২০১৬ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, বাংলাদেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রায় ৪ কোটি পিস ইয়াবা বাজেয়াপ্ত করেছে। এরপরও যদি জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতি ঘণ্টায় ৪৫ হাজারের বেশি ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রি হয়! তাহলে আঁতকে উঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এতো কেবল গেলো ইয়াবার কথা। এছাড়াও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ২৪ ধরনের মাদকের খোঁজ পাওয়া গেছে। এরমধ্যে বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে গাঁজা, এলএসডি, ফেনসিডিল, হেরোইন, কোকেইন, সীসা ইত্যাদিও প্রচুর পরিমাণে বাজেয়াপ্ত হচ্ছে। তবুও থেমে নেই মাদকের ভয়াল প্রসার। চাহিদামতো নিয়মিত মাদক সরবরাহ করা হচ্ছে। মাদকাসক্তে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে মারাত্মক হারে।
বর্তমান বাংলাদেশে সবচেয়ে ভয়ানক জায়গা দখল করে থাকা মাদকাসক্তি কমানোর অন্যতম উপায় হতে পারে মানসিক স্বাস্থ্য। অথচ বাংলাদেশে অবহেলিত বিষয়ের মধ্যে অন্যতম জায়গা দখল করে আছে এই মানসিক স্বাস্থ্য।
মাদকাসক্তি কী? এই প্রশ্নের উত্তর কোনো আসক্ত ব্যক্তির কাছে জানতে চাইলে জানা যাবে, ‘আমাকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়, মানসিক অবসাদ বা চাপ থেকে দূরে রাখে, যে কোন পরিস্থিতিতে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ করার অনুভূতি দেয়, সবচেয়ে বড় বিষয় সত্যিকার অর্থে বাঁচিয়ে রাখে, তীব্র ভালো লাগার সৃষ্টি করে। এটা আসলে শরীর ও মনের জন্য অনেক ভালো।’ কিন্তু এটাই কি সঠিক উত্তর? বিশেষজ্ঞদের মত অবশ্য ভিন্ন। ডা. মোহিত কামাল তার এক লেখায় বলেন, ‘মাদকদ্রব্য হচ্ছে এমন এক রাসায়নিক পদার্থ, যা সুশৃঙ্খল মস্তিষ্ককে বিশৃঙ্খল করে তোলে। ব্রেনের স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত করে। এমনকি দীর্ঘ ব্যবহারে কোষের গ্রাহকযন্ত্রের শারীরবৃত্তীয় কাজ বদলে দেয়। যেমন: ইয়াবা ব্যবহারে ‘মগজ’ শুকিয়ে সংকুচিত হয়ে যেতে পারে, মস্তিষ্ক আকারে ছোট হয়ে যেতে পারে।’ অর্থাৎ, সামগ্রিক বিবেচনায় মাদকাসক্তি, ব্যাক্তি এবং সমাজব্যবস্থার অনেক বড় এক অভিশাপের নাম।
এই অভিশাপ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে বাংলাদেশে সঠিক নিয়ম গ্রহণ না করে ভুল পথেই এগুচ্ছে। অনেকেই মনে করে এটি কেবল একটি অপরাধ। শাস্তিই এর প্রধান চিকিৎসা। কেউ তো এটাকে কেবল বদঅভ্যাসের আওতায় ফেলে, ইচ্ছে করলেই ছাড়তে পারে। কিন্তু এইসব ধারণা একদমই ভুল। মূলত মাদকাসক্তি একটা রোগ। আর এই রোগ নির্মূলের পথে অন্যতম উপায় হতে পারে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি।
ডা. মুনতাসির মামুন মাদকাসক্তিকে মানসিক রোগ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, ‘রোগ বলতে আমরা সাধারণত বুঝি শরীরের যে-কোনো অংশ, অঙ্গ বা তন্ত্রের স্বাভাবিক গঠন বা কার্যক্রমের পরিবর্তম যা নির্দিষ্ট কিছু উপসর্গ ও লক্ষণের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তেমনি মাদকাসক্তিতে আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবর্তন হয় মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্রম। গবেষণায় দেখা যায় যে, সুস্থ মস্তিষ্কের সঙ্গে আসক্ত মস্তিষ্কের বায়োলজিক্যালও ভিন্ন। ফলে এটাকে রোগ বলে চিহ্নিত করা যায়।’
আর এই রোগ থেকে মুক্তির জন্য মানসিক ভাবে শক্ত হতে হবে যেকোনো মানুষকেই। অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, ‘প্রথমত, যেকোনো মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে ‘না’ বলা শিখতে হবে। মানসিকভাবে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। আর ‘না’ বলার শক্তি অর্জন করার লক্ষ্যে মানসিকভাবে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এর জন্য অবশ্যই অশুভ সঙ্গী ও পরিবেশ থেকে দূরে থাকতে হবে। বন্ধু নির্বাচনে সাবধানী হতে হবে। আর অবশ্যই নিজের মেধা উন্নয়নে কাজ করতে হবে।’
‘এছাড়াও উন্নত মানসিক স্বাস্থ্য গড়নের লক্ষ্যে পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে। পারিবারিক ও নৈতিক মূল্যবোধের মধ্য দিয়ে শিশু বয়স থেকেই সন্তানের মনোজগতে এমন বৈশিষ্ট্যের বীজ রোপণ করতে হবে যেন সে আত্মবিশ্বাসী-আত্মপ্রত্যয়ী-আত্মমর্যাদাশীল হয়। আর তাহলেই সন্তানদের মধ্যে মাদকাসক্তি থেকে দূরে থাকার শিক্ষা বহাল থাকবে।’- যোগ করেন ডা. মোহিত কামাল।
মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির মাধ্যমে মাদকাসক্ত রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারিয়ে কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব কী? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্ভব নয়। মধ্যম আয়ের এই দেশে অনেক সন্তানই পরিবারহীন বা নিচু পরিবেশ থেকে উঠে আসে। যাদের মানসিক স্বাস্থ্য গড়নে সুস্থ পরিবেশ থাকে না। আর তাই মাদকের অবাধ প্রসার বন্ধ করতে হবে।
মাদকসেবীদের চিকিৎসা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার কাজ করা জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিউটিটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম মাদকের ভয়াল প্রসার নিয়ে বলেন, ‘প্রধান তিনটি কারণে বাংলাদেশে মাদক ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। চাহিদার জোগান, মানসিকভাবে বিষাদ এবং হিরোইজম।’ যা এই সমাজের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। আর এই মাদকাসক্তদের ফিরিয়ে আনার উপায় হিসেবে ডা. তাজুল ইসলাম আরও যোগ করেন, ‘মাদকের চাহিদা আছে বলে সরবরাহও আছে। আর এই সরবরাহ বন্ধ করতে পারলে মাদকের অপব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব হবে। যার দায়িত্ব আসলে সরকারের। বাকী কাজ সমাজ ও পরিবারের।’
এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, কেবল নিচু সমাজে নয় অনেক সময় ভালো পরিবারের সন্তানেরা ফ্যাশন ও হিরোইজম প্রমাণ করতে মাদকে আকৃষ্ট হোন। তিনি বলেন, ‘আমাদের মাদকের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণভাবে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। মাদকের ব্যাপারে অনেকেরই ভুল ধারণা আছে। অনেকে মনে করেন এটা ফ্যাশন বা হিরোইজম। কিন্তু এটার কুফল আমাদের বুঝতে হবে।’ অর্থাৎ, মাদকের কুফল নিজেদের মধ্যে আত্মস্থ করতে হবে। আর সেক্ষেত্রে আবার চলে আসে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি। আমরা যদি সমাজের সকল শ্রেণির মধ্যে সঠিক মানসিক স্বাস্থ্য গড়ে তোলার পরিবেশ তৈরি করতে পারি, তবেই মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।’
লিখেছেনঃ কামরুল ইসলাম ইমন
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে