বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের যেসব পরিবর্তন দেখা দিতে পারে

0
307
বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের যেসব পরিবর্তন দেখা দিতে পারে

আমরা সবাই জানি যে একটা শিশুর জীবনে বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হয় কৈশোর পর্বের মধ্য দিয়ে। এই সময়ে একজন শিশুর শরীরের ভিতরে ও বাইরে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। এর ফলে এই অধ্যায়টি মানুষের জীবনে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। সময় ও গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের শরীরে বয়ঃসন্ধিকালীন নির্দিষ্ট পরিবর্তনগুলো ঘটে থাকে। বয়ঃসন্ধির পূর্বশর্ত হিসেবে পুষ্টি, জিনের গঠন এবং সামাজিক উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর এই পূর্বশর্তগুলোই একজন অভিভাবককে তার সন্তানের বয়ঃসন্ধিজনিত পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। এই স্বাভাবিক এবং স্বাস্থ্যকর পরিবর্তনগুলোই একটা বাচ্চাকে শৈশবস্থা কাটিয়ে কৈশোর অর্থাৎ বয়ঃসন্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশক হিসেবে কাজ করে।

এক্ষেত্রে আরও একটা বিষয় মনে রাখা জরুরি, প্রতিটি বাচ্চার জীবনে বয়ঃসন্ধির প্রভাব সময় বিশেষে আলাদা-আলাদা হয় এবং বয়ঃসন্ধিগত পরিবর্তন একটা বাচ্চার জীবনে ৯ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে যে কোনও সময়ে ঘটতে পারে। যে ধরনের বদলগুলো কৈশোরের শুরুতে এবং কৈশোরকালীন অবস্থায় ঘটে সেগুলো হল-

  • ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে এই সময়ে ভিন্ন ধরনের শারীরিক বিকাশ ঘটে
  • যৌনাঙ্গের বিকাশ হয়
  • অনুভূতিগত এবং সামাজিক পরিবর্তন
  • কগনিটিভ বা ব্যবহারিক বদল

বয়ঃসন্ধির সময়ে ছেলে-মেয়েদের শরীরে প্রজনন অঙ্গের বিকাশ ঘটে এবং যৌন-হরমোন নিঃসৃত হতে শুরু করে। এই সময়ে মেয়েদের ক্ষেত্রে ডিম্বাশয় এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে টেস্টিস-এর বিকাশ হয়। যে যৌন-হরমোন একটা মেয়ের শরীরে পরিবর্তন ঘটায় তা হল ইস্ট্রোজেন এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরন হরমোনের প্রভাবে পরিবর্তন দেখা দেয়। বয়ঃসন্ধিকালীন মেয়ের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তনগুলো দেখতে পাবেন সেগুলো হল-

শারীরিক পরিবর্তন:

  • বয়ঃসন্ধির শুরুতে আপনার মেয়ের শারীরিক বিকাশ খুব দ্রুত হবে এবং তার দৈহিক উচ্চতাও বাড়বে। মেয়েদের ক্ষেত্রে শারীরিক বিকাশ সাধারণত ১৬-১৭ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে।
  • মেয়েদের দৈহিক আকার-আয়তনের ক্ষেত্রেও বদল ঘটতে শুরু হয়। এই সময়ে মেয়েদের শারীরিক ওজন বাড়তে পারে। তাদের নিতম্ব (হিপ) চওড়া হতে পারে। মেয়েদের নিতম্ব, উরু এবং পেটে মেদ জমে সেই অংশগুলো স্থূলকায় হয়ে যায়।
  • বয়ঃসন্ধি পর্যায়ে মেয়েদের দৈহিক বিকাশের প্রথম চিহ্ন হিসেবে তাদের স্তনের বিকাশ চোখে পড়ে।
  • যোনিপীঠ (পিউবিক) এবং বাহুমূ্লে (আন্ডারআর্ম) রোম বা চুল জন্মাতে শুরু করে
    মেয়েদের ঋতুচক্র আরম্ভ হয়। ঋতুস্রাব চলাকালীন তাদের পেটে ব্যথা বা কামড়ে ধরার অনুভূতি জেগে ওঠে। কিছু কিছু মেয়ের ক্ষেত্রে ঋতুচক্র শুরু হওয়ার পর প্রথম কয়েক মাস ঋতুস্রাব অনিয়মিতভাবে হতে পারে।
  • মেয়েদের শরীরে এইসময়ে হরমোনের পরিবর্তনের জন্য ত্বক তৈলাক্ত ও ঘেমে-নেয়ে যেতে পারে। বয়ঃসন্ধির মেয়েদের ক্ষেত্রে ব্রণ এবং ফুসকুড়ির সমস্যা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা।

অনুভূতিগত ও সামাজিক পরিবর্তন

  • বয়ঃসন্ধির সময়ে আপনি আপনার মেয়ের মধ্যে এমন কিছু অনুভূতিগত এবং সামাজিক পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারেন যা তাকে তার দৈহিক বদলগুলো গ্রহণ ও মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। সেই সঙ্গে তাদের মধ্যে স্বাধীন সত্ত্বার বোধ জেগে ওঠে।
  • বয়ঃসন্ধির সময়ে নানারকম শারীরিক এবং হরমোনজনিত পরিবর্তন ঘটে। সেই কারণে অভিভাবক হিসেবে আপনি আপনার মেয়ের মধ্যে নিম্নলিখিত অনুভূতিগত বা মানসিক বদলগুলো দেখতে পাবেন-
  • বিভিন্ন সময়ে খুব গভীর ও তীব্র অনুভূতি দেখা দেয়: এটা অনেকটা মেজাজ-মর্জির ঘন ঘন বদল হওয়ার মতো ঘটনা। এক্ষেত্রে একটা জরুরি বিষয় অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে তাদের মস্তিষ্ক এইসময়েও অনুভূতি কীভাবে প্রকাশ করতে হবে সেই প্রক্রিয়া শেখায়।
  • মানসিক দিক দিয়ে সংবেদনশীল হয়ে ওঠে: এই সময়ে একটি মেয়ের মধ্যে অন্যের অনুভুতি জানার ও বোঝার দক্ষতাজনিত বিকাশ হতে শুরু করে। এই কারণে তারা অতিরিক্ত সংবেদনশীল হয়ে ওঠে বা অপরের আচরণ এবং শরীরি ভাষার ভুল ব্যাখ্যা করে বসে।
  • নিজেদের শারীরিক গঠন ও পরিবর্তন সম্পর্কে তাদের আত্মসচেতনতা দেখা যায়: বয়ঃসন্ধির মেয়েরা বন্ধু বা তার কাছের মানুষের সঙ্গে নিজেদের শারীরিক সৌন্দর্য তুলনা করতে পারে।

এই সময়ে যে ধরনের সামাজিক পরিবর্তন ঘটে, সেগুলো হল-

  • বয়ঃসন্ধিকালের মেয়েদের মধ্যে আত্মপরিচয় গড়ে তোলার প্রবণতা দেখা দেয়। সে নিজেকে বাইরের জগতের সামনে প্রকাশ করতে চায় ও নিজের সম্পর্কে নিজের কাছেই জানতে চায় এবং নিজেকে বুঝতে চায়। নিজেদের আত্মপরিচয় খোঁজার পিছনে থাকে লিঙ্গ, কাছের মানুষ, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল, মিডিয়া, স্কুল ও পারিবারিক প্রভাব।
  • নিজেকে বুঝতে চাওয়ার মধ্য দিয়েই মেয়েরা আত্মনির্ভর হয়ে ওঠার চেষ্টা শুরু করে। এহেন চেষ্টাই তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ও পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। এই বয়সের মেয়েরা অভিভাবকদের সঙ্গে একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতে চায়। অর্থাৎ তারা নিজেদের জন্য একটা আলাদা জায়গা তৈরি করতে চায়।
  • পরিবারের লোকজনদের থেকেও বন্ধু বা কাছের মানুষজন তাদের কাছে বড় হয়ে উঠতে পারে। তাদের আচরণ, নিজস্বতার বোধ এবং আত্মবিশ্বাস বন্ধু ও প্রিয়জনের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সাহায্য করে।
  • বয়ঃসন্ধির মেয়েদের মস্তিষ্কের বিকাশ এমনভাবে হয় যার ফলে তাদের মধ্যে নতুন কিছু করে দেখানো বা দেখার ইচ্ছে জেগে ওঠে। এর ফলেই কিছু কিছু কিশোর-কিশোরীর (সবার মধ্যে নয়) মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজকর্মের প্রতি ঝোঁক জন্মায়। আবার একইসঙ্গে তাদের মধ্যে হঠকারিতা নিয়ন্ত্রণ করার মতো শক্তির বিকাশও হয়।
  • এই সময়ে একটি মেয়ে তার যৌনতা ও যৌন পরিচয় সম্পর্কেও আগ্রহী হয়ে ওঠে। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজের এবং বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ জন্মায়। এ কারণে সাধারণভাবে এই বয়সে মানুষ প্রেমে পড়ে বেশি।
  • যোগাযোগের নিত্য-নতুন মাধ্যম ব্যবহারের প্রতি ঝোঁক বাড়ে। মোবাইল, ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ে। আর এভাবেই বৃহত্তর পৃথিবীর সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ গড়ে ওঠে।

কগনিটিভ বা ব্যবহারিক বদল:
বয়ঃসন্ধিকালের একজন ছেলে বা মেয়ের মস্তিষ্কের বিকাশের ক্ষেত্রে নানারকম পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। কৈশোরে মানুষের মস্তিষ্ক খুব উচ্চ পর্যায়ে কাজ করে। যেমন- বিমূর্ত চিন্তাভাবনা, সিদ্ধান্ত নেওয়া, জীবনের লক্ষ্য স্থির করা এবং মতামত দেওয়ার ক্ষমতা তৈরি হতে থাকে। এক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে আপনি নীচের বদলগুলো লক্ষ্য করতে পারেন:

  • এই বয়সের মেয়েরা বিমূর্ত চিন্তাভাবনা করে এবং ঠিক-ভুলের তফাৎ বুঝতে বারবার প্রশ্ন করে। এভাবে তার নিজস্ব ব্যক্তিসত্তা ও মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে।
  • তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা এই সময়ে ততটা বিকশিত না হলেও, সে কোন একটা কাজের ফলাফল কী হতে পারে সে বিষয়ে বুঝতে ও শিখতে চেষ্টা করে।
  • সে তার জীবনের লক্ষ্য স্থির করে নিয়ে এবং সেই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাভাবনা শুরু করে, যেমন – নিজের পছন্দসই কেরিয়ার, হবি বা শখ প্রভৃতি সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা করতে থাকে।

যদি অভিভাবক হিসেবে আপনি আপনার বয়ঃসন্ধিকালীন মেয়ের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশের প্রক্রিয়া ভালভাবে বুঝতে পারেন, তাহলে তার পরিবর্তনগুলো গ্রহণ ও মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনি আপনার মেয়েকে সাহায্য করতে পারবেন।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleযেসব কারণে বুদ্ধির সমস্যা তৈরি হয়
Next articleপিতামাতার প্রতি জমে থাকা ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলুন কিছু সহজ উপায়ে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here