মানব মনস্তত্ত্বের নানা অলি-গলির মাঝে ‘ভালোবাসা ও ঘৃণা’ বিষয় দুটো কৌতুহলোদ্দীপক এবং দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে আসছেন। অতীতে বেশিরভাগ গবেষণা মূলত ‘প্রেমজ ভালোবাসা’ নিয়ে করা হয়েছে, যেমন : স্টার্নবার্গের ট্রাই অ্যাঙ্গুলার লাভ থিয়োরি, থ্রি স্টেজ মডেল অব লাভ ইত্যাদি। ভালোবাসার সংজ্ঞায় রয়েছে নানা মিল-অমিল। অনেকে বলেছেন, ভালোবাসা হচ্ছে একটি আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, অভিজ্ঞতা। এমনকি অনেকে বলেছে এটি একটি শেখা অনুভূতি। তবে মোটাদাগে বলা চলে, ভালোবাসা হলো বহুর সম্মেলনে একটি ঐক্যাবস্থা। প্রেমজ সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট ‘ঘৃণা’র সূত্রপাত মূলত বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে হয়ে থাকে।
প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসা ও ঘৃণা নামক বিষয় দুটো খুব জটিল সমীকরণে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। অতীতে এ দুটো বিষয় নিয়ে বিস্তর গবেষণা হলেও খুব গভীরভাবে তাদের মাঝে যোগাযোগের সূত্র তেমন একটা খোঁজা হয়নি। এটা আগের নানা পর্যবেক্ষণে প্রমাণিত যে, একজন পুরুষ বা মহিলা আরেকজনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া প্রেমের সম্পর্ক তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেখা গেছে একজন আরেকজনের সঙ্গে অনেক দিন ধরে শুধু সঙ্গী হিসেবে থাকার চেয়ে দু’জনের মধ্যকার নানা বিষয়ের মিল থাকার ফলশ্রুতিতে ‘আকর্ষণ’ তৈরি হয়।
সম্প্রতি চীনে তিনজন গবেষক ভালোবাসা ও ঘৃণার মাঝে যোগাযোগ খোঁজার চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা দু’জনের ভাবাদর্শের মিল নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। তারা দেখতে চেয়েছেন, দীর্ঘস্থায়ী সসুম্পর্কের ক্ষেত্রে দু’জনার মাঝে চিন্তা বা পছন্দের মিল কতটুকু বা যোগাযোগ কী ধরনের? পুরো গবেষণায়, মোট ৫৯ জন অংশগ্রহণকারী ছিলেন, যার মধ্যে ৩০ জন পুরুষ ও ২৯ জন নারী ছিলেন। এদের মধ্যে ১৮ ভাগ নতুন সম্পর্কে জড়ানোর আশায় আছেন, ৩৩ ভাগ সম্পর্কে আছেন, ২৪ ভাগের আগে সম্পর্ক ভেঙেছে এবং বাকিদের কখনোই যুগল সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নেই। অংশগ্রহণকারীদেরকে চারটি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য সংশ্লিষ্ট বর্ণনা দেয়া হয়, যার একটি বর্ণনা অংশগ্রহণকারী নিজেকে কল্পনা করবে, বাকি তিনটি চারিত্রিক বর্ণনা তিনজন ভাবি প্রেমিক বা প্রেমিকার। তিনটি চরিত্রে কিছু বিষয় খেয়াল রেখে বর্ণনা দেয়া হয়েছে : ১. অংশগ্রহণকারীর সঙ্গে কতটুকু মিল। ২. কল্পিত প্রেমিক/প্রেমিকার ব্যক্তি হিসেবে সফলতা। প্রথম চরিত্র বর্ণনা করা হয়েছে এমনভাবে, যার মাঝে সমানভাবে অংশগ্রহণকারীর মতো বেশিরভাগ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ও ব্যক্তি হিসেবে সফল (পারিবারিক, সামাজিক, পেশাগত)। দ্বিতীয়জনের বর্ণনা দেয়া হয়েছে এমনভাবে, যিনি একজন সফল ব্যক্তিত্ব কিন্তু অংশগ্রহণকারীর কল্পিত চরিত্রের সঙ্গে খুব কম মিল আছে। ৩. তৃতীয় বা শেষ কল্পিত প্রেমিক বা প্রেমিকাকে এমনভাবে বর্ণনা দেয়া হয়েছে যে, যার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে অংশগ্রহণকারীর কল্পিত চরিত্রের মিল খুব সামান্য এবং সে ব্যক্তি হিসেবে তেমন সফল নন।
তিনটি চরিত্রে গবেষকরা মোট ১৪টি বিষয় সন্নিবেশিত করেছেন, যেমন : বাহ্যিক রূপ, মূল্যবোধ, ঘর-বাড়ির পছন্দ, শখ, পেশাগত অবস্থান, ব্যক্তিত্বের ধরন, পেশার বাইরে ভিন্ন বিষয়ে পারদর্শিতা, সামাজিকতার দক্ষতা, বাবা-মায়ের মতামতে গুরুত্ব দেয়া, রোম্যান্টিকতা, স্বাস্থ্য সচেতনতা, ভালোবাসা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনযাপন প্রণালি ইত্যাদি। ‘পেসনেট লাভ স্কেল’ বা PLS নামক একটি স্কেল পরবর্তীতে ব্যবহৃত হয়েছে, যার সাহায্যে কল্পিত প্রেমিক/প্রেমিকা চরিত্র তিনটির কোনটির প্রতি কী পরিমাণ ভালোবাসার জন্ম নিয়েছে তা পরিমাপ করা হয়েছে। আবার কিছু সুনির্দিষ্ট নেতিবাচক পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে ওই অংশগ্রহণকারীর কল্পিত প্রেমিক/প্রেমিকার প্রতি উদ্ভূত ঘৃণা পর্যবেক্ষণ করা হয়। যেমন : প্রায়ই বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহ দেখানো, পুরনো সঙ্গীর সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখা, কাউকে নিজের প্রেমিক/প্রেমিকার সঙ্গে সম্পর্কের কথা না বলা, গোপনে ডেটিং ওয়েবসাইটের শরণাপন্ন হওয়া, আগের সঙ্গীর শূন্যস্থান পূরণ করার উদ্দেশ্যে প্রেম করা, প্রায়ই মিথ্যে বলা, কথা দিয়ে কথা না রাখা, প্রেমিক/প্রেমিকার বাবা-মাকে পছন্দ না করা, গোপনে প্রেমিক/প্রেমিকার বন্ধু/রুমমেট/সহকর্মীর সঙ্গে দেখা করা, বিয়ে করতে না চাওয়া, ফ্যাশনের দিকে সঙ্গীকে সেকেলে ভাবা, বাবামায়ের ঠিক করে দেয়া সঙ্গীর সঙ্গে প্রেম করা, সম্পদশালী হওয়ার পর ভালোবাসা ইত্যাদি।
সার্বিক তথ্যাদি বিশ্লেষণের ফলাফলে দেখা গেছে, প্রেমিক/প্রেমিকার সঙ্গে মিল বেশি থাকলে তার প্রতি ভালোবাসা যেমন বেশি থাকে, আবার বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ঘৃণাও বেশি থাকে, তারপরও শেষ পর্যন্ত ভালোবাসা থেকে যায়। আবার প্রেমিক/প্রেমিকার প্রতি আকর্ষণ বা ভালোবাসা না থাকলে, তার প্রতি ঘৃণার অনুভূতিও বেশি থাকে, তবে তার মাত্রা অপেক্ষাকৃত কম। সব কথার শেষ কথা হলো দু’জনের মধ্যকার ভালোবাসা বা ঘৃণার সঙ্গে ‘দু’জনের মধ্যকার মিল থাকা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
(এ লেখাটি বৈজ্ঞানিক জার্নাল ‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন সাইকোলজি’র সাম্প্রতিক প্রকাশিত (ডিসেম্বর, ২০১৭) সংখ্যার অন্যতম একটি মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা পত্রের সংক্ষিপ্ত বঙ্গানুবাদ। এর কোনো অংশ লেখকের নিজস্ব মতামত বা মন্তব্য নয়।)