ডা. হোসেনে আরা
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
আদ-দ্বীন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।
মানসিক স্বাস্থ্যের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হলো আবেগ। আবেগ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। জীবনে সফলতার জন্য আবেগের সুষ্ঠু প্রকাশ এবং নিয়ন্ত্রণ অতীব জরুরি। এই আবেগকে সাধারণত দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়, ইতিবাচক আবেগ (আদর, ভালোবাসা, মায়া, মমতা, সুখ, আনন্দ ইত্যাদি) এবং নেতিবাচক আবেগ (রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, কষ্ট ইত্যাদি)। এই আবেগগুলো স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে, কেননা যেকোনো মানুষ তার চিন্তার বহিঃপ্রকাশ করে আবেগের মাধ্যমে। এই আবেগের কারণে আমরা মিলেমিশে বাস করি। আবেগের এই ভিন্নতার (আনন্দ, দুঃখ, ভয়, উত্তেজনা ইত্যাদি) কারণে আমাদের জীবন উপভোগ্য হয়, আবার এই আবেগের কারণেই (রাগ, হিংসা, ঘৃণা, লোভ ইত্যাদি) যুদ্ধ, খুন, হানাহানি, পারিবারিক-কলহসহ নানা বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়।
আবেগ শিশুর মানবীয় বিকাশের অন্যতম একটি বিষয়। জন্মের পর থেকেই শুরু হয় আবেগের বিকাশ। আবেগ বয়সভেদে ভিন্ন হয়। শৈশবে শিশুর আবেগ বেশি থাকে। রাগ, ভয়, ঈর্ষা, কৌতূহল, হিংসা, সুখ-দুঃখ, স্নেহ ইত্যাদির মাধ্যমে শিশুর আবেগ প্রকাশ পায়। যে সকল শিশু সঠিকভাবে আবেগ প্রকাশ করতে পারে তাদের স্কুলের ফলাফল ভালো হয়, বাবা-মা, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়, প্রতিবেশী সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারে। আবেগের এই বহিঃপ্রকাশে বাবা-মার অনেক অবদান থাকে। তাই আসুন জেনে নেই শিশুর এই আবেগ প্রকাশে কীভাবে সাহায্য করবেন।
- শিশুর প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন কারণ আপনি মনোযোগ দিয়ে না শুনলে শিশু তার আবেগ অস্বাভাবিকভাবে প্রকাশ করতে পারে।
- শিশু যদি সঠিকভাবে তার আবেগ প্রকাশ করতে পারে তবে তার প্রশংসা করুন।
- নিজে সঠিকভাবে আবেগ প্রকাশ করুন, কারণ শিশুরা অনুকরণপ্রিয়, আপনার ভালো আচরণ তাকেও ভালো আচরণ করতে উৎসাহিত করবে।
- শিশুর মেজাজ অনুযায়ী আচরণ করুন: সব শিশু এক রকম হয় না। জন্ম থেকেই শিশুদের মেজাজ আলাদা হয়। আবার শিশুর মনের ভাব সবসময় একইরকম থাকে না। তাই শিশুর মেজাজ অনুযায়ী আচরণ করতে হয়।
- আদর-স্নেহ নিতে ও দিতে শেখান: একটি শিশুর মধ্যে জন্মগতভাবেই আদর-স্নেহের চাহিদা রয়েছে। মা-বাবার আদর-স্নেহ দানের মাধ্যমেই শিশু ভালোবাসা দিতে ও নিতে শেখে। তাই শিশুর মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টির জন্য তাকে যথেষ্ট আদর-স্নেহ দিন। শরীরে হাত বুলিয়ে তা প্রকাশ করুন। শিশু যদি আপনাকে জড়িয়ে ধরে আপনিও তাকে জড়িয়ে ধরুন।
- আবেগ প্রকাশের পাশাপাশি শিশুকে আবেগ নিয়ন্ত্রণের কৌশলও শেখাতে হবে। কারণ সঠিকভাবে আবেগ নিয়ন্ত্রণ না শিখলে শিশুর বিভিন্ন মানসিক সমস্যা তৈরি হতে পারে। যেমন-দুশ্চিন্তা, হতাশা, ব্যক্তিত্বের সমস্যা ইত্যাদি।
আবেগ নিয়ন্ত্রণের নানা কৌশলসমূহ
- আবেগ প্রকাশে বাঁধা দেবেন না: শিশুকে আবেগ প্রকাশে বাধা দিলে বা আবেগ প্রকাশের কারণে তাকে লজ্জা দিলে তাদের আবেগের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। যেমন-রাগ করে যদি বলা হয় ‘ভয় পেয়ো না’ বা ‘মন খারাপের কী আছে?’ তাহলে সে মনে করতে পারে-তার আবেগ ঠিক নয়। সে হয়ত সারা জীবন তার আবেগকে চেপে রাখবে ও নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় পড়বে। বরং তার আবেগকে স্বীকার করে তাকে আশ্বস্ত করতে হয়।
- শিশুর যৌক্তিক দাবি পূরণ করা উচিত, অযৌক্তিক দাবি পূরণ করা উচিত নয়, শিশুকে তার পরিবারের ক্ষমতা-অক্ষমতা সম্পর্কে জানানো উচিত তাহলে সে অযৌক্তিক দাবি করবে না, নিজের ক্ষমতার অতিরিক্ত কিছু করতে চাইবে না।
- তিরস্কার, উপহাস বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দ্বারা শিশুর অসংযত আবেগকে নিয়ন্ত্রণ কর যায় না, তাই শিশুকে বুঝিয়ে আবেগকে সংযত করতে শেখাতে হবে।
- প্রতিটি মানুষের সীমাবদ্ধতা আছে, এই সহজ সত্যকে স্বীকার করে ব্যর্থতা, হতাশা, প্রত্যাখ্যান প্রভৃতিকে জয় করার চেষ্টা করতে হবে, যেকোনো পরিস্থিতিতে মনোবল অটুট রাখা শেখাতে হবে।
- কেউ ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে সেগুলো সংশোধনের প্রবণতা তৈরি করতে হবে।
- শিশুকে নিজের ক্ষমতা-অক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং অপরকে তার ক্ষমতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী মর্যাদা দিতে শেখাতে হবে, তাহলে শিশুর মনে হতাশা বা হীনম্মন্যতা তৈরি হবে না, নিজের যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার প্রবৃত্তি গড়ে তুলতে হবে। তাহলে অন্যের প্রতি ঈর্ষা অনুভূত হবে না।
- যেকোনো সমালোচনাকে সহজভাবে গ্রহণ ও সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে, তাহলে শিশুমনে প্রতিহিংসা তৈরি হবে না।
- মহৎ কাজের প্রতি আকর্ষণ, অসত্য, অন্যায়, অসামাজিক কাজের প্রতি ঘৃণাবোধ, প্রতিবেশী, আত্মীয় ও সর্বস্তরের মানুষের প্রতি মমতা, সহানুভূতি, সহমর্মিতার বীজ যথাযথভাবে শিশুর হৃদয়ে রোপন করতে হবে।
- আত্মবিশ্বাসের অভাব, প্রতিকূল পারিবারিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক পরিবেশ, স্নেহ-ভালোবাসা, নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি শিশুমনে ভয় তৈরি করে। তাই শিশুরা অনেক সময় নিন্দা, লজ্জা ও সমালোচনার ভয়ে আবেগকে প্রকাশ না করে দমিয়ে রাখে। আবেগের সুষ্ঠু প্রকাশ ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই শিশুর স্বভাবচরিত্র, ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। আবেগের প্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পরিবারের পাশাপাশি আত্মীয়, শিক্ষক, সমাজ, দেশের আইনগত অবস্থা ইত্যাদির ভূমিকা রয়েছে, তাই শিশুদের সাথে বন্ধুসুলভ ও সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করতে হবে যাতে তারা তাদের আবেগ (ভয়, লজ্জা, দুঃখ, কষ্ট ইত্যাদি) গোপন না করে।
মনে রাখতে হবে, শৈশবের শিক্ষাটাই মানুষ সারাজীবন বহন করে। আর শিশুরা বড়োদের অজ্ঞাতেই তাদের পর্যবেক্ষণ করে। শিশুর ব্যক্তিত্ব সেভাবেই গড়ে উঠবে যেরকম সে দেখবে। কাজেই সবচেয়ে আগে জরুরি শিশুকে যা শেখাতে চাই নিজেরা সেইমতো আচরণ করা।