“করোনা এসেছে, ভালো হয়েছে। সবাই মরে সাফ হব”।
এভাবেই একজন পেশেন্ট তার চিন্তা প্রকাশ করছিলেন। ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে, রোগী নিজেও এই সবাইয়ের অন্তর্ভুক্ত হতে চায়। এটি কিন্তু স্বেচ্ছামৃত্যুর পরোক্ষ চিন্তা (passive suicidal thought)। আত্মহত্যার বিষয়টি এভাবেই পরিণতি পায়। প্রথমে আত্মহত্যার ধারণা তৈরি হয়, তারপর পরোক্ষ চিন্তা খেলা করে, এরপর সক্রিয় চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায়, তারপর পরিকল্পনা করে, তারপর আত্মহত্যার প্রচেষ্টা চালায়, অবশেষে মৃত্যু হয় অথবা আহতাবস্থায় বেঁচে যায়। বারবার প্রচেষ্টা করতে থাকে।
মানুষ মূলত দুটি কারণে আত্মহত্যা করে-
১. পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে
২. ক্ষণিক আবেগের কারণে
বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের এই ক্রান্তিলগ্নে ক্ষণিক আবেগের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে মানুষ স্বেচ্ছামৃত্যুর দিকে ঝুঁকে যেতে পারে। স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নেয়ার নেপথ্যে যেগুলো ভূমিকা রাখতে পারে-
১. সামাজিক দূরত্বের কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়া, একাকীত্ব বোধ করা।
২. তীব্র দুশ্চিন্তা
৩. আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা, বেকার হয়ে পড়া, নিজেকে অথর্ব মনে করা
৪. আক্রান্ত রোগীর ভোগান্তি চরমে পৌঁছলে কিংবা প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট অসহনীয় হয়ে উঠলে
৫. প্রিয়জন বিয়োগের ব্যথায় কাতর হলে
৬. ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরাশ হয়ে পড়
৭. মহামারীর আপাত কোন সমাধান না পেয়ে
৮. নিজেকে ইনফেকশন সোর্স হিসেবে ব্যবহার হতে না দেয়ার খোঁড়া যুক্তিতে
৯. সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও করোনা আক্রান্তের কারণে স্টিগমাটাইজ হয়ে
১০. পূর্বাপর অন্য মানসিক রোগ যেমন- বিষণ্ণতা, সিজোফ্রেনিয়া, পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার,মাদকাসক্তি প্রভৃতির কারণে।
সুতরাং আপনার নিজের মধ্যে, প্রিয়জন, পরিজন, বান্ধব কিংবা পরিচিতদের মধ্যে কোন একটি ঝুঁকি দেখলে তার খোঁজ নিন, খোলামেলা কথা বলুন। হয়ত আত্মঘাতী চিন্তা সেখানেই ঘাঁপটি মেরে লুকিয়ে আছে।
নিচের কয়েকটি লক্ষণ খোঁজ করুন-
১. স্বেচ্ছামৃত্যুর কোন চিরকুট বা ডায়েরি লিখছেন কিনা
২. সম্পত্তির উইল বা দান, ভাগাভাগি করতে চান কিনা,
৩. প্রিয় বস্তু, সম্পদ বা পোষ্য অন্যকে উপহার দিয়ে দিচ্ছেন কিনা
৪. মৃত স্বজনদের ব্যাপারে বেশি বেশি আলাপ করছেন কিনা
৫. অত্যধিক মৃত্যুভয় কিংবা মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে ভাবছেন কিনা
৬. বিষণনতার অন্যান্য লক্ষণ প্রকট কিনা
অনেকে মনে করেন আত্মহত্যা নিয়ে কথা বললে হিতে বিপরীত হতে পারে। বিষয়টি সত্য নয়। বরং সতর্ক হয়ে একজনকে আমরা বাঁচাতে পারি। বিশ্ব ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে গেলে আর্থসামাজিক কারণেই স্বেচ্ছামৃত্যুর হার বাড়বে। তাই দ্রুত মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। বাঁচবে একটি জীবন। আবাদ হবে মানবতা।
একটু খেয়াল করুন-
আপনি আসলে কি খতম করতে চান?
আপনার জীবন?
নাকি
আপনার হতাশা?
রোগের ভোগান্তি?
অর্থনৈতিক ক্ষতি?
অত্যধিক দুশ্চিন্তা?
একটি নিক্তি কল্পনা করে জীবনের বিপরীতে বাকি সবগুলোকে একত্রে তুলে দেখুন তো?
নিশ্চয় জীবন বেশি ওজনদার। অবশ্যই জীবনের মূল্য বেশি। এ পৃথিবীতে আপনার প্রয়োজন কখনো ফুরোবে না। সমস্যা থাকলে তার সমাধান আছে। স্বেচ্ছামৃত্যু কোন সমাধান নয়। করোনা যুদ্ধে আপনি একা নন। পুরো বিশ্ব। ৮০০+ কোটি মানুষ।
লেখক: ডা. বাপ্পা আজিজুল (রেসিডেন্ট, সাইকিয়াট্রি)