নালন্দা স্কুল শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বেশি ভাবছে: বহ্নি বেপারী

0
76
কোয়ারেন্টাইনে যেমন কাটছে শিক্ষকদের দিন
কোয়ারেন্টাইনে যেমন কাটছে শিক্ষকদের দিন

সারা পৃথিবীজুড়ে কোভিড-১৯ এর ভয়াল থাবায় স্থবির হয়ে আছে জনজীবন। ঘর থেকে বাইরে বের হওয়া বন্ধ। অনেকে অনেকভাবে কাটাচ্ছেন তাদের দিন। শিশুদের নিয়ে মুখর থাকতো যেসব শিক্ষকদের স্বাভাবিক দিন, ঘরবন্দী দিনগুলি তাদের কেমন কাটছে জানতে কথা হয় ছায়ানটের সংস্কৃতি-সমন্বিত সাধারণ শিক্ষা কার্যক্রম নালন্দা এর শিক্ষক এবং জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক বহ্নি বেপারী এর সাথে।
• এখনতো স্কুল বন্ধ। স্কুল বন্ধ থাকার এই সময়টাতে কি করছেন? কিভাবে সময় কাটছে?
: সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী স্কুল বন্ধ। কিন্তু অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে। আমাদের স্কুলেও অনলাইন ভিত্তিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তাই বাসায় বসে থেকেই অনলাইনে কাজ করতে হচ্ছে। অনলাইনে কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা অনেকেরই নেই। তাই স্কুল ছুটির ঘোষণা দেওয়ার পরেও দুইদিন স্কুল খোলা রেখে শিক্ষাকর্মীদের অনলাইনে কাজ করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। অনলাইনে বিভিন্ন ধরণের কাজ চালু রয়েছে। লাইভে ক্লাস নেওয়া কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হবে। বর্তমান যে পরিস্থিতি তা স্বাভাবিক হতে কয়েকমাস লেগে যেতে পারে। এতদিন কোন প্রতিষ্ঠান বা স্কুল বন্ধ রাখা কঠিন কাজ। পড়াশোনার বিষয়টি চালিয়ে নেওয়ার চেয়েও নালন্দা স্কুল শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বেশি ভাবছে। শিশুদের এই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়া সহজ নয়। তাই আমরা যোগাযোগ রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। প্রচুর বাড়ির কাজ দেওয়া হচ্ছে ও নেওয়া হচ্ছে। তবে যোগাযোগ করার প্রধান উদ্দেশ্য বাচ্চা কতটুকু পড়াশোনা করছে তা নয়, বরং সে কেমন আছে, তার সময় কিভাবে কাটছে, সে মানসিকভাবে সুস্থ আছে কিনা, এ বিষয়গুলো জানা জরুরী। এসময় যোগাযোগ ব্যবস্থার একমাত্র মাধ্যম প্রযুক্তি। ক্লাস নেওয়া থেকে শুরু করে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা সবই প্রযুক্তির সাহায্যে করা হচ্ছে। ফলে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রতি শিশু আসক্ত হচ্ছে কিনা এটাও একটা দুঃশিন্তার কারণ। আমার নিজেরও তিনজন বাচ্চা। তাদের সাথে যতই সময় কাটাতে চেষ্টিা করি, তবুও তারা অস্থির হয়ে উঠছে, পড়াশোনা করছে না। বিশেষ করে আমার বড় ছেলে বাসায় স্থির হয়ে থাকতে চাইতো না একদমই। সে প্রায়ই চিৎকার করছে, কান্না করছে। এ অভিজ্ঞতার সাথে আমরা কেউ পরিচিত নই। সময়গুলো আস্তে আস্তে সবার জন্যই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
• অনলাইনে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন মনে হচ্ছে?
:এই বিষয়টিতে অভ্যস্ততা হঠাৎ করেই হয় না। আমার একটা মেজর অপারেশন হওয়ায় স্কুল বন্ধ হওয়ার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই ছুটিতে আছি। এত লম্বা ছুটিতেও তেমন কোন কাজ করা হয়নি। পুরোনো যেই কাজগুলো গুছানো ছিল সেগুলোই বাচ্চাদের করতে দিচ্ছি। ঘরে বসে অস্থির ও অনিশ্চিত একটা সময়ে শান্ত ভাবে কাজ করা হয়ে উঠছে না।
• অনলাইনের মাধ্যমে বাচ্চাদের বাসায় যে কাজগুলো করতে দেওয়া হচ্ছে সেগুলো তারা ঠিকভাবে করছে কিনা তা কিভাবে খেয়াল রাখছেন?
:বাচ্চাদেরকে গুগল ক্লাসরুমের আওতায় আনা হয়েছে। বিশেষ করে মাধ্যমিকের (ষষ্ঠ-দশম) বাচ্চাদের জন্য পুরোপুরি ক্লাসরুম চালু হয়ে গিয়েছে। ছোটদেরও ক্লাসরুম চালু হয়েছে। কিন্তু শিশুরা এখনো পুরোপুরি যুক্ত হয়নি। বাচ্চাদের ক্লাসরুমের মাধ্যমেই কাজ দেওয়া হচ্ছে। বাচ্চারা কাজ করে ছবি তুলে পাঠাচ্ছে। অনেকে অনলাইনে বসেই কম্পোজ করছে। কিছুদিনের মধ্যেই লাইভে ক্লাস নেওয়া শুরু হবে।
• বর্তমানে শিক্ষাপদ্ধতির যে পরিবর্তন হয়েছে অর্থাৎ অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম শিশুদের মনে চাপ সৃষ্টি বা মানসিকভাবে প্রভাব ফেলবে কি?
:মানসিকভাবে প্রভাব ফেলবে বলে আমার মনে হয় না। বেশিরভাগ শিশুর জীবনে স্কুল এবং বন্ধুবান্ধবই সবকিছু। ধীরে ধীরে তাদের কাছে বাড়ির গূরুত্ব কমে যায়। এই ক্লাসগুলোর মাধ্যমে তাদের মধ্যে যুক্ততা তৈরি হচ্ছে। বাসায় থেকে রোজ পড়াশোনা করা, যেখানে সময়টাও অনেক বেশি, বাচ্চাদের জন্য বিষয়টা মুশকিল। কিন্তু স্কুলের সঙ্গে যুক্ত থাকা বা বন্ধুদের সঙ্গে যুক্ত থেকে পড়াশোনা বা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, এই বিষয় বাচ্চাদেরকে অনেকটা স্বস্তি দিচ্ছে।
• অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকলেও স্কুলের অন্যান্য সব স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। শিশুরা যখন স্বাভাবিক স্কুল জীবনে ফিরে আসবে তখন তাদের মধ্যে দূরুত্ব সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
:পড়াশোনার থেকে যতটা না দূরুত্ব হবে তার থেকেও শিশু থেকে শিশুতে বেশি দূরুত্ব হবে। কোন কোন বাচ্চা নিজে থেকেই পড়াশোনা করে বা এই পরিস্থিতিতে পড়াশোনাকেই স্বস্তির বিষয় হিসেবে দেখছে। আগের থেকেও বেশি যত্ন করে লিখছে। সুন্দর করে ছবি আঁকছে। এতে তার সময়টা কেটে যাচ্ছে। আবার কোন বাচ্চা পড়াশোনার ধারে কাছেও যাচ্ছে না। তাই দেখা যাবে, ৫০% শিশু পড়াশোনায় পিছিয়ে যাবে। আবার ৫০% শিশু পড়াশোনায় স্কুলের থেকেও এগিয়ে যাবে। তখন শিশুদের মধ্যে পড়াশোনার ভিত্তিতে দুটো দল তৈরি হবে।
• এধরণের পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য এখন থেকেই কী করণীয় বলে মনে করেন?
:এবিষয় নিয়ে তেমনভাবে এখনও পরিকল্পনা হয়নি। অধিকাংশ শিক্ষাকর্মী বলছেন, ৫০% বাচ্চারা কাজ করছে আর বাকী ৫০% বাচ্চারা কাজ করছে না। এক্ষেত্রে যেসব বাচ্চারা কাজ করেনি, তাদের দুইদিন সময় দিয়ে যারা কাজ করেছে তাদের আগের কোন বিষয় পুনরায় পড়তে দেওয়া যেতে পারে। তবে অভিভাবকরা এক্ষেত্রে দ্বিমত প্রকাশ করছেন। যারা কাজ করেনি তাদের জন্য যারা কাজ করেছে তারা কেন পিছিয়ে থাকবে। তখন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নালন্দা স্কুলের উদ্দেশ্যকে মনে করিয়ে দিতে হবে। নালন্দা সবসময় একটা দলে চলবে। যে দল একসঙ্গে পা ফেলবে একসঙ্গে আগাবে। যারা ভালো করছে তাদের নিয়ে এগিয়ে যাবো, যারা পিছিয়ে পরেছে, তারা পরে থাকবে, এই কাজটি কখনো নালন্দায় হবে না। বরং চেষ্টা করতে হবে সবাইকেই যেন একটা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। যে বাচ্চা পড়াশোনায় এগিয়ে আছে, সে হয়তো একটা সিনেমা দেখে বা গল্পের বই পড়ে সময় কাটাতে পারে। সেই সময়ে যারা কাজ করেনি তারা যেন মন দিয়ে বা চাপ নিয়ে কাজটা করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অনলাইনে যখন লাইভে ক্লাস নেওয়া হবে তখন যেসব বাচ্চারা পিছিয়ে পরছে তাদের আলাদা সময় দিয়ে, কথা বলে কাজগুলো করাতে হবে।
• অভিভাবকদের সাথে বাচ্চাদের বিষয়গুলো নিয়ে কী সবসময় যোগাযোগ করা হয়? যে বাচ্চারা পড়াশোনা করছে না, বা যে বাচ্চারা পড়াশোনা নিয়েই আছে- এ বিষয়গুলো অভিভাবকরা কিভাবে নিচ্ছেন?
:অভিভাবকদের সাথে নালন্দার যোগাযোগ তুলনামূলকভাবে সবসময়ই ভালো। এখন যোগাযোগ আরো ভালো। পড়াশোনা করছে না এমন অভিযোগ অনেকেই করেন তবে পড়াশোনা নিয়েই আছে এধরণের অভিযোগ কেউ করেন না। অনেকেই অভিযোগ করেন এবং তারা যে বলেছেন তা বাচ্চাকে জানাতে নিষেধ করেন।
• অনেক বাবা-মা এসময় বাচ্চাকে খুব কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন। তারা হয়তো এমন অনেক অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন যা তারা আগে কখনো খেয়াল করেন নি। বিশেষ করে যারা কর্মজীবী বাবা-মা তারা অনেক নতুন অভিঙ্গতার সম্মুখীন হতে পারেন। বাচ্চারা বাসায় বসে ক্লাস করছে বা অন্যান্য যেসব কাজ করছে তাদের কাছে তার অনেক কিছুই নতুন বা অন্যরকম লাগতে পারে। এবিষয়গুলো নিয়ে তারা কী বলছেন?
: যারা বয়সে ছোট শিশু, আট থেকে নয় বছর বয়স, সেসব বাচ্চার অভিভাবকরা তাদের বাচ্চার কাজকর্ম দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন। বাচ্চাদের লেখা, ছবি আঁকা, চিন্তা করার ক্ষমতা দেখে তারা অবাক হচ্ছেন। কিন্তু যে বাচ্চারা বয়সে একটু বড়, বয়ঃসন্ধিকাল চলছে, তাদের বাবা-মার অভিজ্ঞতা আবার উলটোই বলা যায়। কারণ আগে বাবা-মার সাথে বাচ্চা একটা নির্দিষ্ট সময় কাটাতো। সে সময়টা ভালো-মন্দ মিলিয়ে কেটে যেত। কিন্তু এখন পুরোটা সময় একসাথে কাটাতে হচ্ছে। তাই বাচ্চা বয়সের জন্য নিজের মধ্যে যে অস্থিরতা কাজ করে তা লুকোতে পারছে না। খেলা-ধুলা বা ছুটাছুটির মাধ্যমে যে স্বস্তি পাবে তারও উপায় নেই। তাই বাবা-মার সঙ্গে অনেক বিষয়েই রাগারাগি হচ্ছে। প্রায়ই বাচ্চারা বাবা-মার বিরুদ্ধে নালিশ করছে। অভিভাবকরাও ফোনে অভিযোগ করছে যে কথা শোনে না। যেহেতু অভিভাবকরাও একটা অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, বাচ্চাদের আচরণে তারা আহত হচ্ছেন, আরো অস্থির বোধ করছেন।
• অভিভাবক ও বয়ঃসন্ধিকালের শিশুদের মধ্যে এসময়ে যে দ্বন্দ বা দূরুত্ব সৃষ্টি হচ্ছে-এই অবস্থায় কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
: কয়েকদিন আগে আমি এই বিষয়গুলো নিয়ে প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলেছিলাম। মনের খবরে যেহেতু বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লাইভে আলোচনা করা বা কোন বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়, তাই মনের খবরের সাথে যোগাযোগ করে যদি এমন ব্যবস্থা করা যায়, যেখানে আমাদের বিষয়গুলো বা সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি শিক্ষাকর্মী ও অভিভাবকরা তাদের সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবেন।

Previous articleএবারের পহেলা বৈশাখ ও কোভিড-১৯
Next articleমানসিক চাপের কারণে পড়তে পারে চুল: সমাধানে যা করতে পারেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here