মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবায় গোড়ায় গলদ

0
61

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভারতে গত এক’দশকে অনেক কাজ হয়েছে৷ তবুও সমাজ মানসিক সমস্যাকে পাগলের প্রলাপ বলেই মনে করা হচ্ছে৷

আউচ, নিপা কেন্দ্র (নাম পরিবর্তিত)! কলেজ জীবনে এই বাক্যটি কোনো কোনো বন্ধুর মুখে মুখে ফিরত৷ নিপা আসলে একটি রিহ্যাব সেন্টারের নাম৷ মাদকাসক্তদের জন্য তৈরি ওই কেন্দ্রটি নিয়ে যারপরনাই ভয়ে থাকত বন্ধুদের একটি দল৷ বলতে দ্বিধা নেই, কলেজজীবনে নেশাখোর বন্ধুর পাল্লায় কম পড়িনি৷ হিন্দু হস্টেলে গাঁজার ‘গঙ্গা-যমুনা’ চলতো৷ কলকেতে গাঁজা ভরার একটি বিশেষ স্টাইলের নাম ছিল গঙ্গা-যমুনা৷ উত্তর-পূর্ব ভারতের বন্ধুরা বং চিনিয়েছিল সে সময়৷

ছাত্র জীবন কোনো বাধা মানে না৷ নৈরাজ্যবাদ তখন রক্তে৷ কেউ সেই নৈরাজ্যবাদী জীবনযাপনে বুঝে অংশগ্রহণ করে৷ কেউ অংশ নিতে গিয়ে তলিয়ে যায় নেশার অতলে৷ যারা হারিয়ে যেত, নেশাকেই জীবনের একমাত্র সৃজনশীল প্রকাশ বলে মনে করতো, তাদের মুখে একবার নয়, বার বার শুনেছি ওই বাক্যটি– ‘আউচ, নিপা!’

স্নাতকোত্তর পড়তে পড়তেই সংবাদপত্রে শিক্ষানবিশ রিপোর্টার হওয়ার সুযোগ মেলে৷ এখনো মনে আছে, জীবনের প্রথম অ্যাসাইনমেন্টই ছিল রিহ্যাব সেন্টার এবং নেশারুদের জীবন৷ প্রথম গিয়েছিলাম নিপায়৷ ভয় পেয়েছিলাম৷ বুঝেছিলাম, বন্ধুদের মুখে শোনা বাক্যটি ঘোর বাস্তব৷ নিপা যেন এক আস্ত কনসেনট্রেশন ক্যাম্প৷ কথায় কথায় মারধর করা হতো নেশামুক্তির জন্য ভর্তি হওয়া ব্যক্তিদের৷ কারো পিঠে কালশিটে, কারো পায়ে প্লাস্টার, কারো শরীরে ইলেকট্রিলক শকের চিহ্ন– সে এক বিচিত্র দৃশ্য! এ ভাবে নেশামুক্তি সম্ভব?

কলকাতায় ‘মুক্তি’ নামের একটি রিহ্যাব চালান বিদিশা ঘোষ৷ কথায় কথায় তিনি বলছিলেন, যে রিহ্যাবে মারধর করা হয়, সেখানে আর যাই হোক, নেশামুক্তি হয় না৷ ভয় দেখিয়ে নেশার মতো মানসিক এবং শারীরিক সমস্যা থেকে কাউকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়৷ তার জন্য নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি আছে৷ মানসিক এবং শারীরিক চিকিৎসা৷

সমস্যা হলো, কলকাতা তো বটেই, গোটা ভারতে পাড়ায় পাড়ায় যে অসংখ্য রিহ্যাব সেন্টার গড়ে উঠেছে, তাদের সেই পরিকাঠামো নেই৷ লাইসেন্স পর্যন্ত নেই৷ তারা জানেই না, নেশামুক্তির বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া৷ খবরের কাগজের সঙ্গে তারা লিফলেট বিলি করে ‘গোপনে মদ ছাড়ান’৷ গোপনে নয়, প্রকাশ্যেই তারা নির্বিচারে মারধর চালায়৷ মনে করে, এই মধ্যযুগীয় প্রক্রিয়াতেই বুঝি সমস্যা মিটিয়ে ফেলা যাবে৷ যার পরিণামও হয়েছে ভয়াবহ৷ ব্যান্ডের এক পরিচিত ড্রামার এমনই এক নেশামুক্তি কেন্দ্র থেকে পালিয়ে গিয়ে আত্মহত্যা করেছিল৷

শুধু তাই নয়, এই ধরনের নেশামুক্তি কেন্দ্র থেকে ছুটি পেয়ে মনোকষ্টে ফের নেশায় ডুবে যাচ্ছেন বহু মানুষ৷ বস্তুত, কোনো কোনো নেশামুক্তি কেন্দ্রে নতুন নেশার রসদ পাওয়া যায় বলেও অভিযোগ রয়েছে৷

তা হলে কেন ওই কেন্দ্রগুলিতে পাঠানো হচ্ছে নেশাগ্রস্তদের? প্রশ্নটি করেছিলাম এক পরিচিত ‘অ্যালকোহল অ্যানোনিমাস’এর বন্ধুকে৷ গত সাত বছর সে নেশামুক্ত৷ একসময় নেশা করে জেলেও যেতে হয়েছে৷ সম্প্রতি জীবনের সেই অধ্যায় নিয়ে একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের সিনেমা বানিয়ে সে৷ যা বেশ কিছু আন্তর্জাতিক উৎসবে দেখানোও হয়েছে৷ বন্ধু বলছিল, নেশা নিয়ে সমাজে এক ধরনের ছূতমার্গ কাজ করে৷ কোনো পরিবারে নেশারু থাকলে পরিবার তা সমাজ থেকে আড়াল করার চেষ্টা করে৷ ফলে ঢাকঢোল পিটিয়ে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয় না৷ গোপনে কোনো একটি রিহ্যাবে ভর্তি করে দেওয়া হয়৷ তারই সুযোগে দিকে দিকে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে অসংখ্যা সেন্টার৷ যাদের লাইসেন্স পর্যন্ত নেই৷ চিকিৎসার সাধারণ ব্যবস্থাও নেই৷

শুধু নেশামুক্তি কেন্দ্র নয়, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েই সমাজের মধ্যে এক ধরনের ছূতমার্গ কাজ করে৷ সাইকিয়াট্রিস্ট মানেই পাগলের ডাক্তার৷ সাইকোলজিস্টের কাছে যাওয়া মানেই মাথায় পাগলামো বাসা বেঁধেছে৷ সমাজের প্রতিটি স্তরেই এই অশিক্ষা এখনো প্রবল ভাবে রয়ে গিয়েছে৷ যে সমাজ মনের রোগ মাত্রেই পাগল ভাবে, সে সমাজে মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থাও যে বিশেষ সুবিধাজনক নয়, তা বলাই বাহুল্য৷

দীর্ঘদিন ধরে ভারতের মানসিক সমাজ নিয়ে কাজ করছেন বিশিষ্ট মনোবিদ রত্নাবলি রায়৷ আলাপচারিতায় বলছিলেন, ভারতে এখন ৩৭টি মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র আছে৷ জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা সেগুলিকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছে৷ প্রথম ভাগের মানসিক হাসপাতালগুলি যথেষ্ট আধুনিক৷ পরিবেশ এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা সবই প্রথম বিশ্বের মানসিক হাসপাতালের সঙ্গে তুলনীয়৷ দ্বিতীয় বিভাগের হাসপাতালগুলির অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে৷ তবে আরো অনেক উন্নতি প্রয়োজন৷ ভয়াবহ অবস্থা তৃতীয় বিভাগের হাসপাতালগুলির৷ অধিকাংশ সাধারণ মানুষ সেখানেই যান৷ রোগীদের উপর অত্যাচারের বহু অভিযোগ সেখান থেকে আসে৷ অবৈজ্ঞানিক, অনৈতিক ব্যবহার করা হয় রোগীদের সঙ্গে৷ তবে একই সঙ্গে রত্নাবলির বক্তব্য, গত এক দশকে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বহু প্রতিষ্ঠান ভারতে কাজ করেছে৷ ফলে গত কয়েক বছরে পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হয়েছে৷

মন-সমাজবিদ মোহিত রণদীপ অবশ্য রত্নাবলির সঙ্গে পুরোপুরি এক মত নন৷ তাঁর বক্তব্য, বাহ্যিক পরিবর্তন হলেও, মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবায় গোড়ায় গলদ রয়ে গিয়েছে৷ সরকার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এখনো সচেতন নয়৷ এখনো মানসিক রোগ মানেই পাগল– এই ধারণাটি রয়ে গিয়েছে৷ নেশার সমস্যাই হোক, অথবা অন্য মানসিক রোগ– পুরো বিষয়টি নিয়েই এখনো বহু কাজ বাকি বলে মনে করেন মোহিত৷

নেশা করে রেললাইনের ধারে পড়ে থাকা এক তরুণ একটু চিকিৎসা পেলে কী ভাবে বদলে যেতে পারে, নিজের বন্ধু মহলেই তা দেখেছি৷ আর সেই নেশারুর উপরেই যখন অত্যাচার হয়, তখন তার পরবর্তী জীবন কতটা অমানসিক হয়ে উঠতে পারে, তার নজিরও রয়েছে চোখের সামনেই৷ মানসিক রোগীকে ঠিক সংস্থায় চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব৷ সমাজেরও দায়িত্ব৷

সূত্র : ডয়চে ভেলে।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleমানসিক চাপে অবশ্যই সমানুভূতি প্রকাশ করতে হবে
Next articleদ্বিতীয় সন্তানও কি অটিজমে আক্রান্ত হবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here