জীবনের এক তৃতীয়াংশ সময় আমরা ঘুমাই। ঘুম শব্দটি শুনলে নিজের অজান্তেই প্রশান্তিভাব চলে আসে, কারো কারো ঘুমও পেয়ে যায়, আবার এই ঘুম নিয়ে অনেকের দুর্ভাবনার শেষ থাকে না। ঘুম বড়ো দরকারি, কিন্তু ঘুমের সমস্যাগুলোকে অনেক সময় আমরা তেমন গুরুত্ব দিই না, কম ঘুম হওয়া বেশ বড়ো সমস্যা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা-দুটোর জন্যই ঝুঁকি হয়ে দাঁড়ায়। ঘুম কম হলে বিপদ। দৈনন্দিন জীবনে এর প্রভাব অনেকখানি। গবেষকরা দেখেছেন, ঘুম কম হলে কিংবা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে মোটরকার দুর্ঘটনা হয় বেশি, সম্পর্কে ফাটল ধরে, কর্মক্ষেত্রে পারফরম্যান্স খারাপ হয়, স্মৃতিশক্তির সমস্যা হয়, মন মেজাজ খারাপ থাকে। আরো বলা হয়ে থাকে, ঘুমের সমস্যার জন্য কিছুটা হলেও পরিণতিতে হতে পারে হৃদরোগ, স্থূলতা ও ডায়াবেটিসের মতো রোগ। তাই ঘুমের সমস্যাগুলো সম্পর্কে আমাদের সঠিক ধারণা থাকা উচিত, আসুন আমরা জেনে নিই ঘুম ও তার নানা সমস্যার কথা।
ইনসমনিয়া
ঘুমের সমস্যা বলতে প্রথমেই আমাদের যে সমস্যাটির কথা মনে আসে তা হলো ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা। ল্যাটিন শব্দ সমনাস-এর অর্থ স্লিপ বা ঘুম। আর ইনএর অর্থ নট বা না। এই দুই মিলিয়ে ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা। পৃথিবীতে হয়ত খুব কম মানুষ পাওয়া যাবে যার জীবনে অনিদ্রার অভিজ্ঞতা হয়নি। হয়ত কোনো এক রাতে ঘুম এল না, এটি তেমন কোনো সমস্যা না, কিন্তু এই অনিদ্রা যদি চলতেই থাকে রাতের পর রাত তাহলে তো তাকে অনিদ্রা বলতেই হয়। বাঁচতে হলে ঘুমোতেই হবে! যদিও বলা হয়-ঘুম হচ্ছে মৃত্যুর সমতুল্য, তবু এই ঘুমই হচ্ছে সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকার চাবিকাঠি। ঘুম আপনার মস্তিষ্ক ও শরীরকে দেয় পূর্ণাঙ্গ বিশ্রাম, যার কারণে আপনি কর্মক্ষম থাকতে পারেন। কিন্তু যাদের রয়েছে ঘুমসংক্রান্ত সমস্যা, বিশেষ করে অনিদ্রার মতো ভয়াবহ যন্ত্রণা তারাই বুঝতে পারেন ঘুমের মূল্য। অনিদ্রা মানে না ঘুমিয়ে থাকা। কিন্তু পুরোপুরি না ঘুমিয়ে তো বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। আসলে ঘুম ঠিকমতো না হলে বা কম হলে তাকেই আমরা অনিদ্রা রোগ বা ইনসমনিয়া বলি। অনিদ্রা বিভিন্নরকমের হতে পারে যেমন : একেবারেই ঘুম না আসা, বার বার ঘুম ভেঙে যাওয়া, একবার ঘুম ভাঙার পর আর ঘুম না আসা, প্রশান্তির ঘুম না আসা ইত্যাদি।
মূলত ইনসমনিয়া হয় বংশগত অথবা নানা শারীরিক ও মানসিক কারণে। ঘুমের সমস্যা কি শুধুই অনিদ্রা সমস্যাকে বোঝায়? মোটেই না, বরং ঘুম না আসার চেয়েও আরো মারাত্মক কিছু সমস্যা রয়েছে যার সম্পর্কে অনেকেই পরিচিত নন। যাদের অনিদ্রা বা ইনসমনিয়া রয়েছে তারা বুঝতে অন্তত পারেন তার অনিদ্রা সমস্যা রয়েছে। কিন্তু ঘুম সম্পর্কে এমন অনেক সমস্যা রয়েছে যাতে আক্রান্ত অনেকেই বুঝতেই পারেন না যে তার এই সমস্যা রয়েছে। এবার আমরা জানব এরকম কিছু সমস্যার কথা।
ঘুমিয়ে হাঁটা
এ সমস্যা খুব কম মানুষেরই হয়, বাচ্চাদের মধ্যে এ সমস্যা বেশি পাওয়া যায়, আবার বড়ো হলেও অনেকের তা থেকে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘুমিয়ে পড়ার এক থেকে দুই ঘণ্টা পর স্লিপ ওয়াকিংয়ের সমস্যা দেখা যায়, যা কয়েক মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ঘুমের এমন সমস্যা যাদের রয়েছে তারা সত্যি সত্যি ঘুমের মধ্যে উঠে হাঁটতে থাকেন, না জেগে উঠেও এরা করতে পারেন নানা কাজকর্ম। নিদ্রাকালে হাঁটেন যারা তারা হাঁটার সময় চোখ খুলে তাকিয়ে থাকেন, কিন্তু চেহারা থাকে ভাবলেশহীন, অভিব্যক্তিহীন, কোনো প্রশ্ন করলে সাড়া দেন না, আর জেগে উঠলে এদের মনে থাকে না কী কাজ করেছেন তারা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। কারণ তারা তো জেগে নেই, চোখ খুলেছেন ঠিকই কিন্তু তার মস্তিষ্ক রয়ে গেছে ঘুমের রাজ্যে। তিনি কী করছেন, কী বলছেন, কোথায় যাচ্ছেন সবই তার নিজের কাছে অজ্ঞাত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘুমের মধ্যে হাঁটার পারিবারিক ইতিহাস থাকে।
স্লিপ অ্যাপনিয়া
স্লিপ অ্যাপনিয়া বা ঘুমের মধ্যে শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যাঘাত ঘটা বিরল কোনো রোগ নয়, তবে প্রায় সময়ই আমরা এই সমস্যার গুরুত্ব বুঝতে পারি না। এটি মারাত্মক একটি রোগ, হেলাফেলায় হতে পারে হৃদরোগসহ নানা জটিলতা। এ সমস্যা বেশি হয় পুরুষদের, বিশেষ করে স্থূল, পয়ষট্টি-ঊধ্বর্ মানুষের। বয়স্কদের মধ্যে এ সমস্যা বেশি হলেও বাচ্চারা যাদের টনসিল বড়ো এদেরও এ সমস্যা হয় বেশি। একজন স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগীর ঘুমের মধ্যে অসংখ্যবার, এমনকি ঘণ্টায় ত্রিশ বা তারও বেশিবার শ্বাস প্রশ্বাস থেমে যেতে পারে, এবং প্রতিবার শ্বাস বন্ধ অবস্থার স্থায়িত্বকাল কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট পর্যন্ত হতে পারে, এরপর আবার স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস শুরু হয়। এসময় নাক ডাকার মতো শব্দ হতে পারে, যাদের এ সমস্যা রয়েছে তারা নিজেরা অনেক সময় বুঝতে পারে না। শয্যাসঙ্গী বুঝতে পারেন। শ্বাস রোধ হলে তখনই বড়ো বড়ো গজর্ন হয় নাসিকার। এই রোগটির দুটো ধরন রয়েছে, পথ্রমটি হলো অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া, যেখানে শ্বাসনালীর কোথাও কোনো একটি বাধার কারণে শ্বাস প্রশ্বাস ব্যাঘাত ঘটে। রোগী যখন জোর করে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করে তখনই নাক ডাকার আওয়াজ হয়। দ্বিতীয় কারণটি হল সেন্ট্রাল স্লিপ অ্যাপনিয়া, যেখানে মস্তিষ্ক থেকে সঠিক সংকেত না পাওয়ায় শ্বাস প্রশ্বাসের মাংসপেশি কাজ বন্ধ করে দেয়।
নার্কোলেপসি
এই সমস্যাটি খুব বেশি পাওয়া যায় না। রাতে পুরো ঘুমিয়েও এরা দিবানিদ্রা ছাড়া কাজই করতে পারে না। যদিও দিনের এই ঘুম কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট হতে পারে, এরা ঘুম এবং সজাগ এই দুই অবস্থার পার্থক্য বুঝতে পারে না। এছাড়া আরো কিছু লক্ষণ থাকতে পারে যেমন : ঘুম থেকে জেগে উঠলে নড়াচড়া করতে সমস্যা হয়, অনেকে তীব্র আবেগে মাংসপেশির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। অশান্ত অস্থির পদযুগল যাদের এ সমস্যা হয় এরা বিশ্রামের সময় বা স্থির থাকার সময় পায়ে অস্বস্তি অনুভব করেন এবং পা নড়াচড়া করার তাগিদ অনুভব করেন। সমস্যা বেশি হয় সন্ধ্যা এবং রাতে ঘুমানোর সময়, মহিলাদের মধ্যে এই সমস্যা তুলনামূলকভাবে বেশি পাওয়া যায়। দুঃস্বপ্ন অনেকেই ভাবেন, দুঃস্বপ্ন দেখা একেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার এবং এটি ঘুম সংক্রান্ত কোনো সমস্যাই নয়, হঠাৎ দুঃস্বপ্ন দেখা খারাপ কিছু নয়, তবে ঘন ঘন দুঃস্বপ্ন দেখা চিন্তার বিষয়। দুঃস্বপ্ন দেখলে ভয়, আতঙ্ক অথবা উদ্বেগ হতে পারে। দুঃস্বপ্ন দেখলে সাধারণত সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে যায়, এদের স্বপ্নের কথা মনে থাকে এবং আর ঘুম আসতে চায় না।
নাইট টেরর অথবা স্লিপ টেরর
নাইট টেরর হলে আক্রান্ত ব্যক্তি হঠাৎ করে ভয়ে আতঙ্কিত অবস্থায় ঘুম থেকে উঠে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে বিভ্রান্ত থাকে এবং কোনো কিছু বলতে পারে না। তাদের ঘুম পুরোপুরি ভাঙে না এবং কোনো কথা বললে উত্তর দেয় না। নাইট টেরর সাধারণত ১০-১৫ মিনিট স্থায়ী হতে পারে। এরপরে আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। নাইট টেররে আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত পরের দিন ঘুম থেকে উঠে রাত্রে কী হয়েছে মনে করতে পারে না। এটা সাধারণত ৩-৮ বছর বয়সী শিশুদের হয়। নাইট টেররে আক্রান্ত শিশুরা অনেক সময় ঘুমের ঘোরে হাঁটে অথবা কথা বলে। আবার পূর্ণবয়স্কদেরও এটা পূর্ণবয়স্কদেরও হতে পারে।
স্লিপ প্যারালাইসিস বা বোবায় ধরা
স্লিপ প্যারালাইসিস হলে আক্রান্ত ব্যক্তির মাংসপেশি সম্পূর্ণ দুর্বল হয়ে যায়, যার ফলে কিছুক্ষণের জন্য শরীর নড়াতে পারেন না। এর ফলে মানুষ ঘুমের মধ্যে বা প্রায় জাগরণের মুহ‚র্তে সম্পূর্ণ অসাড় হয়ে যায়-মানসিকভাবে জাগ্রত কিন্তু শারীরিকভাবে অসাড়। এ সময় ভয়ংকর হ্যালুসিনেশন হয়ে থাকে। এর সাথে দম বন্ধ হয়ে আসা, হার্টবিট কমে যাওয়া, ঘরে শত্রু বা খারাপ মানুষের উপস্থিতি, কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে, বুকে বা গলায় চেপে ধরছে এমন অনুভূতি হয়। এটি ঘুমের মধ্যে কিছু করা থেকে আমাদের বিরত রাখে। ঘুমিয়ে গেলে মস্তিষ্ক থেকে পেশিতে সংকেত যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, তাই আমরা পেশি নাড়াতে পারি না। এটা কী কারণে হয় তা স্পষ্ট না। তবে পরিবারের কোনো সদস্যের এই সমস্যা থাকলে অন্য সদস্যদের হতে পারে। স্লিপ প্যারালাইসিস ক্ষতিকর না। তবে এটা হলে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রচন্ড ভয় হয়, কারণ তারা বুঝতে পারেন না কী হচ্ছে। শব্দ হলে অথবা আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্পর্শ করলে সমস্যাটা চলে যায় এবং রোগী মিনিটখানেকের মধ্যে আবার নড়তে পারে।
এছাড়া ঘুমের আরো অনেক সমস্যা হতে পারে যেমন : যারা শিফট ওয়ার্ক করেন তারা ঘুমের সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হন। সুতরাং ওপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, অনিদ্রা ছাড়াও ঘুমের অনেকরকম সমস্যা আছে যেগুলো নির্ণয় এবং সঠিকভাবে চিকিৎসার প্রয়োজন আছে অন্যথায় এ থেকে সৃষ্টি হতে পারে মারাত্মক জটিলতা।
সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে