আজকাল শিশু পালন নিয়ে শিশুর বাবা-মায়েদের সঙ্গে পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের মতের পার্থক্য দেখা যায়। শিশুদের কীভাবে বড়ো করা উচিত সে সম্পর্কে খুব কম লোকেরই অভিন্ন ধারণা রয়েছে। সন্তানের যত্ন সম্পর্কে মতামতের মধ্যে যখন কোনো পার্থক্য দেখা দেয় তখন প্রথমে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত যে দ্বিমত কতটা দরকারি। প্যারেন্টিং স্টাইল নিজের সন্তানকে কতটা প্রভাবিত করে, সে সম্পর্কে জানা থাকা উচিত। প্যারেন্টিং স্টাইলটি সন্তান বিকাশে সহায়তা করছে কিনা তা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ কারণ যেভাবে সন্তানের সঙ্গে আচরণ করা হয় তা তার সারাজীবনকে প্রভাবিত করবে। বয়স্করা বাচ্চার যে যত্নটি নিচ্ছেন সে সম্পর্কে যদি অভিযোগ থাকে তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি মনে রাখতে হবে তা হলো শান্ত থাকা এবং ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়া যে বাবা-মা হিসেবে আপনারা কেমন ভাবে সন্তান পালন করতে চান, বিনীত সুরে কথা বলা এবং অভিযুক্ত না করে পুরো ব্যাপারটা ভালোভাবে বলা। এক্ষেত্রে বয়স্করা যা বলতে চান তা শোনাও জরুরি। তারা কী করছেন তার জন্য তার কোনো ভালো কারণ থাকতে পারে বা এমন পরিস্থিতিও থাকতে পারে যেটা সম্পর্কে আপনি অবগত নন। যদি সম্ভব হয় তবে আশেপাশে অন্য কোনো বাবা-মার সঙ্গে কথা বলুন। প্রবীণ সদস্যদের সঙ্গে মতানৈক্যর ফলে সাধারণত দু থেকে চার বছর বয়সী শিশুরা সব কাজে এবং আচরণে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। শিশুর সামনে প্রবীণ সদস্য অর্থাৎ তার দাদা-দাদি, নানা-নানি বা অন্য কারো সঙ্গে বিরোধিতা করলে শিশুর মনেও তাদের প্রতি অশ্রদ্ধা জন্মায়। শিশুর কাছে তারা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েন। যা তাদের মানবিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর।
মনে রাখতে হবে, যে শিশুটি প্রবীণ সদস্যদের আজ অগ্রাহ্য করতে শিখে গেল সে একদিন বাবা-মাকেও অগ্রাহ্য করবে। আর এভাবে অভিভাবককে অগ্রাহ্য করতে শিখে গেলে তাদের সংশোধন করানোর জন্য যতই চাপ প্রয়োগ করা হোক না কেন, তাদের নেতিবাচক মনোভাব ততই বেড়ে যায়। এরকম কোনো আচরণ করে থাকলে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যদের পর্যাপ্ত স্নেহ ভালোবাসা ও মূল্যায়নের অভাবে অনেক শিশু নানাবিধ সমস্যায় ভোগে। যেটা তাদের মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। মূলত শৈশবে শিশুর সার্বিক বিকাশের ওপর নির্ভর করে তার পরবর্তী জীবনের সুখ ও স্বাভাবিকতা। এ কারণে শত ব্যস্ততার মাঝেও মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যদেরকে কিছুটা সময় বের করে নিতে হবে শিশুর সান্নিধ্যে থাকার জন্য। শিশুর মানসিক বিকাশে বাবা-মায়ের ভালোবাসা ও সান্নিধ্যের কোনো বিকল্প নেই। তবে অতিরিক্ত আদর এবং অতিরিক্ত শাসন দুটোই শিশুর মানসিক বিকাশের অন্তরায়। বাবা-মাকে শিশুদের মনের অবস্থা বুঝে তাদের শাসন করতে হবে। এই স্পর্শকাতর বিষয়গুলো প্রবীণ অভিভাবকরা অনেক সময় বুঝতে চান না তাদেরকে ধৈর্য নিয়ে বোঝাতে হবে। তারা অনেক সময় অতিরিক্ত আদর দেন। প্রয়োজনীয় শাসন করতে গেলেও বাবা-মাকে বাধা দেন। এটিও শিশুর মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাবা-মায়ের ওপর অনাস্থা তৈরি হয় এবং নেতিবাচক কিছু করে পার পেয়ে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়। অনেক বাবা-মা আবার পরিবারের প্রবীণ সদস্যটিকে কিছু বলতে না পেরে শিশুর ওপরই রাগ-ক্ষোভ ঢেলে দেন। এটি শিশুর মানসিক বিকাশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশে শিশুদের মধ্যে আছে বিষণ্নতা, অতিচঞ্চলতা, বিছানায় প্রস্রাব করা, অবাধ্যতা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, ভয়, আঙুল চোষা ও দাঁত দিয়ে নখ কাটা ইত্যাদি। তাদের মধ্যে দুই ধরনের মানসিক রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি আঙুল চোষা ও দাঁত দিয়ে নখ কাটা। আঙুল চোষার অভ্যাসের কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রাত্যহিক জীবনে শিশু কোনো ধরনের চাপের মুখোমুখি হলে মুখে আঙুল দেয়। আবার ঘুমানোর সময় সম্ভবত ঘুম আনার জন্য আঙুল মুখে দেয়া অনেক বাচ্চার স্বভাব। যদিও তিন বছরের পর থেকে স্বাভাবিকভাবে এ প্রবণতা হ্রাস পাবার কথা। যদি ৫/৬ বছর পরও শিশুর মধ্যে এ অভ্যাস থেকে যায় তবে এর পেছনে কোনো মানসিক কারণ আছে বলে ধরে নিতে হবে।
বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে প্রায় ৫৬.৫% শিশু অপুষ্টিতে ভোগে এবং প্রায় ১৬.৫% মানুষ মানসিক রোগে ভোগে সেখানে একটি শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ আশা করা খুব দুরূহ ব্যাপার। অনেক বাবা-মাই চান ছেলে-মেয়েদেরকে নিজেদের মতো করে মানুষ করতে। তারা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার চেয়ে বস্তুগত স্বাধীনতাকে বেশি গুরুত্ব দেন। এমনকি তারা তাদের অভিভাবকত্বের ভেতর পরিবারের অন্য সদস্যদের হস্তক্ষেপ মেনে নিতে পারেন না, সন্তানদের মতামতেরও মূল্যায়ন করেন না। কর্তৃত্ববাদী এসব বাবা-মায়ের বাচ্চাদের আত্মসম্মান সমস্যা বিকাশের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে কারণ তাদের মতামতের মূল্য নেই। তাদের মনোভাব প্রতিকূল হতে পারে। ভবিষ্যতে কীভাবে আরো বেশি ভালো করা যায় সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করার পরিবর্তে তারা প্রায়ই তাদের পিতা-মাতার প্রতি ক্রোধ দেখায়। যেহেতু কর্তৃত্ববাদী বাবা-মা প্রায়ই কঠোর, তাদের সন্তানরা শাস্তি এড়ানোর প্রচেষ্টায় ভালো মিথ্যাবাদী হয়ে উঠতে পারে।
দড়ি বেশি টানলে তা ছিঁড়ে যায়। আপনি আপনার জায়গায় জেদ ধরে রাখলে আপনার সন্তান আরো জেদি হবে। আপনি সন্তানের সামনে পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের অসম্মান করলে তারাও আপনাকে এবং অন্যদেরকে অসম্মান করতে শিখবে। তাই তাদেরকে বুঝতে চেষ্টা করুন। সময় দিন। তাদের বন্ধু হিসেবে গড়ে উঠুন। একই সঙ্গে প্রবীণ অভিভাবকদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের মধ্যস্ততা করুন। অপর মানুষকে সম্মান করতে শেখান। তাদেরকে এই অনুভূতির ভেতর দিয়ে বড়ো করে তুলুন যে, পরিবারের প্রবীণ সদস্যটি সমান গুরুত্বপূর্ণ। তারা পরিত্যক্ত নন, তাদের সঙ্গে মতবিরোধ হতে পারে তবে সংঘাত নয়। তাদের সমঝোতাপূর্ণ সহাবস্থান করতে হবে ভালোবাসা দিয়ে, সহমর্মিতা দিয়ে, মানবিকতা দিয়ে। আপনাকে সম্মান করতে দেখলে সেও সম্মান করতে শিখবে, সে আপনার ওপর আস্থা রাখবে। তাদের আস্থা অর্জন করুন। তারা যেন আপনাকে তাদের শত্রু মনে না করে। এতে ক্ষতি আপনারই।
ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবী জয় করা যায়। জেদ আর অহংকার দিয়ে নয়। একটি শিশু সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন সুস্থ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ। আর সেই বিকাশের পথ সুগম করার দায়িত্ব আপনারই।
ডা. ফাতেমা জোহরা
সহকারী অধ্যাপক, মানসিক রোগ বিভাগ,
ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল।
সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৫ম সংখ্যায় প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে