মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করছে সামাজিক মাধ্যম!

0
40
মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করছে সামাজিক মাধ্যম!
মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করছে সামাজিক মাধ্যম!

এক যুগ আগেও যেখানে মানুষ ফোনে আলাপ, ই-মেইল বা ফ্যাক্সের মাধ্যমে দূর-দূরান্তের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করত, আজ সে জায়গা অনেকাংশে দখল করে নিয়েছে সোস্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির অংশ হিসেবে বহুল ব্যবহূত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্যে রয়েছে ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, লিংকডইন ইত্যাদি।

কয়েক বছর আগে থেকেই গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হতাশার সঙ্গে যুক্ত, বিশেষত কিশোরীদের মধ্যে। তবে নতুন এক সমীক্ষায় দেখা গেছে বিশেষজ্ঞরা যতটা ভাবছেন, তার চেয়েও সমস্যাটি আরো জটিল হতে পারে।

দ্য ল্যানসেট চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডলসেন্ট হেলথ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাটিতে যুক্তরাজ্যের ১৩ থেকে ১৬ বছর বয়সী প্রায় ১০ হাজার কিশোর-কিশোরীর সাক্ষাত্কার নেয়া হয়। গবেষকরা দেখেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে, তাদের উত্ত্যক্ত করার ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে এবং তাদের ঘুম ও শারীরিক অনুশীলন হ্রাস করে। এর ফলে তাদের মধ্যে হীনম্মন্যতা, দুশ্চিন্তা, অশান্তি ও হতাশা তথা মানসিক সমস্যা সৃষ্টি করছে।

গবেষণাটির সঙ্গে জড়িত ইউসিএল গ্রেট অরমন্ড স্ট্রিট ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথের গবেষক রাসেল ভিনার এক বিবৃতিতে বলেছেন, আমাদের ফল দেখায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিজে ক্ষতির কারণ নয়, তবে নিয়মিত এগুলো ব্যবহার ঘুম ও ব্যায়ামের মতো মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করা কার্যকলাপগুলোতে বাধা সৃষ্টি করে এবং ক্ষতিকারক ক্রিয়াকলাপে কিশোর-কিশোরীদের সংস্পর্শ বাড়িয়ে তোলে, বিশেষ করে সাইবার-উত্ত্যক্তের মতো নেতিবাচক কার্যক্রমে।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিজেই মানসিক সমস্যা সৃষ্টির জন্য দায়ী না-ও হতে পারে। বরং এটা কিশোরীদের ঘুমের গুণমান ও ব্যায়ামের অভ্যাস হ্রাস করে দেয় এবং সাইবার-উত্ত্যক্তের মুখোমুখি করে। আর এ কারণেই মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সমস্যাগুলো তৈরি হয়।

গবেষণাটি বিষয়ে যুক্তরাজ্যের সুরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের প্রভাষক বব প্যাটন বলেছেন, এর অর্থ এই নয় যে, কেবল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার হ্রাস করলেই এ সমস্যাগুলো দূর হয়ে যাবে। বরং সাইবার উত্ত্যক্তের মতো ঘটনাগুলো কমাতে এবং ভালো ঘুম ও ব্যায়ামের অভ্যাসকে উত্সাহিত করে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি কমাতে প্রয়োজনীয় কৌশলগুলো তৈরি করা যেতে পারে।

এদিকে ছেলেদের ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব অন্যান্য কারণে বলে মনে হচ্ছে। সুতরাং ছেলেদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব নিয়ে আরো গবেষণা প্রয়োজন, বলছেন সমীক্ষাটির গবেষকরা।

২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কিশোর-কিশোরীদের সাক্ষাত্কারের ভিত্তিতে গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়েছিল। কিশোর-কিশোরীরা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার ও স্ন্যাপচ্যাটসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহারের তথ্য জানাত। প্রতিদিন তিনবারের বেশি এগুলো ব্যবহার করলে ‘ঘন ঘন ব্যবহার’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গবেষকরা লক্ষ করেছেন ওয়েবসাইট বা অ্যাপগুলোতে অংশগ্রহণকারীরা কতটা সময় ব্যয় করছে, তা তারা তুলে আনেননি, যা গবেষণাটির সীমাবদ্ধতা।

গবেষকরা কিশোর-কিশোরীদের মানসিক সমস্যা এবং তাদের ব্যক্তিগত সুস্থতা, জীবনের তৃপ্তি, সুখ ও উদ্বেগের মতো বিষয়গুলো নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। গবেষকরা আবিষ্কার করলেন, ঘন ঘন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করা কিশোর-কিশোরী উভয়ই বৃহত্তর মানসিক সংকটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিশোরীদের মধ্যে এ প্রভাবগুলো স্পষ্ট ছিল, তারা প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো চেক করেন এবং তাদের মনস্তাত্ত্বিক সংকট অনেক বেশি।

মেয়েদের এ মনস্তাত্ত্বিক সংকটের ৬০ শতাংশই খারাপ মানের ঘুম এবং সাইবার উত্ত্যক্তের জন্য দায়ী। এক্ষেত্রে ব্যায়াম বা শারীরিক ক্রিয়াকলাপ হ্রাস কম ভূমিকা পালন করে। তবে ছেলেদের ক্ষেত্রে ঘন ঘন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের প্রভাবগুলো কেবল ১২ শতাংশ হতে পারে।

এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্ত। মাত্র কয়েক মাস আগে কানাডায় একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঘন ঘন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার বয়ঃসন্ধিকালে হতাশাজনক লক্ষণগুলোর সঙ্গে যুক্ত। এ অধ্যয়নের মাধ্যমে সমস্যাটি ভালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

এখানেও সেই একই বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, সমস্যাগুলো সরাসরি সামাজিক মাধ্যমগুলো সৃষ্টি করছে না, বরং এগুলো স্বাস্থ্যকর ঘুম ও ব্যায়ামের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে এ সমস্যাগুলো তৈরি করছে।

গবেষণাটির ফলাফলের প্রতিক্রিয়ায় বেলজিয়ামের ঘেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান ডিএসমেট এক বিবৃতিতে বলেছেন, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো যদি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা ও সাইবার উত্ত্যক্তের মতো ঘটনাগুলো কমিয়ে আনতে পারে, তাহলে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইতিবাচক প্রভাবগুলো আরো সমর্থন করা যেতে পারে।

এর আগে ২০১৭ সালে রয়্যাল সোসাইটি অব পাবলিক হেলথ ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সী দেড় হাজার কিশোর-কিশোরীর ওপর একটি জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, স্ন্যাপচ্যাট ও ইনস্টাগ্রাম তাদের মনে সবচেয়ে বেশি হীনম্মন্যতা এবং দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করে। ১০ জনের মধ্যে সাতজন বলেছে, ইনস্টাগ্রামের কারণে তাদের নিজেদের দেহ নিয়ে মন খারাপ হয়েছে। তরুণ-তরুণীদের অর্ধেকই বলেছে, ফেসবুকের কারণে তাদের মানসিক দুশ্চিন্তা ও অশান্তি বেড়ে গেছে।

দুই-তৃতীয়াংশ উত্তরদাতা বলেছে, ফেসবুকের কারণে সাইবার বুলিং বা অনলাইনে অপমান-হয়রানি বা উত্ত্যক্ত করার প্রবণতা আরো গুরুতর আকার নিয়েছে।

সূত্র: সিএনএন

Previous articleসন্তানের সাফল্যে বাবা-মায়ের ভূমিকা
Next articleদুশ্চিন্তা দূর করার সহায়ক কিছু উপায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here