জনপ্রিয় আবৃত্তি অ্যালবাম ‘মিথিলা’ শোনেননি এরকম মানুষের সংখ্যা খুব কমই আছে। আজও মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয় নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় এই অ্যালবামের বিভিন্ন পঙ্ক্তি। কন্ঠের মায়ামাখা অভিব্যক্তি আর সাবলীল উচ্চারণ দিয়ে ‘মিথিলা’ সহ বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় অ্যালবাম উপহার দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্যতম গুনী বাচিক শিল্পী মেহেদী হাসান। মনের খবর ‘তারকার মন’ বিভাগে কথা বলেছেন আত্মপ্রচার বিমুখ এই মহতারকা। পাঠকদের জন্য সেখান থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা হল
মনের খবর: আপনার আবৃত্তির শুরু সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
মেহেদী হাসান: আমার আবৃত্তির শুরু ছোটবেলায় স্কুলে পড়াকালীন সময়ে। তখন কাজী আরিফ এর ‘পত্রপূট’ নামে একটি অ্যালবাম বের হয়েছিল, সেটি শুনতাম। শুনতে ভালো লাগত। কাজী সবস্যাচী’র ক্যসেট শুনতাম। সেই শোনা থেকে একটা ভালো লাগা ছিল আর ছোটবেলা থেকেই আবৃত্তি ছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলাম; অভিনয়, গান করতাম। আর পারিবারিকভাবে একটা আবহ পেয়েছিলাম, আমার বাবা-চাচারাও অভিনয় করতেন। সবমিলে ভালো লাগা থেকেই নিজের মত চর্চা করতাম।
মনের খবর: আবৃত্তি আপনার মনের উপর কিরকম প্রভাব ফেলে?
মেহেদী হাসান: আমার ভালো লাগার উপকরণগুলির মধ্যে কবিতা এবং আবৃত্তি অন্যতম। আমার কবিতা পড়তে ভালো লাগে, আবৃত্তি করতে ভালো লাগে। এই ভালো লাগাটা আমার মনকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে।
মনের খবর: আপনার সবচেয়ে ভালো লাগা আর মন্দ লাগার বিষয়গুলি নিয়ে আরেকটু যদি বলতেন?
মেহেদী হাসান: মানুষ আমার সবচাইতে প্রিয় বিষয়। প্রকৃতি আমার প্রিয় বিষয় এবং কবিতাও আমার প্রিয় বিষয়। যেহেতু এগুলি আমার প্রিয় বিষয় তাই এসবের মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পাই। আর খারাপ লাগার বিষয়গুলিও মানুষের মধ্যেই আছে। সেগুলি হল-মানুষের মিথ্যাচার, মানুষের প্রতারণা, মানুষের অন্যান্য অন্ধকার দিকগুলি।
মনের খবর: আপনার কখনও মন খারাপ হয়?
মেহেদী হাসান: আমার আসলে বেশিরভাগ সময়ই মন খারাপ হয়। মন খারাপ বিষয়টি আমার মধ্যে প্রচন্ড পরিমাণ প্রভাব বিস্তার করে। তবে সেটি এমন নয় যে, শুধু আমার ব্যক্তিগত কারণে মন খারাপ হয়। সামগ্রিকভাবে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা মিলে আমার প্রচন্ড মন খারাপ হয়। যেমন; কিছুদিন আগে চকবাজারের আগুনে আমাদের আবৃত্তির দুটি মেয়েসহ অনেক মানুষ মারা গেল, বনানীতে অনেক মানুষ মারা গেল, তারও কিছুদিন আগে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বাচ্চাদের আন্দোলন হল; সেটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা হল। এরকম প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রচন্ড রকমে আমার মন খারপ করে দেয়।
মনের খবর: মন খারাপ হলে তা ভালো করার জন্য কি করেন?
মেহেদী হাসান: মন খারাপ হলে আমি আসলে সংশ্লিষ্ট ঘটনার কারণ খোঁজার চেষ্টা করি। সেগুলি নিজে নিজে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি। কারণগুলি বুঝতে পারলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যাই। আর আমি প্রচুর পরিমাণে গান শুনি। মন খারাপ হলেও তা ভালো করার জন্য আমার ক্ষেত্রে গান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া কবিতা ও সাহিত্য পাঠ করি। দেখা গেল একটু অবসাদগ্রস্ত আছি বা বিষণ্ণতায় ভুগছি; তখন পাঠের ভেতর মনোনিবেশ করতে পারলে সেই জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে পারি।
মনের খবর: কখনও কি মনে হয়েছে যে মানসিকভাবে অসুস্থ আছেন?
মেহেদী হাসান: আমার মনে হয় যে আমরা সবাই কম বেশি মানসিকভাবে অসুস্থ। আমাদের নিজস্ব কিছু ধ্যান ধারণা বা কাঠামো থাকে, আমরা আসলে সেগুলিকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হই। সেই কাঠামোগুলির কোনোটা নেগেটিভ আর কোনোটা পজেটিভ থাকে। এই নেগেটিভ ব্যাপারগুলিও মানুষকে কোন না কোন ভাবে প্রভাবিত করে। এই যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ঘটে, এগুলি তারই প্রভাব বলে আমার মনে হয়।
মনের খবর: রাগ এবং দুঃখবোধ ব্যাপারগুলি আপনার মধ্যে কিরকম আছে?
মেহেদী হাসান: আমার মধ্যে রাগ এবং দুঃখবোধ দুটোই একসময় প্রচন্ড পরিমাণে ছিল। এখন সময়ের বির্বতনে কিংবা বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। যৌবনের শুরুর দিকে প্রচন্ড রাগ হত; কোন কিছুর পরোয়া করতাম না, হয়ত সেটা যৌবনেরই ধর্ম ছিল। এখন সময়ের পরিবর্তনে রেগে যাওয়ার মত কোন ঘটনা ঘটলে সেখানে আমার কি ভূমিকা ছিল সেটা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি। যার আচরণের কারণে আমার রাগ হচ্ছে, তিনি ওই আচরণ কেন করছেন সেটি বোঝার চেষ্টা করি। সেগুলি যখন বুঝতে পারি তখন রাগ কমে যায়। দুঃখবোধের ব্যাপারটিও অনেকটা সেরকম। প্রতিটা মানুষের একটা সীমা আছে, সেই সীমাটুকু না জানার কারণেই বোধহয় মানুষের ভেতরে দুঃখবোধটা কাজ করে। মানুষ যদি জানে বা বুঝতে যে তার প্রাপ্র্য কতটুকু অথবা কতটুক যেতে পারে, তাহলে তার না পাওয়ার দুঃখটা তীব্র হবে না। আমার মনে হয় মানুষের অসীম চাহিদা, সেই চাহিদার অপূর্ণতা থেকেই আসলে দুঃখবোধের সৃষ্টি হয়। আমার ভেতরে চাহিদা এখন অনেক কম। আমার মনে হয় আমি অনেক বেশিই পেয়ে গেছি।
মনের খবর: আপনার ভেতরে স্মৃতিকাতরতা আছে কিনা আর জীবনের কোন সময়কে সবচেয়ে বেশি অনুভব করেন?
মেহেদী হাসান: স্মৃতিকাতরতা আমার ভেতরে কাজ করে না। আমি বর্তমান নিয়ে ভব্যিষতের দিকে হাঁটতে পছন্দ করি। কখনও কখনও পেছনের কথা মনে পড়ে, শৈশবের কথা মনে পড়ে, কৈশরের কথা মনে পড়ে, যৌবনের কথা মনে পড়ে; তবে সেটা ঠিক কাতরতা নয়। এমনও মনে হয় না যে শুধু ওই সময়টাই ভালো ছিল। প্রতিটা সময়েরেই একটা আলাদা মাধুর্য আছে, প্রতিটা বযসেরই সৌন্দর্য আছে; সেই সৌন্দর্যকে যদি আমরা উপলব্ধি করতে চায় তাহলে প্রতিটা সময়েই প্রাণবন্ত থাকাটা শ্রেয়। আর অনুভবের কথা বলতে গেলে আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সময়টাকেই সবচেয়ে অনুভব করি। সেসময় আমি রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতাম। সে সময় এগুলি নিয়ে অনেক স্বপ্ন কাজ করত। সেসময় আমাদের দেশে প্রায়ই বড় বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাস হত, আমরা আক্রান্ত মানুষদের সাহায্য করার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করতাম। ডাকসু`তে তখন হাতে তৈরি খাবার স্যালাইন বানানো হত, সেগুলি করতাম। বাড়ি বাড়ি গিয়ে রুটি তুলতাম, কাপড় তুলতাম। তখন এগুলি করতেই ভালো লাগত। তারপর সেসময়ে স্বৈারাচার বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয় ছিলাম, সেময়গুলিকে আমার প্রখর তীব্র সময় বলে মনে হয়।
মনের খবর: ভালোবাসা ব্যাপারটিকে কিভাবে দেখেন? আপনার ক্ষেত্রে ভালোবাসা কিরকম এসেছে?
মেহেদী হাসান: আমি প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছি। ভালোবাসা প্রাপ্তিতে আমার অপূর্ণতা নেই। অনেকে অনেকভাবে দেখেন, সেটি দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। যাকে ভালোবাসলেন তাকে বিয়ে করলেন, ঘর-সংসার করলেন, বাচ্চা হল, বুড়ো হলেন, মরে গেলেন- সেটা একধরনের চিন্তা। আমার দৃষ্টিভঙ্গিটা আসলে ওরকম নয়- আমি আমার ভালো লাগা গুলিকে ভালোবাসি, আমি আমার ভালোলাগাকে প্রাধান্য দিই। আমার জায়গা থেকে আমি বলতে পারি, ভালোলাগাকে প্রধান্য দেওয়াই ভালোবাসা। আমি যাকে ভালোবাসি তার রুপ নিয়ে, চোখ নিয়ে, চুল নিয়ে, তার হাঁটা চলা, কথা বলা সবকিছু আমি আমার রঙ দিয়ে সাজাই। এবং এই সাজানোর মধ্য দিয়েই সেটা আরো সৌন্দর্যমন্ডিত হয়ে ওঠে।
মনের খবর: জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা কিছু আবৃত্তি অ্যালবাম দিয়ে আপনি এখনও ভক্ত শ্রোতাদের হৃদয়ে জায়গা করে আছেন, কিন্তু তারপর আপনার কাছ থেকে সংখ্যার দিক থেকে কম আবৃত্তি পাওয়া গেছে। আবৃত্তি নিয়ে আপনার আগামী দিনের ভাবনা যদি একটু বলতেন?
মেহেদী হাসান: আমি যাই করেছিলাম তা সব নব্বইয়ের পর। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে আমার যা কিছু অ্যালবাম বের হয়েছে। সেই সময়টায় আবৃত্তি নিয়ে এক ধরনের উন্মাদনা ছিল। সেই উন্মাদনা শুধু ক্যাসেট বিক্রি বা মানুষ কিনছে সেরকম না, সেসময়ে আমরা মনপ্রাণ উজার করে আবৃত্তি করতাম। তখন বইমেলাতে আবৃত্তি ক্যাসেট পাওয়া যেত। কিন্তু ১৯৯৮ সালে মেলা কর্তৃপক্ষ সেখানে ক্যাসেট বিক্রি বন্ধ কর দিলেন। তখন থেকেই আবৃত্তি ক্যাসেটের বাজার একটু নামতে শুরু করে। এরপর প্রযুক্তিতে একটা বড় বিপ্লব ঘটে গেল। যার প্রভাবে অডিও শিল্প বিলুপ্তপ্রায়। এটি শুধু আবৃত্তির ক্ষেত্রে নয়, সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও অডিও শিল্পের অবস্থা একই রকম। আমার দিক থেকে বলতে গেলে তখন আমার হাতে সময ছিল তাই তখন আবৃত্তি অ্যালবাম করেছিলাম। পরবর্তী সময়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর আবৃত্তি অ্যালবাম বের করার জন্য পর্যাপ্ত সময় বের করা আমার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আর এখন মানুষের অস্থিরতা বেড়েছে, তারা এখন সংস্কৃতি বিমুখ। তবে আমি আশা করি মানুষ অচিরেই নব্বইয়ের দশকের মত সংস্কৃতিমুখী হবে। আমি আবৃত্তি করি নিতান্তই আমার ভালো লাগার জায়গা থেকে। যখন ভালো লাগে করি, আর আমি সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ আমার শ্রোতাদের কাছে। তারা আমাকে তাদের হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া।
মনের খবর: জীবন নিয়ে আপনার ভাবনা কি?
মেহেদী হাসান: আমি ইদানিং একটু নিয়মিত লেখালেখির চেষ্টা করছি, এটা অব্যাহত রাখার ইচ্ছা রয়েছে। আর একটা ইচ্ছা আমার রয়েছে, সেটি হল; পৃথিবীর অন্যান্য দেশে মূলত আবৃত্তিকার বলতে কিছু নেই। সেখানে কবিরাই তাদের কবিতা শ্রোতাদেরকে পাঠ করে শোনান। আমার ইচ্ছা আমাদের দেশেও এরকম কবিদের আবৃত্তির আসর একটা শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে যাক। এটা আমার একটা চাওয়া।
মনের খবর: এত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেওয়ার জন্য মনের খবর এর পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
মেহেদী হাসান: মনের খবরকেও ধন্যবাদ, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টিতে তারা অনেক কাজ করে যাচ্ছে।