একটি কর্পোরেট সংস্থায় বিজনেস ডেভেলপমেন্ট এগজিকিউটিভ পদে চাকরি করেন সুধা। তাঁর কাজের অঙ্গ হিসেবে প্রায়শই বহু জায়গায় ঘুরতে হয় সুধাকে। সম্প্রতি সুধার মায়ের অ্যালঝাইমার্’স ধরা পড়েছে। তাই সুধা যখন কাজের জন্য বাইরে যাবেন তখন কে মায়ের দেখাশোনা করবেন, এই ভাবনা কিছুতেই সুধার পিছু ছাড়ছিল না।
একজন মানসিক রোগীর পরিচর্যাকারীর দায়িত্বপালন সব সময়েই ঝুঁকিপূর্ণ। আর অ্যালঝাইমার্’স -এর মতো অসুখ, যা একজন মানুষকে ক্রমান্বয়ে অবনতি বা ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়, সেই রোগের পরিচর্যা করা যে কোনও ব্যক্তির পক্ষেই অত্যন্ত মানসিক চাপের কাজ। উপরন্তু কাজের ফলাফলও যে ইতিবাচক হবে, তা-ও বলা যায় না।
একজন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিকে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনতে পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা তথা সাহায্য একান্ত জরুরি। যাইহোক, একজন পরিচর্যাকারী যদি তাঁর দায়িত্বপালন থেকে সাময়িক অব্যাহতি পান, তা তাঁর ব্যক্তিগত কারণের জন্যই হোক বা পেশাদারিত্বের ফলাফল হিসেবেই হয়ে থাকুক না কেন, এক্ষণে প্রচুর সুযোগ-সুবিধা তাঁরা ভোগ করতে সক্ষম হন। রেসপাইট কেয়ার ফেসিলিটিস্ বা বিশ্রামকালীন সুযোগ-সুবিধা— যে নামেই ডাকা হোক না কেন, মূলত এই ব্যবস্থা একজন পরিচর্যাকারীকে তাঁর কষ্টসাধ্য কাজ থেকে কিছু সময়ের জন্য রেহাই দেয়।
রেসপাইট কেয়ার ফেসিলিটি প্রধানত দু’ধরনের হয়ে থাকে— রেসিডেন্সিয়াল এবং নন-রেসিডেন্সিয়াল। কে কোন ধরনের ব্যবস্থা বেছে নেবে, তার সিদ্ধান্ত নির্ভর করে অসুখের গভীরতার উপরে। এছাড়া এহেন পদ্ধতির কার্যকারিতা মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং কাজের সহজলভ্যতার উপরও অনেকাংশে নির্ভরশীল। যদি কোনও ব্যক্তির অসুখ অত্যন্ত গুরুতর হয় এবং তার প্রভাব ওই ব্যক্তির স্বাস্থ্য, কর্মক্ষমতা ও দৈনন্দিন কার্যাবলীর উপর পড়ে, তাহলে রেসিডেন্সিয়াল কেয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়। অন্যদিকে ব্যক্তির অসুস্থতা যদি তেমন মারাত্মক না হয় এবং সে যদি প্রাত্যহিক কাজকর্ম করতে সক্ষম হয় ও উত্তরোত্তর কাজের দক্ষতা বাড়াতে সচেষ্ট হয়, তাহলে পরিচর্যাকারীর পক্ষে নন-রেসিডেন্সিয়াল ব্যবস্থা অবলম্বন করা যেতে পারে।
রেসিডেন্সিয়াল কেয়ার— এই ধরনের সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে একজন পরিচর্যাকারী অসুস্থ ব্যক্তির সঙ্গে একই বাড়িতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য থাকে। এই সময় পরিচর্যাকারীদের জন্য খাওয়া এবং থাকার সুবন্দোবস্ত করা হয়। তার সঙ্গে নিয়মিত ডাক্তার দেখানো ও তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও থাকে। এক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি এবং তার পরিবারের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়।
রেসিডেন্সিয়াল কেয়ার ফেসিলিটি দু’ভাবে প্রযোজ্য—
- হাফওয়ে হোমস্— যখন একজন রোগীর চিকিৎসা চলছে এবং তাতে রোগী সাড়াও দিচ্ছে, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনযাপনের ক্ষেত্রে তার কর্মদক্ষতার বিকাশ, সামাজিক, পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি এবং পেশাগত দক্ষতার বিকাশ ঘটানো জরুরি। এই অবস্থায় সেই ব্যক্তির পরিচর্যাকারী কমপক্ষে ছয় মাস এই ব্যবস্থার সুবিধা গ্রহণ করতে পারেন।
- কোয়ার্টার ওয়ে হোমস্– যখন একজন গুরুতর অসুস্থ মানুষের পরিচর্যার জন্য কোনও ব্যক্তি কমপক্ষে তিন মাস সেই রোগীর সঙ্গে এক বাড়িতে বসবাস করেন, তখন এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।
উল্লেখযোগ্য যে, উপরোক্ত দুটি পদ্ধতির মধ্যেই ডাক্তার, সাইকোলজিস্ট, সাইকিয়াত্রিস্ট সোশ্যাল ওয়াকার্স এবং সাইকিয়াত্রিস্ট নার্স সবাই একযোগে যুক্ত থাকেন। এছাড়াও, রোগীর আপদকালীন চিকিৎসার বন্দোবস্ত করার ক্ষেত্রেও এঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
কীভাবে হাফওয়ে বা কোয়ার্টার ওয়ে হোমস্ ব্যবস্থা কার্যকরী হয়?
এই দুই ব্যবস্থার মধ্যে কোন ব্যক্তি কী ব্যবস্থা বেছে নেবেন, সেটা তাঁদের পছন্দের উপর নির্ভরশীল। সাধারণত একজন অসুস্থ মানুষের সঙ্গে তার পরিচর্যাকারী সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যই থাকতে চান। একে ট্রায়াল পিরিয়ড স্টে বলা হয়। এর মধ্য দিয়ে সেই পরিচর্যাকারী রোগীর অসুস্থতা এবং সংশ্লিষ্ট পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। যদি তাঁর কাছে ওই পরিবেশ স্বচ্ছন্দ বলে মনে হয় এবং রোগীর পরিবারের সদস্যরা তাঁকে যোগ্য বলে মেনে নেন, তাহলেই একজন পরিচর্যাকারীর পক্ষে এহেন পদ্ধতির সাহায্য গ্রহণ সম্ভব হয়।
একজন পরিচর্যাকারী কীভাবে হাফওয়ে বা কোয়ার্টার ওয়ে হোমস্ ব্যবস্থায় তাঁর দায়িত্ব পালন করে থাকেন?
একজন মানসিক রোগী অনেকরকম সমস্যায় ভোগেন। তাঁরা দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অংশ এমন বহু কাজ নিজেরা করতে সমর্থ হন না। যেমন—ব্রাশ করা, স্নান করা প্রভৃতি কাজ তাঁরা অসুস্থতার কারণে করতে পারেন না। এঁদের সব সময় দরকার সুচিকিৎসা এবং যথাযথ যত্নের। এই সব কাজের ক্ষেত্রে একজন রোগীকে আন্তরিকভাবে সাহায্য করাই পরিচর্যাকারীর অন্যতম দায়িত্ব।
হাফওয়ে হোমস্ ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তিকে প্রাত্যহিক নানা কাজ, যেমন—জামাকাপড় কাচা, ঘর পরিষ্কার করা, নিজের এবং অন্যদের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখা প্রভৃতি দায়িত্ব পালন করতে হয়। এইভাবে একজন মানুষ নিজেকে বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত করে। এই রুটিনের মধ্যে ঘরে এবং বাইরে খেলাধূলা করা, ছবি আঁকা, হস্তশিল্প সব কিছুই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
নন-রেসিডেন্সিয়াল কেয়ার— যদি একজন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি চিকিৎসার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে এবং দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে সক্ষম হয়, তখন এহেন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়ে থাকে। এখানে একজন রোগীর সর্বাঙ্গীন বিকাশ সাধনে সাহায্য করাই পরিচর্যাকারীর মূল লক্ষ্য।
এই ধরনের যত্নের ক্ষেত্রে দিনের বেলাতেই কাজ করা হয়ে থাকে। পরিচর্যাকারী সকালবেলায় তাঁর বাড়ি থেকে রোগীর কাছে চলে আসেন। সারাদিন রোগীকে দেখভালের পর আবার বিকেলে নিজের বাড়ি চলে যান। এই ব্যবস্থায় একজন পরিচর্যাকারীর করণীয় হল— রোগীর সঙ্গে খেলাধূলা করা, তাকে শব্দছক সমাধানে সাহায্য করা, রোগীর সামাজিক এবং জীবনে বেঁচে থাকার কৌশলের উন্নতি সাধন, অল্টারনেটিভ থেরাপি যেমন ছবি আঁকা, মুভমেন্ট থেরাপি, যোগাভ্যাস এবং মিউজিক থেরাপির সাহায্যে রোগীকে সুস্থ করা তোলার চেষ্টা করা। এছাড়াও, পেশাগতভাবে একজন রোগীকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলার জন্য মোমবাতি বানানো, জামাকাপড় তৈরি করা, ঝুড়ি বোনা, প্রিন্টিং-এর কাজ শেখানো, পাঁউরুটি, কেক বানানো এবং কম্পিউটারের প্রশিক্ষণ দেওয়াও একজন পরিচর্যাকারীর কর্তব্য। এইভাবেই একজন মানুষ তার আগ্রহ ও সক্ষমতা অনুযায়ী এহেন নানাবিধ কার্যাবলীতে অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে আসবে।
পরিবারের ভূমিকা
একজন মনোরোগীর পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে যে মানুষটি রেসিডেন্সিয়াল এবং নন-রেসিডেন্সিয়াল কেয়ার পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে সুস্থ করে তুলতে উদ্যোগী হয়, সেখানে একটি পরিবারের সদস্যদের ভূমিকাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। রেসিডেন্সিয়াল কেয়ারে থাকার পর যখন একজন রোগী সুস্থ হওয়ার পথে এগিয়ে চলে, তখন একজন পরিচর্যাকারী তাঁর দায়িত্ব যথাযথ পালন করে নিজের পরিবারে ফিরে যায়। ফিরে যাওয়ার পরে এমন হতেই পারে যে, পরিচর্যাকারীর কার্যক্ষমতা আগের তুলনায় কিছুটা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে সেই পেশাদার মানুষটিকে কাঠগড়ায় দাঁড় না করিয়ে, তাঁর পাশে পরিবারের লোকজনদের থাকতে হবে এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ, ঘরের পরিবেশ যেন সেই সময় সহযোগীর ভূমিকা পালনে সমর্থ হয়।
কীভাবে একজন পরিচর্যাকারীকে সাময়িক বিশ্রামের জন্য উৎসাহ দেওয়া যাবে?
পরিচর্যাকারীর কঠিন দায়িত্বপালন থেকে যখন একজন ব্যক্তি কিছুক্ষণের জন্য হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চাইছে, তখন তাঁর প্রাথমিক আশ্রয় হবে নিজের পরিবারের গণ্ডি এবং বন্ধু-বান্ধবের সাহচর্য। কারণ তাদের কাছেই একজন পরিচর্যাকারী তাঁর মনের ভাবপ্রকাশে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে সক্ষম হবেন। যদি কোনও কারণবশতঃ তা সম্ভব না হয়, তাহলে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা মানসিক স্বাস্থ্যের বিশারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা একান্ত জরুরি। বিশেষজ্ঞরাই সেই পরিচর্যাকারীকে তাঁদের সাময়িক বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ-সুবিধা সম্বন্ধে উপযুক্ত তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে পারবেন।