হত্যা এবং মানসিক রোগঃ ক্রাইস্টচার্চ গণহত্যা প্রেক্ষিত

শুক্রবার দিন খবরটা দেখে মনটা খারাপ! সবার আগে আমিতো মানুষ, মানুষ হিসেবে কষ্ট, ভয়, উদ্বিগ্নতা মনটাকে চেপে ধরেছে। এর ভেতরেই কথা চলছে। একটা কথা বার বারই আশেপাশে শুনতে পাচ্ছি “খুনী একজন মানসিক রুগী/ সাইকো/পাগল”।এই কথাটাও একটা বিপজ্জনক কথা। কেন বিপজ্জনক সেটা বলি।
শারীরীক রোগের লক্ষনগুলি অনেকটাই সহজবোধ্য। উদাহরণ হিসেবে বলি কারো জ্বর,সর্দি, কাশি,ব্যথা,ফোঁড়া,রক্তপাত এগুলো বিভিন্ন শারীরীক রোগের লক্ষন যেগুলো থেকে ইতিহাস নিয়ে,পরীক্ষা করে রোগ নির্নয় করা যায়। কিন্তু মানসিক রোগের সমস্যা হচ্ছে বেশির ভাগ লক্ষনই আচরণ দিয়ে প্রকাশিত হয়। আবার শারীরীক লক্ষন দিয়েও মানসিক রোগের প্রকাশ হয়৷ তবে আজকের লেখায় সেটা নিয়ে আর আলোচনা বাড়াচ্ছি না।

যেহেতু আচরণ দিয়ে আবার আমরা মানুষকে যাচাই বাছাই করি সেহেতু অনেক আচরণেই আমরা ঝট করে বলি “মানসিক রোগীর কাজ এটা”। যেই যেই আচরণ আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে আমরা ব্যাখ্যা করতে পারিনা,জনসাধারণের চিন্তাভাবনার সাথে যায়না সেগুলোকে মানসিক রোগ ধরে নেই।এরকম কিছু বিষয় আছে যেগুলোকে মানসিক রোগ হিসেবে প্রচলিত ভাবে বলা হয়, কিন্তু সেগুলো মানুষের স্বাভাবিক আবেগেরই অংশ। হিংসা, ঘৃনা, লোভ, ধ্বংসাত্মক ইচ্ছা এগুলোও মানুষের মনের গঠনের ভেতরেই। এবং এগুলোর উপস্থিতি কারো মধ্যে নাই সেটার দাবীই অযৌক্তিক।

এখন কোন ব্যক্তি একটি কাজ কি মানসিক রোগের প্রভাবে করছে নাকি সুস্থ মস্তিষ্কে কাজটি করছে সেটা যাচাই করা প্রয়োজন। সুস্থ মস্তিষ্কে,ফলাফল কি হবে তা জেনে এবং সেই উদ্দেশ্যে অনেকজন মানুষকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা কে অন্যান্য মানসিক রোগের সাথে মেলানো যায় না।মানসিক রোগ অনেক রকমের। এর ভেতরে যেমন বিষণ্ণতার মতো রোগ আছে তেমন আছে সিজোফ্রেনিয়ার মতো রোগ। এখন মোটাদাগে যখন সব মানসিক রোগী সাইকোপ্যাথ/ সাইকোকিলার এরকম আখ্যা পেয়ে যায় তখন দেখা যায় যার বিষণ্ণতাজনিত, উদ্বিগ্নতাজনিত রোগ তিনি অন্যদের কাছে ভয়ের বিষয় হয়ে দাঁড়ান। আবার সিজোফ্রেনিয়ার যেই রুগীর মধ্যে কোন রকম ধ্বংসাত্মক কাজ করছেনা,তাকেও গড়পড়তা ভাবে ভয়ংকর ধরা হয়। এতে করে মানসিক রুগীদের প্রতি মানুষের ভয়, সন্দেহ বেড়ে যায়, ব্যহত হয় চিকিৎসা।

২০১১ সালের ২২শে জুলাই নরওয়ের অসলোতে এবং উইটাহ দ্বীপে এন্ডার্স ব্রেইভিক ৭৭জনকে বোমা এবং গুলি দিয়ে হত্যা করে। প্রথমে তাকে দুইজন ফরেনসিক সাইকিয়াট্রিস্ট মানসিক রুগী হিসেবে দাবী করলেও পরবর্তিতে আবার পরীক্ষা করে প্রমানিত হয় যে তার মানসিক রোগ ছিলোনা। এটা একটা উদাহরণ শুধু।

আরো অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় এরকম উগ্র হিংসা, জিঘাংসা, নির্দিষ্ট দল-মত-ধর্ম-লিংগ-পেশা এসব সম্পর্কে একপেশে অন্ধ ধারণা মানসিক রোগের চেয়ে বেশি সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে হয়।নিউজিল্যান্ডের এই গনহত্যায় হত্যাকারী অভিবাসীদের প্রতি একটা ক্ষোভ লালন করছে সেটা ইশতেহারে দিয়ে দিয়েছে। ইতিহাসে এরকম মানসিকতার উদাহরণ কম নয়। আদিম কাল থেকেই মানুষ দলবদ্ধভাবে শিকার করেছে, সেই খাবার বাঁচাতে -নিরাপদে থাকতে এক দল আরেক দলের সাথে যুদ্ধ করেছে। এখনও নিজের সম্পদ, নিজের অবস্থান নিশ্চিত করতে ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠে। মনোবিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় দেখা যায় এই ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি তাড়নাজাত হতে পারে ( ইন্সটিংকচুয়াল এগ্রেসন), জমে থাকা ক্ষোভ থেকে হতে পারে (ফ্রাস্ট্রেশন এগ্রেসন), সামাজিক শিক্ষা থেকে আসতে পারে (সোশাল লার্নিং)।

সামাজিক মাধ্যম, গণমাধ্যমে সবখানে ঘৃনার চাষাবাদ এখন হয়েই চলেছে। সারা বিশ্বে রাজনৈতিক হিংসা, কূটচালের কারণে মানুষ অভাবে- অনিশ্চয়তায় ভুগছে। বর্ণবাদ, ধর্মান্ধতার উসকানির কোন কমতি নাই৷ কিন্তু আমাদের সাধারণ মানুষের চোখে সরাসরি যেটা ধরা পড়ে সেটা থেকেই বিচার বিশ্লেষণ করি আমরা। আর মানসিক রোগ নিয়ে আমাদের ধারণা এরকম যে মানসিক রূগীরা নিষ্ঠুর, হিংস্র, ধর্ষকামী। এই ধারণার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে এই গণহত্যাকারীকে ‘মানসিক রুগী/সাইকো’ বলা। কিন্তু এই ধ্বংসাত্মক আচরণের প্রকাশ কে কোন যাচাই বাছাই ছাড়া মানসিক রোগের লক্ষন বলা যায়না। বরং এটা খুব প্রয়োজন যে কেন এই মনোভাব একদল মানুষের মধ্যে গড়ে উঠছে সেটা খুঁজে বের করা।প্রশ্ন করতে পারেন বললে ক্ষতি কি? ক্ষতি হচ্ছে মানসিক রোগের নির্দিষ্ট শারীরবৃত্তীয়, মনোসামাজিক কারণ আছে; চিকিৎসা আছে।

মানসিক রোগীদের বড় একটা অংশ বৈজ্ঞানিক চিকিৎসায় সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। কিন্তু সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখলে, দূরে রাখলে মানসিক রুগীর চিকিৎসার জন্য আগানো যাবেনা।মানসিক রুগীর মধ্যে ও ধ্বংসাত্মক আচরণ থাকে। অযাচিত সন্দেহ, অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতা, প্রচন্ড উদ্বিগ্নতা,ব্যক্তিত্বজনিত সমস্যা, মাদকের প্রভাব, তীব্র বিষণ্ণতা এরকম কারণে মানসিক রুগীদের মধ্যে ধ্বংসাত্মক কাজ দেখা যায়৷ কিন্তু মানসিক অবস্থা যাচাই করে কারণগুলোর চিকিৎসা এগুলো কমাতে/ বন্ধ করতে পারে। তবে মানসিক রুগীর ক্ষেত্রে এই আচরণগুলোর কারণ রোগ থেকে ব্যাখ্যা করা যায় এবং চিকিৎসাও সম্ভব।যেকোন মৃত্যু কষ্টের। আর এরকম অনাকাংক্ষিত, অস্বাভাবিক মৃত্যু কারোই কাম্য নয়। মানসিক রুগীকে চিকিৎসার অযোগ্য মনে করে অনেক সময়ই পারিবারিক, সামাজিক ক্ষেত্রে যেমন দূরে ঠেলে দেয়া হয় তেমন রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও এই চিকিৎসা খাতে ব্যয়টাকে অনেকের কাছে বাহুল্য।এই ধরনের ঘটনা মানসিক রোগের জন্য মনে করলে আরো বেশি নেতিবাচক ধারণা তৈরী হবে।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleমানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় অন্তর্ভুক্ত হলো ‘গেমিং ডিজঅর্ডার’
Next articleভাঙা ডিমের রহস্য উদঘাটন
ডা. সৃজনী আহমেদ
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল, মগবাজার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here