ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা ও মানসিক শান্তি

0
408
ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা ও মানসিক শান্তি
ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা ও মানসিক শান্তি

ধৃ+মন= ধর্ম। ধৃ মানে হলো ধারণ বা গ্রহণ করা। মনকে যদি অন্তর, আত্মা বা পরমাত্মা বলা হয়, তাহলে মন থেকে যা ধারণ বা গ্রহণ করে তা-ই ধর্ম। প্রথাগত অর্থে অনেকে ধর্মীয় হওয়া বলতে বিভিন্ন ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত হওয়াকে বুঝে থাকেন। যেমন: নামাজ পড়া, রোজা রাখা, পূজা করা, হনুক্কা মোমবাতি জ্বালানো ইত্যাদি।

আধ্যাত্মিকতা একটা অনভূতির অভিজ্ঞতা, যা অতিচেতন মনের ওপর প্রভাব ফেলে। আসলে আমি একটা আত্মা, যে কিনা শরীর ও মনের মাধ্যমে পার্থিব জীবনের অভিজ্ঞতা লাভ করি। আমাদের আত্মা অনেকটা নীরব পর্যবেক্ষকের মতো। এই আত্মার সঙ্গে দেহের সম্পর্ক, মনের অনভূতির সম্পর্ক মিলিয়েই যে শিক্ষা সেটা আধ্যাত্মিকতা। আর যে এই শিক্ষা লাভ করেছে সে আধ্যাত্মিক। যা ব্যক্তিগত অনুশীলন ও ব্যক্তিগত ক্ষমতায়নে জীবনের গভীর অনুপ্রেরণার সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া বোঝায়। Spiritual But Not Religious বা সংক্ষেপে SBNR  বলতে বোঝায়-আধ্যাত্মিক তবে ধর্মীয় নয়। এটি একটি জনপ্রিয় বাক্যাংশ যা এ দুটির মধ্যে আপাত এক ধরনের বিরোধ তৈরি করে। কেউ কেউ এ দুটিকে পরস্পরের অন্তরায় আবার কেউ কেউ একটি আর একটির পরিপূরক মনে করেন। সমসাময়িক ব্যবহারে আধ্যাত্মিকতা প্রায়শই ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ জীবনের সঙ্গে জড়িত হয়ে মন, দেহ, আত্মার মঙ্গলকে গুরুত্ব দেন, পক্ষান্তরে ধর্মকে অনেকে সাংগঠনিক বা সাম্প্রদায়িক মাত্রাকে বুঝিয়ে থাকেন।

প্রকৃতপক্ষে ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা মানুষের ৫টি প্রাচীন আচরণগত বৈশিষ্ট্যের অন্তর্র্ভুক্ত। বাকি চারটি হলো-ভাষা, উন্নততর যন্ত্র সামগ্রী প্রস্তুতকরণ, সংগীত ও কলা। ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা বা আচরণ আমাদের বুদ্ধিমত্তার মতোই বংশগতির দ্বারা প্রভাবিত হয়। বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের একটি নতুন শাখায় ধর্ম ও মানব মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করছেন যার নাম Neurotheologyবা Neuropsychology of Religion , যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো ধর্মীয় অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ। ধর্মকে যদি একটি আচরণগত ব্যাপার মনে করা হয়, তবে অবশ্যই এটির বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। ধারণা করা হয় যে, মস্তিষ্কে DOPAMINE এর বিবর্তনকেন্দ্রিক বৃদ্ধির সঙ্গে ধর্মের বিবর্তনের সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৯৭ সালে বিজ্ঞানীরা মানব মস্তিষ্কের GOD SPOT নামের একটি নির্দিষ্ট জায়গা চিহ্নিত করেন যেটি মানুেষর তীব্র আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়।

তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন- এই আবিষ্কার এটি প্রমাণ করে না যে, ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা শুধুই মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের ভেতর সীমাবদ্ধ; আবার এটাও প্রমাণ করে না যে, মস্তিষ্ক আধ্যাত্মিক অনুভূতি লাভের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত।

তবে এই আবিষ্কার স্নায়বিক বিজ্ঞানের জগতে একটি নতুন দিককে ইঙ্গিত করে যা কিনা বিজ্ঞান ও ধর্মের পারস্পরিক সম্পর্ক ব্যাখ্যায় সাহায্য করে। সাম্প্রতিক কালের একটি বিবর্তনতত্ত্ব দাবি করেছে যে, Dopaminergic brain system এর বিকাশ বা বৃদ্ধি, বুদ্ধিমত্তা অর্জনের পেছনে প্রধান চলৎশক্তি। একটি অনিশ্চিত পরিবেশে DAএর পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে, যা আমাদেরকে ঐ পরিস্থিতিতে সাড়া দিতে প্রস্তুত করে তোলে। তাই DA এর প্রভাবেই কারাগারে বা যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষ ঈশ্বর চিন্তা করতে বা আধ্যাত্মিক হতে প্রবৃত্ত হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক আচার ও বৈজ্ঞানিক চেতনা, যাদেরকে স্বাভাবিকভাবে পরস্পর-বিপরীত মনে হয়-উন্মেষিত হয়েছিল সম্ভবত একইসঙ্গে।

ক্রোল ও শিহানের পর্যবেক্ষণেও জানা গেছে যে, ৭০% ‘সিজোফ্রোনিয়া’ রোগীর আধ্যাত্মিক কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। এতসব কিছরু পরও বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যেটি অস্পষ্ট থেকে গেছে বা হয়ত চিরকাল অস্পষ্টই থাকবে, তা হলো-আধ্যাত্মিকতা কি শুধইু DOPAMINE এর প্রতিক্রিয়া, যা মানষুকে প্ররোচিত করে উচ্চতর কোনো শক্তির বিশ্বাসে, নাকি DA এর বৃদ্ধি মস্তিষ্কে এমন কোনো পরিবেশ তৈরি করে যা চির বিরাজমান সেই সত্ত্বার উপলদ্ধির জন্য অনকূল? বিষয়টিকে ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা বা মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা যাই বলা হোক না কেন মানবিক চেতনার গঠনে এর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে।

উনিশ শতকের শুরু পর্যন্ত ধর্ম ও মানসিক স্বাস্থ্য অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিগণের দেখভাল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই করত। যখন শারকোট ও তাঁর ছাত্র ফ্রয়েড, হিস্টিরিয়া ও নিউরোসিসকে ধর্মের সঙ্গে সংযক্তু করলেন তখন থেকেই মূলত ধর্ম ও মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়, যেটি কিছুিদন আগে পর্যন্তও বিদ্যমান ছিল। গত কয়েক বছর ধরে এই বিভাজন কিছুটা কমতে শুরু করেছে। মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি এখন অনেকটাই ইতিবাচক। ১৯৯৪ সালে DSM-IV (The Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders is a publication for the classification of mental disorders) ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সমস্যা শিরোনাম অধ্যায় সংযুক্ত হয়েছে। এখন এটি গবেষণায় প্রমাণিত যে, ধর্মীয় আচার/ধর্ম পালন উন্নত মানসিক স্বাস্থ্য গঠনে সাহায্য করে এবং মানসিকভাবে অসুস্থ রোগীগণ তাদের চাপ সামলানোর জন্য ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচারকে ব্যবহার করেন।

কিছু গবেষণাতে দেখা যাচ্ছে, কমপক্ষে ৫০% মনোরোগ বিশেষজ্ঞও মনে করছেন যে, তাদের রোগী বা ক্লায়েন্টদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার সম্পর্কে তথ্য দরকার। আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন ইতিমধ্যে একটি গাইড লাইন দিয়েছে যেখানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞগণের ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাস ও মানসিক রোগের চিকিৎসার দ্বন্দ্ব সম্পর্কিত বিষয় বিধৃত হয়েছে। গবেষণাতে প্রমাণিত হয়েছে ধর্ম পালন ও বিষণ্ণতার সম্পর্ক পুরোপুির বিপরীত। কোয়েনিগ ও তাঁর সহকর্মীবৃন্দ দেখিয়েছেন, তুলনামূলক যারা বেশি ধর্ম পালন করেন তাদের মধ্যে বিষণ্ণতার তার মাত্রা কম। এমনকি কখনো আকান্ত হলেও তারা দ্রুত আরোগ্য লাভ করেন। তাদের মধ্যে আত্মহত্যার হার নগণ্য। কিছুদিন আগে প্রকাশিত কানাডিয়ান একটি গবেষণাতে দেখা গেছে, ধার্মিক ব্যক্তির সাহচর্য ও ধর্মীয় আচার পালন আত্মহত্যা প্রতিরোধে সহায়ক। কোয়েনিগের গবেষণায় দেখা গেছে, ধার্মিক ব্যক্তিদের মধ্যে উদ্বিগ্নতার মাত্রা কম থাকে। কোনো ব্যক্তির দৃঢ় ধর্মীয় বিশ্বাস অনেকসময় বিভিন্ন পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে। পক্ষান্তরে প্রশ্নযুক্ত দুর্বল ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে উদ্বিগ্নতার মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা মানুষের সহমর্মিতা, অল্পে তুষ্টি, অন্যকে ক্ষমা করা ইত্যাদি ধনাত্মক আবেগকে বাড়িয়ে তোলে। সামাজিকতা বৃদ্ধিতে ধর্মের একটি ধনাত্মক ভূমিকা রয়েছে। এছাড়াও দেখা গেছে, ধর্ম পালন নেশা থেকে দূরে রাখে। ফ্রয়েড ধর্মকে এক ধরনের অবসেশনাল নিউরোসিস মনে করতেন। পক্ষান্তরে আধুিনক গবেষণাতে দেখা গেছে, প্রকৃত ধার্মিকতার কারণে মানুেষর মধ্যে নিখুঁত থাকার প্রবণতা তৈরি হয়। চিন্তাবাতিক বা অবসেশন রোগের উপসর্গ প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তির মধ্যে কমই পাওয়া গেছে। তবে কিছুসময় আবার ধর্মীয় ভুল বিশ্বাস ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অসহযোগিতা ও ধর্মীয় বর্ণবাদ বিষণ্ণতাকে বরং বাড়িয়ে তলুতে পারে। ধর্মীয় আচারের মাধ্যমে যদি কারো নিজেকে শুধু দোষী মনে হয়, ভীতিকর পূর্বানুমান করতে থাকে তাহলে বরং উদ্বিগ্নতার মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে।

অনেক সময় দেখা গেছে, অতিমাত্রায় ধর্ম পালনে ও স্বামী-স্ত্রীর ধার্মিকতার মাত্রায় পার্থক্যের কারণে পারিবারিক অশান্তি এমনকি সংসার ভেঙে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। ধর্মীয় আচার, প্রার্থনা ইত্যাদি অনেক সময় মনোরোগ চিকিৎসার সংস্পর্শে আনতে দেরি হওয়ার একটি কারণ। HOPE প্রশ্নমালার মাধ্যমে একজন চিকিৎসক তার রোগী বা ক্লায়েন্টের ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতার ব্যাপারটি জিজ্ঞেস করতে পারেন। একজন চিকিৎসক এটির মাধ্যমে ধর্ম পালন কীভাবে তার রোগীর অসুস্থতাকে প্রভাবিত করছে সেটি বুঝতে পারেন। রোগীর ধর্ম বিশ্বাস যাই হোক না কেন একজন চিকিৎসককে সে ব্যাপারে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে এবং অযাচিত কোনো উপদেশ দেওয়াটা ঠিক হবে না।

আরজ আলী মাতুব্বর বলেছেন, ‘ধর্মগুরুরা নীতিবাক্য প্রচার করিয়াছেন অজস্র। আর উহাতে কাজও হইয়াছে যথেষ্ট। অসংখ্য নর-নারী অসৎ কাজ ত্যাগ করিয়া সৎ কাজে ব্রতী হইয়াছেন …মূলত পশুবৃত্তি বা স্বেচ্ছাচারিতা ত্যাগ করাইয়া মানুষকে সুসভ্য করিয়া গড়িয়া তুলিবার ব্যাপারে ধর্মগুরু বনাম ধর্মের দান অপরিসীম। ধর্মীয় শিক্ষার ফলে আদিম মানবদের লাভ হইয়াছে যথেষ্ট এবং বর্তমান যুগেও উহার আবশ্যকতা ফুরায় নাই।’
মানুেষর মস্তিষ্ক থেকে ঈশ্বর বা আধ্যাত্মিকতা বিলীন হবে না, যদি না মানুষের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা লুপ্ত হয়। ভাবনা ভালোবাসা,  ‍সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার মতো ধর্মআধ্যাত্মিকতাও একটি মস্তিষ্কপ্রসূত মানবিক অনভূতি ও আমাদের চিরকালের সঙ্গী।

লেখক:  ডা. মারুফুল হক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বগুড়া।
সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত

করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

 

Previous articleমানসিক রোগীদের শেকলে বেধে রাখা: এখন ইতিহাস
Next articleধর্ম এবং মানসিক স্বাস্থ্যের যোগসূত্র

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here