্ক’ তৈরি করে যেটা “শিশুর শিক্ষা” এবং “মানসিক বিকাশে” নিয়োজিত থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, যে ‘সংযোগ’গুলো জন্মের পর বারবার ব্যবহৃত হয় সে ‘সংযোগ’গুলো দীর্ঘকাল টিকে থাকে এবং যেগুলো অব্যবহৃত থাকে সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ১১ বছর বয়স থেকে মস্তিষ্ক তার অব্যবহৃত অতিরিক্ত ‘সংযোগ’ থেকে মুক্ত হয় এবং সাধারনত ১৪ বছর বয়সে শিশুকালের (৩-৫ বছর বয়সকালীন) ১০০০ ট্রিলিয়ন ‘সংযোগ’এর মধ্যে মাত্র ১০০ ট্রিলিয়ন ‘সংযোগ’ টিকে থাকে।
‘বুদ্ধি’ হচ্ছে মস্তিষ্কের ‘আন্তঃকোষীয় সংযোগ’এর মাধ্যমে নিউরন থেকে নিউরনে ইলেকট্রনের অনুরণন মাত্র। একজন মানুষের দেহে ৮০,০০০ ‘জিন’ বা ‘বংশগতির বাহক’ থাকে। তার অর্ধেক ‘জিন’ই শিশুর স্নায়ুতন্ত্র তথা মস্তিষ্ক গঠনে জড়িত। গর্ভে নিষিক্ত ডিম্বাণুর প্রথম বিভাজন থেকে শুরু করে মস্তিষ্কের পূর্ণবিকাশ পর্যন্ত কোষে অবস্থিত ‘জিন’ (বংশগতির বাহক) এবং ‘পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত উদ্দীপনা’র মধ্যে সূক্ষ্ম মিথস্ক্রিয়া চলতে থাকে। সুতরাং মস্তিষ্কের পূর্ণবিকাশ শুধুমাত্র ‘জিন’ এর কারসাজি নয়, এখানে পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত উদ্দীপকও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সব কটা জানালা খুলে দাও না!
একটি শিশু ‘পরিবেশ থেকে যত বেশী উদ্দীপনা’ পায় তত বেশি তার মনের ‘জানালা’ খুলে যায়। যেমন জন্মের আগে গর্ভাবস্থার ৫ মাস বয়স থেকেই সন্তান কানে শুনতে পায়, আর মা যদি কোন কিছুতে ভয় পায় সেক্ষেত্রে গর্ভের বাচ্চাও শিহরে উঠে। জন্মের পর একটি বাচ্চা বাবা-মা, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, নানা-নানী ও আত্মীয়-স্বজন থেকে যত বেশী অনুভূতি বা অনুপ্রেরণা পায় (হতে পারে রঙিন কোন খেলনার আওয়াজ বা স্রেফ তালি, আদর কিংবা নিছক কোন কেচ্ছা/ছড়া) তার মস্তিষ্কের ‘সংযোগ’ তত বেশী খুলে যায়। এখানে মস্তিষ্কের নিউরনের ‘আন্তঃকোষীয় সংযোগ’কেই মনের ‘জানালা’র সাথে তুলনা করা হয়েছে। আর সর্বোচ্চ ৫ বছর বয়স পর্যন্ত এই ‘জানালা’ খোলার খেলা চলতে থাকে। এই ৩ থেকে ৫ বছর বয়সেই নির্দিষ্ট হয়ে যায় শিশুটি বড় হয়ে ডাক্তার হবে না ইঞ্জিনিয়ার হবে, ধার্মিক হবে না জঙ্গি হবে। সবটুকুই যদি ‘জিন’ এর কারণে হত তাহলে ডাক্তার বাবা-মার সব ছেলে মেয়েই ডাক্তার হত। সুতরাং শিশুটি ভবিষ্যতে কি হবে তা নির্ভর করে জন্মের প্রথম ৩ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত ‘পরিবার তথা পরিবেশ থেকে কি অনুপ্রেরণা’ পেল তার উপর। অনেকসময় দেখা যায় শুধুমাত্র এই বয়সে ‘সঠিক অনুপ্রেরণা’ পাবার কারণে গরীব রিকশাওয়ালার দত্তক দেয়া সন্তান ইউরোপের কোন এক দেশের এমপি। শিশু মেধা বিকাশে অল্প বয়সে সঠিক ‘অনুপ্রেরণা’ দেবার পাশাপাশি দু’টি কথা না বললেই নয়- প্রথমত: গর্ভাবস্থায় মায়ের নিয়মিত ‘চেক-আপ’ এবং দ্বিতীয়ত: জন্মের পর থেকে ২ বছর পর্যন্ত ‘মায়ের বুকের’ দুধ নিশ্চিত করা।
[তথ্যসূত্র: Students’ Hand Book IMCI & Module on Early Childhood Development for Postgraduate Medical Students]
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।