করোনা ভাইরাস এখন আর নতুন কোনো শব্দ নয়। বিশ্বব্যাপী এখন কথা বলার বিষয়ে যদি র্যাংকিং করা হয় করোনা ভাইরাস যে প্রথম স্থান দখল করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নতুনত্ব হারালেও করোনা ভাইরাস আমাদের দেহে কী কী প্রভাব ফেলতে পারে, এর নিত্যনতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের হার, কোন কোন অঙ্গের ক্ষতি সাধন করে, মানুষের বয়সভেদে এর আক্রান্ত করার হার, মানসিক কী কী সমস্যা করে ইত্যাদিসহ নানাবিধ বিষয় কিন্তু এখনো গবেষণার অধীন। তার মানে অনেক কিছুই আমরা এখনো নিশ্চিত করে জানি না। এক অদৃশ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে তাই নিয়ত গবেষণা চলছে।
প্রেগন্যান্সি বা গর্ভাবস্থা একটা বিশেষ অবস্থা যে সময়টাতে মায়ের শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতার প্রতিফলন ঘটে গর্ভের শিশুটির বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে। এসময় তাই গর্ভবতী মায়েদের বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয় স্বাভাবিক সময়ে। মহামারির এই সংকটকালে এই বিশেষ যত্নের ব্যাপারে যে আরো বেশি করে মনোযোগ দিতে হবে তা বলাই বাহুল্য। মহামারি আমাদের মানসিকভাবে নানা দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, সুতরাং গর্ভবতী নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মহামারির কী কী প্রভাব পরিলক্ষিত হয় তা নিয়ে গত এক বছরে বেশ কয়েকটা গবেষণা হয়েছে। যেকোনো একটা গবেষণার ফলাফলের ওপর আমরা অতটা নির্ভর করতে পারি না তাই অনেকগুলো গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে সিস্টেমেটিক রিভিউ বা মেটাঅ্যানালাইসিস করে যে ফলাফল পাওয়া যায়, তা মোটামুটি গুরুত্বপূর্ণ।
এখানে আমরা এমনি একটি গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে জানব, যেখানে মহামারিকালীন গর্ভবতী এবং প্রসব-পরবর্তী মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সাময়িকী বা জার্নালে গত জানুয়ারি, ২০১৯ থেকে সেপ্টেম্বর, ২০২০ এই সময়ের মধ্যে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল পর্যালোচনা করা হয়েছে। এখানে বিভিন্ন পর্যালোচনার পর ২৩টি গবেষণা নির্ধারণ করা হয়েছে যেখানে ২০,৫৬৯ জন অংশগ্রহণ করেছে। যাদের মধ্যে ১৬,৭৯৭ জন ছিলেন গর্ভবতী মা এবং ৩৭৭২ জন ছিলেন প্রসব-পরবর্তী মা। এদের মধ্যে দুশ্চিন্তার হার পাওয়া গিয়েছে ৩৭%, বিষণ্নতা ৩১%, মানসিক অস্থিরতা ৭০% এবং নিদ্রাহীনতা ৪৯%, প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতার হার ২২%। সংখ্যাগুলো রীতিমতো উদ্বেগজনক। গর্ভাবস্থায় নানারকম শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, একই কথা প্রসব পরবর্তী মায়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এ সময়টা তাই ঝুঁকিপূর্ণ, মহামারিকালীন সময়ে যেখানে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে, তখন এটা আরো ঝুঁকি বাড়ায়। সেটার প্রতিফলন আমরা বিভিন্ন গবেষণার তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে পেয়ে যাই। যেমন- ২০১৮ সালের একটি মেটাঅ্যানালাইসিসে প্রসব পরবর্তী বিষণ্নতার হার ছিল ১২%, যেটা এখন ২২%! এবং নিদ্রাহীনতা ৪৫.৭%, এখন ৪৯%। কারণ ২০২০ সালে, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে কোয়ারেন্টাইন, মেডিক্যাল সেবার অপ্রতুলতা, আর্থ-সামাজিক প্রতিকূল অবস্থা ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল ভবিষ্যৎ মায়েদের মানসিক অবস্থা।
অনেক গবেষণাই এর প্রমাণ পেয়েছে এবং গর্ভবতী মা, ভ্রুণ এবং সন্তানের ওপর এর মারাত্মক প্রভাব পরিলক্ষিত। গর্ভাবস্থা এবং প্রসব পরবর্তী সময়ে মানসিক সমস্যা থাকলে এর প্রভাব পড়ে তাদের শারীরিক স্বাস্থ্য, খাদ্যাভ্যাস, প্রয়োজনীয় পুষ্টি এবং ঘুমের ওপর যা তাদের আবেগকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং ফলাফল আগত সন্তানের পরিপূর্ণ বিকাশে সমস্যা; শারীরিক বিভিন্ন রকম সমস্যার সঙ্গেও সম্পর্কিত। যেমন: গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, প্রি-এক্লাম্পসিয়া, সময়ের আগেই প্রসব, বাচ্চার ওজন কম হওয়া, মিসক্যারেজ, শিশুর মস্তিষ্কের কাঠামোগত এবং কার্যগত সমস্যা, শিশুর আচরণ ও বিকাশজনিত সমস্যা। এই গবেষণায় আরো পাওয়া গিয়েছে, যারা প্রথমবার মা হচ্ছেন তাদের তুলনায় যাদের এক বা একাধিক সন্তান ছিল আগে তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা এবং বিষণ্নতার হার বেশি। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, তাদের অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। যেমন: একাধিক সন্তানের যত্ন নেওয়া, বর্তমান অবস্থার একটা পরিবর্তন, অভিভাবক হিসেবে আর্থিক দায়িত্ব বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
বিষণ্নতার হার বেশি পাওয়া গিয়েছে প্রেগন্যান্সির ১ম ও ৩য় ট্রাইমেস্টারে, কারণ হিসেবে হরমোনাল পরিবর্তনকে বলা হয়েছে। ২০১৭ সালে দুশ্চিন্তার হার ছিল ১৫.২% যেখানে কোভিডকালীন হার ৩৭% যা দ্বিগুণেরও বেশি। দুশ্চিন্তার হার বেশি পাওয়া গিয়েছে চাকুরিজীবী এবং উচ্চশিক্ষিতদের মাঝে কেননা চাকুরি যারা করেন তাদের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে মানিয়ে নেওয়া, চাকুরি হারানোর ভয় এবং মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার দুশ্চিন্তা বেশি পাওয়া গিয়েছে তীব্র দুশ্চিন্তাগ্রস্তদের তুলনায়। এছাড়াও ভীতির হার ছিল ৬৭.৪৬% এবং একাকিত্ব অনুভব করেন ৬০%। একই সময়ে সাধারণ মানুষের মানসিক সমস্যার পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, দুশ্চিন্তা ২৬%, বিষণ্নতা ২৪%, নিদ্রাহীনতা ৩৪% এবং মানসিক অস্থিরতা ২৬%। তাহলে এটাই প্রমাণিত হয় যে, মহামারিকালীন মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যায় গর্ভাবস্থা একটি ঝুঁকিপূর্ণ সময় তাই তাদের ক্ষেত্রে দ্রুত প্রতিরোধ এবং প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। এটা যদিও মহামারি সময়ে প্রথম রিভিউ প্রবন্ধ তারপরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে যেমন, বিভিন্ন গবেষণায় বিভিন্ন অ্যাসেসমেন্ট টুল এবং কাট-অফ পয়েন্ট ধরা হয়েছে। ১০টি বিভিন্ন দেশের ডাটা নেওয়া হয়েছে যেখানে কোভিড-১৯ মহামারির তীব্রতা সব জায়গায় সমান ছিল না।
অনলাইনে জরিপ করা হয়েছে এবং এটা একটা নির্দিষ্ট সময়ে দেখা হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে পর্যালোচনা করা হয়নি। গর্ভাবস্থায় এবং প্রসব-পরবর্তী অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যের যেকোনো সমস্যা আসলে অনেকগুলো বিষয়ের ফলাফল। যেমন: বয়স, একাধিক সন্তান থাকা, মিসক্যারেজ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, সামাজিক এবং আর্থিক অবস্থা, মানসিক চাপ, জীবনের নানাবিধ ঘটনা, বিবাহিত জীবনের পরিতৃপ্তি, শারীরিক বা প্রেগন্যান্সি রিলেটেড কোনো জটিলতা, পারিবারিক সামাজিক সহযোগিতা ইত্যাদি। সেখানে কোভিড-১৯ একমাত্র বা প্রধান কারণ নয় এটা যেমন ঠিক তেমনি তুলনামূলক পর্যালোচনায় এটাও দেখা গেছে, মহামারির একটা বড়োসড়ো ভূমিকা আছে এই ঝুঁকি বাড়ানোর ক্ষেত্রে। তাই সমস্যার কথা মাথায় রেখেই সমাধানের পথ খুঁজতে হবে এবং মহামারিকালীন সময়ে গর্ভবতী নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও অধিক যত্নশীল হতে হবে।
Mental Health of Pregnant and Postpartum Women During the Coronavirus Disease 2019 Pandemic: A Systematic Review and Meta-Analysis Haohao Yan, Yudan Ding, and Wenbin
ডা. সাদিয়া আফরিন
রেসিডেন্ট এমডি (চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলসেন্ট সাইকিয়াট্রি),
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৫ম সংখ্যায় প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে