ডা. মুনতাসীর মারুফ
সহকারী অধ্যাপক
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।
বাইপোলার ডিজঅর্ডার আবেগজনিত একটি মানসিক রোগ। নারী—পুরুষ উভয়ই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। যাদের নিকটাত্মীয়ের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস আছে, তাদের ক্ষেত্রে এ রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। অর্থাৎ, মানসিক অন্যান্য অনেক রোগের মতোই এ রোগের সাথেও জেনেটিক প্রভাবের সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের গবেষকদলের জরিপ অনুয়ায়ী, বাংলাদেশে ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সিদের শতকরা ০.৪ ভাগ অর্থাৎ প্রতি হাজারে ৪ জন এ ধরনের রোগে আক্রান্ত।
এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আবেগের দুটি পর্যায় থাকে। একটি পর্যায় হচ্ছে ম্যানিয়া বা হাইপোম্যানিয়া। ম্যানিয়া পর্যায়ে ব্যক্তিরা অস্বাভাবিক আনন্দ—ফূর্তি অথবা বিরক্ত বোধ করেন, নিজেকে অতি বিত্তশালী বা ক্ষমতাবান মনে করেন, স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কথা বলেন। তাদের মধ্যে অতি উত্তেজনা বা অতিরিক্ত কাজের স্পৃহা দেখা দেয়। কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে বা কথায় স্থির থাকতে পারেন না। বেশি খরচ করেন অথবা দান করেন। ঘুম কমে যায়। অনেকের যৌন আগ্রহ অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। কিন্তু আক্রান্তরা নিজেদেরকে স্বাভাবিক মনে করেন। তাদের আচরণের অস্বাভাবিকতা অন্যদের চোখে ধরা পড়ে। এসব উপসর্গ টানা সাতদিনের বেশি থাকলে একে ম্যানিয়া পর্যায় বলা হয়। উপসর্গের তীব্রতা ও স্থায়িত্ব কম হলে একে হাইপোম্যানিয়া বলা হয়। বাইপোলার ডিজঅর্ডারে আবেগের অন্য পর্যায়টি বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন। অনেকের ক্ষেত্রে শুধু ম্যানিয়া পর্যায়টিই দৃশ্যমান হয়, বিষণ্ণতার পর্যায়টি বোঝা না—ও যেতে পারে। কারো ক্ষেত্রে সারা জীবনে হয়ত দু—এক বার ম্যানিয়া পর্যায়টি দেখা দিতে পারে, কারো ক্ষেত্রে কয়েক বছর পর পর বা বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এটি হতে পারে। তবে, এর বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা রয়েছে। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে আবেগের অবস্থাটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।
অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের কারণে অনেকেই এই সমস্যাটিকে মানসিক রোগ বলে মানতে চান না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কহীন মানুষ তো বটেই, অনেক চিকিৎসক, এমনকি মানসিক রোগ ছাড়া অন্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মাঝেও এ রোগ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। তবে, সর্বপ্রকার রোগ বিষয়ক আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রেণীবিভাগ ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ (আইসিডি)’ অনুযায়ী বাইপোলার ডিজঅর্ডার একটি মানসিক রোগ।
অনেকে মনে করেন, এ ধরনের সমস্যায় ওষুধের কোন প্রয়োজন নেই, ঝাঁড়ফুঁকই এর চিকিৎসা। এক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত গবেষণালব্ধ প্রমাণ এবং এনআইসিই (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ এন্ড কেয়ার এক্সিলেন্স), ইংল্যান্ডের গাইডলাইন অনুযায়ী ওষুধই এ রোগের প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতি। রোগ তীব্র হলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি রেখেও চিকিৎসা করাতে হতে পারে। তবে রোগের বিশেষ পর্যায়ে কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু ধরনের সাইকোথেরাপি প্রয়োজন হতে পারে।
কারো কারো ধারণা, বাইপোলার ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত রোগীরা অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত ও মেধাবী হয়ে থাকেন। এ ধারণার স্বপক্ষে গবেষণালব্ধ কোনো প্রমাণ নেই। যেকোনো শ্রেণী—পেশা—বুদ্ধিমত্তার মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। বিখ্যাত কয়েক ব্যক্তি এ রোগে আক্রান্ত হওয়ায় এ ব্যাপারে ভুল ধারণা সৃষ্টি হতে পারে। রোগীদের রোগের কারণে বহির্মুখী, দানশীল, আত্মবিশ্বাসী ও অতিরিক্ত সক্রিয় ভূমিকাও এ ধারণা তৈরি করতে পারে। পরিবারে বা বংশে কারো বাইপোলার রোগ থাকলে ব্যক্তির একই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। বাইপোলার রোগাক্রান্ত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়দের বাইপোলার ও ইউনিপোলার উভয় রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাই বৃদ্ধি পায়।
তবে, এ রোগে আক্রান্ত হওয়া মানেই রোগী স্বাভাবিক কাজের অনুপযুক্তÑএ ধারণাও ঠিক নয়। সঠিক চিকিৎসায় এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রেখে রোগী তার বুদ্ধিমত্তা ও প্রতিভা অনুযায়ী সফলতা পেতে পারেন। তবে, রোগীর অবস্থা অনুযায়ী তার জন্য বাস্তবভিত্তিক ভবিষ্যত লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগেও, নিমিষেই সকল তথ্য হাতে পাওয়ার অপার সুযোগের এই সময়েও মানসিক রোগ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার চলমান ধারা খুবই দুঃখজনক। সকলের মাঝে মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতনতা জাগ্রত হোক, সকল নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, কুসংস্কার, জড়তা কাটিয়ে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা সুচিকিৎসা লাভে সচেষ্ট হোন— প্রত্যাশা এটাই।