ডা. এস এম আতিকুর রহমান
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর মধ্যে সমাজ স্বীকৃত বন্ধনটির নাম হলো বিয়ে। বিয়ের মাধ্যমে দুটি জীবনের সমন্বয় হয়। তা সে পরস্পরের পরিচিত হোক আর অপরিচিত হোক। বিয়ে করে তারা দুজনে একটি সম্মিলিত জীবন শুরু করে। সে জীবন সুখে পরিপূর্ণ হতে পারে আবার নাও হতে পারে। সম্প্রতি The Daily Star এর একটি রিপোর্টে এসেছে-গত দশ বছরে দেশে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেড়ে গিয়েছে।
বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য যতগুলো আবেদন করা হয় তার শতকরা পঁচানব্বই ভাগই কার্যকর হয়। ৬৫% আবেদন আসে নারীদের কাছ থেকে। যে কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ চাওয়া হয় তার একটি বড়ো কারণ মনোমালিন্য বা মানসিক দিক থেকে বনিবনা না হওয়া। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা তিরিশ ভাগ বিবাহ বিচ্ছেদ মনোমালিন্যের কারণে হয়। তাই নতুন বিবাহিতদের জন্য নারী-পুরুষের সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিয়ের পর নিজেকে তৃপ্ত না মনে হলে অথবা সঙ্গীকে সুখী না মনে হলে সেই মনে হওয়াটাকে অস্বীকার না করে বরং চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
আপাতদৃষ্টিতে কারণ যত তুচ্ছই হোক, বলা যায় না ঐ তুচ্ছ কারণই হয়ত একদিন আপনাদের দুজনকে আলাদা করে দেবে। আমেরিকার টেক্সাস ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ডক্টর টেড হিউসটনের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ১৫৬ জন নববিবাহিত দম্পতি বিয়ের তেরো বছর পরে ৬৮ জন দাম্পত্য জীবনে সুখী হয়। ৩২ জন অসুখী হয়। ৫৬ জনের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। হিউসটনের মতে নববিবাহিতদের দাম্পত্য সম্পর্কের ভবিষ্যত কী হবে তা বিয়ের প্রথম দুই বছরের মধ্যে বোঝা যায়।
যদিও বিয়ের পর পরই সময়টা ঘোরের মধ্যে কেটে যায় যাকে হানিমুন ফেজ বলে। তবে দ্বিতীয় বছরের শেষের দিকে শুরু হয় পাওয়ার স্ট্রাগল বা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। বেশিরভাগ দাম্পত্য সম্পর্ক এই স্তরে এসে আটকে যায়। অনেক সম্পর্ক বিবাহ বিচ্ছেদে রূপ নেয়। আবার অনেক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতা ছাড়াই একরকম টিকে থাকে আপসের মধ্যে দিয়ে।
হানিমুন ফেজের শেষের দিকটায় যে বিষয়গুলোতে আপনি সতর্ক হতে পারেন:
- রোমান্স এবং ঘনিষ্ঠতার অভাব বোধ
- একসঙ্গে মজা করতে না পারা
- স্বার্থপরতা
- মনোমালিন্যের ভয়
- শ্রদ্ধাবোধের ঘাটতি
- অতিমাত্রায় প্রতিশ্রুতি
- অতিমাত্রায় ব্যয়
- অভিভাবকের প্রতি অতি মাত্রায় নির্ভরশীলতা
- যৌন সমস্যা
- মাদকাসক্তি
- অবাস্তব প্রত্যাশা
- মানসিক অথবা শারীরিক নির্যাতন
- দুজনের মধ্যে অতিরিক্ত বয়সের পার্থক্য
- ভুল কারণে বিয়ে
রোমান্স এবং ঘনিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন হয় আবেগের। তীব্র আকর্ষণবোধ বা প্যাশন এবং ঘনিষ্ঠতার সংমিশ্রণে সম্পর্ক রোমান্টিক হয়ে ওঠে। ঘনিষ্ঠতা বা ইনটিমিসি হলো পরস্পরের মধ্যে শেয়ারিং। এই শেয়ারিংয়ের তিনটি দিক আছে। প্রথমত, কগনিটিভ বা চিন্তা চেতনার শেয়ারিং।
দ্বিতীয়ত, ইমোশন্যাল বা আবেগীয় শেয়ারিং। তৃতীয়ত, ফিজিক্যাল বা শারীরিক শেয়ারিং। এই শারীরিক শেয়ারিংয়ের আবার দুইটি পর্ব-প্রথমটি, অযৌন ভালোবাসাপূর্ণ স্পর্শ যেমন হাত ধরা, পায়ে পা ছোঁয়ানো, জড়িয়ে ধরা, চুমু খাওয়া ইত্যাদি। দ্বিতীয়টি, যৌন মিলন। কনজামশন অব ম্যারেজ বা বিয়ের আত্তীকরণের জন্য যৌন মিলন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যৌন মিলন না হলে বিয়ে সিদ্ধ হয় না।
নব বিবাহিতদের ক্ষেত্রে কয়েকটি কারণে যৌন সমস্যা দেখা দিতে পারে। পুরুষের দিক থেকে: লিঙ্গের উত্থানজনিত সমস্যা, মিলনের পূর্বেই বীর্যপাত হয়ে যাওয়া নারীর দিক থেকে: যোনীচ্ছদ পর্দা টাইট হলে, ব্যথা বা ব্লিডিং সংক্রান্ত তীব্র ভয় থাকলে আসন সংক্রান্ত: অনভিজ্ঞতার কারণে সুবিধাজনক আসন বুঝতে না পারা গুড এনাফ সেক্স মডেল অনুসারে, মানুষ যে পাঁচটি কারণে শারীরিকভাবে মিলিত হয় সম্পর্কের পূর্ণতা প্রাপ্তি তার মধ্যে অন্যতম। প্রজনন, জৈবিক তাড়না, লৈঙ্গিক আত্মবিশ্বাস ও আনন্দ একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মানুষের মধ্যে কাজ করে।
শরীরে হরমোনের আধিক্য কমে এলে জৈবিক তাড়নাও কমে আসে। কাঙ্ক্ষিত সন্তান-সন্ততির পর প্রজননের উদ্দেশ্যেও আর যৌন মিলনের দরকার হয় না। লৈঙ্গিক আত্মবিশ্বাস ও আনন্দও দীর্ঘস্থায়ী কোনো চাওয়া নয়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের এই চাওয়াগুলোতে পরিবর্তন আসে। সম্পর্ক উপভোগের চাহিদাটা থেকে যায়। পারিবারিক জীবনে যৌনতা উপভোগের প্রণোদনা হিসেবে সম্পর্কের পূর্ণতা প্রাপ্তি তাই ভূমিকা রাখে।
নতুন দম্পতিদের যা মনে রাখা প্রয়োজন:
- আপনার বা আপনার সঙ্গীর অসন্তুষ্টিকে গুরুত্ব দিন।
- অসন্তুষ্টির কারণ চিহ্নিত করুন।
- নিজেদের মধ্যে কথা বলা বাড়ান।
- যৌনতা ছাড়াও পরস্পর পরস্পরকে স্পর্শ করুন।
- যৌনতা নারী-পুরুষের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
- যৌনসমস্যা কাটিয়ে উঠতে কাউন্সেলিং সেবা নিন।
- প্রথম দুই বছরই আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়। যৌনতাকে বিচ্ছিন্নভাবে ভোগ না করে সম্পর্কের মধ্য দিয়ে উপভোগ করুন। পরস্পরের সাথে অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলুন।