ওমর শাহেদ
মানুষটির নাম মিডিয়ন স্নান। জন্মেছেন সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর ইউনিয়নের বাঙ্গালভিটা। খুব সুন্দর একটি গ্রামে জন্মেছেন। ইউনেসকোর ওয়াল্ড হেরিটেজ-বাংলাদেশের পরিযায়ী পাখিদের অন্যতম আবাসভূমি ‘টাঙ্গুয়ার হাওড়’র পাশে তার বাড়ি। এই হাওড়ে দেশ, বিদেশ থেকে অসংখ্য পর্যটক সারা বছর বেড়াতে আসেন। বর্ষাকালে ভুবনখ্যাত টাঙ্গুয়া তার অনেকগুলো হাওড়, বাওড় ও বিল নিয়ে অপরূপ রূপ লাভ করে। সারা বছরই বিশ্বজুড়ে পরিযায়ী পাখিদের আবাসভূমি হয়ে থাকে। পাখি, বিলের মাছ, লতা, গুল্ম, গাছগাছালি ও মানুষের মেলবন্ধনের আদর্শ উদাহরণে পাখি গণনা করতে যান ইনাম আল হক, মুসা ইব্রাহীম, এম এ মুহিতের মতো বাংলাদেশের প্রধান তিন পযটক, পাখিবিদ ও এভারেস্টজয়ী।
আইইউসিএনের অনেকগুলো জরিপের উৎস, কর্মক্ষেত্র ও পাখি সংরক্ষণাগার আছে এখানে। সে কথা খাতাকলমে জানেন না মিডিয়ন, তবে তাদের কাজকর্ম জানা আছে ওর। অপরূপ পরিবেশ তার চেনা। আরো বললেন, তাদের গ্রামের ওপারে ভারতের মেঘালয় পাহাড়। মেঘালয় পযটকদের আরেক আগ্রহের স্থান। খুব সুন্দর এই গ্রামে তিনি ও তারা বাস করেন মিলেমিশে। এখানে থাকে খাসিয়াসহ আরো কটি আদিবাসী গোষ্ঠী। চেহারায় তারও আদিবাসীদের সুস্পষ্ট পরিচয় আছে। তবে তিনি এখন বংশীয় খিস্টান। খাসিয়ারাও তাই। মুসলমানদের সঙ্গে একত্রে গ্রামে, হাটবাজারে, গঞ্জে নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন। মেলামেশাও বেশ। ফলে কোনো ধরণের সাংস্কৃতিক মানসিক চাপ ও সাংস্কৃতিক মানসিক রোগের কথা বললেন না তিনি।
তবে অভাবের কথা বলেছেন। গ্রামে কাজ বলতে তাদের ধান কাটা ও কয়লা এবং চুনাপাথর আনা, নেওয়া। ভারতের মেঘালয়ে আছে কয়লা খনি, চুনাপাথরেরও। সেগুলো ওদেশ থেকে আসে। তারা পরিবহন, রক্ষনাবেক্ষণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। দিনমজুরি করতে হয়েছে তাকে। চলে এসেছেন ঢাকাতে। অভাব সইতে পারছিলেন না, সংসারে দাম্পত্য কলহ, ঝগড়া-বিবাদ, মানসিক ও শারিরীক চাপ এবং নির্যাতন বলে আলো-আঁধারের এই শহরে পা রেখেছেন। বলেছেন, ‘গ্রামে থাকলে তো না খেয়ে মরতে হবে। বাঁচতে হলে চাকরি করতে করতে হবে।’
ঢাকার মগবাজার কনভেনশন সেন্টারে চাকরি নিয়েছেন সিকিউরিটি সুপারভাইজর পদে সেপ্টেম্বরে। চাকরিজনিত মানসিক টেনশন নিয়ে তার কোনো কথা নেই। কাজ করে খেতে হবে বলে আর এগুলেন না এই পথে। বিয়ে করেছেন। স্ত্রী লিঙ্গাম স্নান। দুটি ছেলেমেয়ে আছে তাদের সংসারে। বাড়িতে আরো আছেন বাবা রুবেন দাজেল ও মা শ্যামেন স্নান। আদিবাসীদের সরলতা আছে তাদের ছেলেটির মাঝে। শহরের সংকট, মানুষের মানসিক পীড়ন উৎরে সাধারণ, হাসি-খুশি, ভালোমানুষের প্রতিচ্ছবি। তবে ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীর জন্য খারাপ লাগে খুব। মেয়েটি বড়-মীমা দাজেল, বয়স সাত বছর। ছেলেটি মোটে আড়াই, মারশিয়াস দাজেল। ওরা থাকে মা, দাদুদের সঙ্গে গ্রামে। সবসময় মনে পড়ে বাবার সন্তানদের।
১২ ঘন্টার কর্মপ্রহর তার। সকাল নয়টা থেকে রাত আটটা পযন্ত কাজ করতে হয়। গেট খুলে দেওয়া, অতিথিদের গাড়ি পাহারা দেওয়া, তাদের আসা, যাওয়ার খেয়াল রাখা, কনভেনশন সেন্টার পাহারা দেওয়া ইত্যাকার অনেক কাজ আছে। কাজের ফাঁকে যখন সময় মেলে, কথা বলেন। কাজ সেরে ১০ মিনিটের জন্য কথা বলতে হয় কেবল। কেননা, ছোট, ছোট এই শিশুরা ঘুমিয়ে পড়বে। কী খেয়েছে, খেলেছে, সারাদিন কী করেছে, উল্লেখযোগ্য কোনো বিষয়, তাদের মনের কথা বাবা শোনেন। কতটা বাজে বুকে? উত্তর দিলেন, ‘খারাপ লাগে আমার, বুঝিয়ে বলতে পারছি না।
পরিবার ছেড়ে থাকতে পারবো না। চাকরি করতে গেলে স্যাকরিফাইস করতে হবে।’ কেন গ্রামে থাকলেন না-উত্তর করলেন, ‘কর্মসংস্থানের অভাবে। ভারতের কয়লা ও চুনা পাথরের খনি করোনা ভাইরাসের আক্রমণে বন্ধ হয়ে আছে। ধানকাটার সময় গ্রামে দিনমজুরি থাকে। অন্য সময় বেকার। বাড়ির পাশে কাজের ব্যবস্থা থাকলে বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকতে পারতাম। সেটি তো আজও হলো না।’ ফলে মা, বাবার সঙ্গেও অনেকক্ষণ ফোন করে কথা বলতে হয়। মায়ের কথা বললেন, ‘আমার মায়ের ভালোবাসা তুলনাহীন।’ স্ত্রীর সঙ্গে প্রতিরাতেই আলাপ হয়। তিনি কান্নাকাটি করেন, স্বামী তাকে স্বান্তনা দেন। মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয় খেলা নিয়ে। সে পুতুল খেলে। নাচে। বাবার তা ভালো লাগে। ছেলেটি বাবার সঙ্গে কথা বলে তার বয়সানুপাতে। তাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখেন-‘ভালো করে লেখাপড়া করে ওরা ভালো চাকরি করবে, ভালো মানুষ হবে।’ তবে তাদের বাবা খুব বেশি লেখাপড়া করতে পারেননি।
২০১২ সালে এসএসসি পাশ করেছেন মানবিকে। কম শিক্ষিত বলে মা, বাবাকে দোষ দেন না। এটি তার নিজের দোষ। এরপর চলে গিয়েছিলেন ভারতের মেঘালয়ে। অনেক দিন কয়লা খনিতে দিনমজুরি করেছেন। এবারও ওখানে ছিলেন। করোনা ভাইরাসের আক্রমণে চলে এসেছেন। খনি থেকে কয়লা, পাথর বয়ে আনতে হতো তাকে। মালিক ভালো ছিলেন। ভালো ব্যবহার করতেন। প্রতিদিনের মজুরি প্রতিদিন শোধ করতেন। সেখানে প্রধানত খাসিয়ারা কাজ করেন। একটি বোন আছে তার। গ্রামে থাকেন। স্বামী প্রাইভেট কার চালান।
শান্ত এই মানুষটির বাড়িতে, আশপাশে ও চারদিকে এনজিওগুলো কাজ করে। কারিতাসের সঙ্গে তিনি পরিচিত। তারা শিক্ষা, সামাজিক উন্নয়নসহ অনেক কাজ করেন। তবে কোনোদিনও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে বলেনি। ফলে মানসিক রোগ যেমন রাগ, ঘৃণা, উত্তেজনা, উন্মত্ততার চরম অবস্থা এবং নানা মানসিক রোগ সম্পকে তিনি কিছুই জানেন না। সরকারী হাসপাতালগুলোতে যে মনোরোগবিদ্যা বিভাগ আছে সেটিও অজানা তাদের গ্রামের মানুষের। সেখানে আলাদা চিকিৎসক আছেন, তারা পাগলকেও সুস্থ করে ফেলতে পারেন সে বিষয়ে তাকে কেউ কিছু বলেননি।
১ ডিসেম্বর, ২০২১; ঢাকা।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে