যদি আপনি এমন একজনের পরিচর্যাকারীর ভূমিকা পালন করেন যিনি অ্যালঝাইমার্স, পার্কিনসন্স বা ডিমেনশিয়ার মতো অসুখে আক্রান্ত হন তাহলে পরবর্তী ধাপের জন্য আপনার প্রস্তুত থাকা ভালো। পরিচর্যাকারী হিসেবে আপনার কী করণীয় তা আপনার জানা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে কীভাবে রুগির যত্ন নেবেন এবং কোন কোন লক্ষণ দেখে আপনি এই অসুখের গতিপ্রকৃতি বুঝতে পারবেন তাও আপনার জানা জরুরি। একইসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে এক্ষেত্রে আপনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ, তাই নিজের যত্নের বিষয়টিকেও আপনার অগ্রাধিকার বা গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
কী কী লক্ষণ আপনার লক্ষ্য করা উচিত?
প্রচলিত কয়েকটি মানসিক স্বাস্থ্যের জটিলতা যেমন- অবসাদ, উদ্বেগ এবং মানিয়ে নেওয়ার সমস্যা (জীবনের চিহ্নিত চাপগুলোর বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক এবং অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানো) রুগি এবং পরিচর্যাকারী উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। একজন পরিচর্যাকারীকে আগাম কিছু সতর্কতামূলক লক্ষণ লক্ষ্য করা উচিত যেমন-
- ঘুমের সমস্যা
- খাওয়াদাওয়ায় সমস্যা
- এমন কিছু বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা যা একজন মানুষ আগে
উপভোগ করত - সামাজিক পরিসরে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা এড়িয়ে চলা
এছাড়াও আরও কয়েকটি বিষয় একজন পরিচর্যাকারীকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে-
- দুটো গুরুতর অসুখ যেন একইসঙ্গে দেখা না দেয় সেবিষয়ে সাবধান
হতে হবে - রুগির মানসিক স্বাস্থ্যের ইতিহাস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে বা তার সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলতে হবে। কারণ অতীতের মানসিক সমস্যা আবার দেখা দিতে পারে বা তার লক্ষণগুলো আবার প্রকাশ পেতে পারে।
- যদি প্রয়োজন হয় তাহলে রুগির জন্য একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা কাউন্সেলরের পরামর্শ নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে
পরিচর্যাকারীর নিজের এবং রুগির যত্নের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মনে রাখা জরুরি-
- সমগ্র পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বা তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। এটি পরিচর্যাকারী হিসেবে আপনাকে ও রুগি দু’জনকেই সাহায্য করবে: পরিচর্যাকারী হিসেবে রুগির অসুস্থতার বিষয়ে সমস্ত তথ্য জেনে রাখা খুবই সাহায্যদায়ক হয় এবং কাউন্সেলরের সঙ্গে যোগাযোগ করাও ফলদায়ক হয়, যিনি আপনাকে রুগির অসুখের বিভিন্ন পর্যায়গুলো বুঝতে সাহায্য করবেন। অসুখের প্রাথমিক পর্যায়ে ডাক্তারের কাছে মাঝে মাঝে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সময় যত এগোয় তত রুগি তার অসুখ এবং অসুখজনিত তার জীবনের পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে থাকে। তাই তখন ডাক্তারের কাছে হামেশা যাওয়ার প্রয়োজন কমে যায়।
- নিজের যত্ন নিন। কারণ এই পরিস্থিতিতে আপনিও একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি: পরিচর্যাকারী হিসেবে আপনার ভূমিকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হয় এবং আপনার নতুন ভূমিকা আপনার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। রুগির দেখভাল করার জন্য আপনার হাতে আর অন্য কাজ করার সময় নাও থাকতে পারে। এক্ষেত্রে নিজের মানসিক ও দৈহিক স্বাস্থ্যের যত্ন, এমনকি নিজের প্রিয়জনের যত্নের ক্ষেত্রেও আপনি অবহেলা করতে পারেন। তাই নিজের জন্যও আপনার হাতে কিছুটা সময় অবশ্যই রাখা উচিত। এজন্য রুগির দেখভালের ফাঁকে ফাঁকে সময়মতো নিজের পছন্দের কাজকর্ম এবং বাইরে বেরনো দরকার, সামাজিকতা বজায় রাখা ও বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করাও একান্ত জরুরি।
- প্রয়োজন মতো অন্যের সঙ্গে কথা বলুন ও অপরের সাহায্য নিন: পরিচর্যাকারীর অবশ্যই মনে রাখা জরুরি যে রুগির রোগ নির্ধারণ হয়ে যাওয়া মানে সমস্ত সামাজিক আদান-প্রদান শেষ বা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়া নয়। এই ঘটনায় ভয় পাওয়া বা কলঙ্কের বোধ জাগার মতোও কিছু নেই। আপনি আপনার বিশ্বাসভাজন কারোর সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে পারেন, প্রতিবেশীদের বা পরিবারের বাইরের লোকজন ও বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে সাহায্য চাইতে পারেন। আপনারও যে নিজের একটা গোষ্ঠী রয়েছে, নির্ভরযোগ্য সহায়তা ব্যবস্থা রয়েছে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তাই কখনোই আপনি ভাববেন না যে আপনি যে কাজ করছেন সেখানে আপনি একা।
- রুগির অর্থনৈতিক দিকটির সুবন্দোবস্ত করে তাকে সাহায্য করতে হবে: পরিচর্যাকারী হিসেবে আপনার দৈনন্দিন দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক। যদি ব্যাঙ্কে রুগির কোনও যৌথ অ্যাকাউন্ট না থাকে তাহলে সে বিষয়টি নিয়ে সংবেদনশীলতার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। যখন দরকার হবে তখন আপনি রুগিকে তার এটিএম কার্ড ব্যবহার করার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন। এক্ষেত্রে পারিবারিক পরিচর্যাকারীরা প্রয়োজন মতো রুগিকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সাহায্য করতে সক্ষম হয়। রোগ নির্ধারণ হয়ে যাওয়ার পরে কাউন্সেলরের সঙ্গে কথাবার্তা বললে পরিচর্যাকারীরা নিজেদের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে পারেন।
- সামাজিক আদান-প্রদান: ঘনিষ্ঠ আত্বিয় ও বন্ধুবান্ধবকে কী বলা উচিত? সাধারণভাবে যখন আপনি আপনার পরিবারের কোনও সদস্যের অসুখের কথা খোলাখুলিভাবে অন্যকে বলেন তখন তারা বিষয়টি বুঝতে পারে এবং আপনার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রে তাদের জানাতে হবে যে-
- তারা যেন স্বাভাবিক ভাবেই আপনাদের বাড়িতে যাতায়াত করেন।
- যদি তারা বুঝতে না পারেন যে রুগির সাথে কী কথা বলবেন তাহলে আপনি বলে দিতে পারেন যে রুগির দিন কেমন কেটেছে, তাদের নিজেদের কথা, ক্রিকেট খেলার কথা বা রুগির পছন্দের বা আগ্রহের বিষয় নিয়ে কথা বলা যেতে পারে।
- অ্যালঝাইমার্স বা ডিমেনশিয়ার রুগিরা বেশি কিছু মনে রাখতে পারে না বা নিজের মনের অনুভূতি ব্যক্ত করতে পারেন না। সেক্ষেত্রে রুগিকে নানারকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা না করে নিজেদের জীবনের গল্প বলা, তাদের সঙ্গে অন্য বিষয়ে আলোচনা করা ভালো।
- তারা রুগির সাথে সাধারণ কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে সময় কাটাতে পারেন, যেমন- রুগিকে নিয়ে ধর্মীয় স্থানে যেতে পারেন, বইয়ের দোকানে যেতে পারেন, এমনকি পার্কেও যেতে পারেন।
- যদি তারা বুঝতে না পারে যে রুগির সঙ্গে কীভাবে কথা বলবে বা কী করবে তাহলে তারা সে বিষয়ে পরিবারের সদস্য বা খুব কাছের বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করতে পারে। কারণ তারা ওই ব্যক্তিকে অনেক ভালো করে চেনে।
- যদি রুগি বৃদ্ধাশ্রম বা চিকিৎসালয়ে থাকেন তাহলে তার পরিবারের সদস্য বা বন্ধুদের তাকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য আগে থেকে অনুমতি নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
স্নায়বিক অবক্ষয়জনিত অসুখ কি আমরা প্রতিরোধ করতে পারি না বা অসুখের সূত্রপাত বিলম্বিত করতে পারি না?
বার্ধক্যজনিত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ (জেরিয়াট্রিক সাইকিয়াট্রিস্ট) ডঃ সৌম্য হেগড়ে বলেছেন, ”এক্ষেত্রে তিরিশ বছরের শুরু বা মাঝামাঝি সময় থেকে মানুষের যত্ন ভালোভাবে নেওয়া জরুরি। তাহলে জিনগত প্রবণতা সত্ত্বেও অসুখের সূত্রপাত বিলম্বিত করা যেতে পারে। মস্তিষ্কের জ্ঞানীয় সংরক্ষণাগারকে এমনভাবে পোষণ করা সম্ভব যাতে অসুখের লক্ষণ প্রকাশ পেতে দেরি হয়। মস্তিষ্কের এবং জ্ঞানীয় কার্যকলাপের বৃদ্ধি ঘটানোর জন্য এমন কাজ করতে হবে যা করার জন্য আপনার মস্তিষ্ককে নতুনভাবে কাজ করতে হবে। যেমন নতুন ভাষা বা বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শেখা।”
এছাড়াও শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নও সর্বাত্মকভাবে কার্যকরী ফল দেয়। এর মধ্যে রয়েছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কয়েকটি কার্যকলাপ-
- নিয়মিত শরীরচর্চা
- স্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়া করা
- নতুন কিছু শেখা
- বন্ধুদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করা
- প্রাণ খুলে হাসা
- সামাজিক আদান-প্রদানের উন্নতি ঘটানো