অডিটরি প্রসেসিং ডিসঅর্ডার বলতে কী বোঝায়?
নিলয়ের অভিভাবকরা তার স্কুল ও পড়াশোনা নিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ১২ বছরের নিলয় ছিল শারীরিকভাবে সুস্থ-সবল একটি ছেলে। সে তার বয়সের তুলনায় দু’ক্লাস নীচে, ক্লাস ফাইভে পড়ত। সে কত মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়ার করার চেষ্টা করত বা তার অভিভাবকরা বাড়িতে তার জন্য কত সংখ্যক শিক্ষকের ব্যবস্থা করেছিল তা আদৌ কোনও বড় বিষয় ছিল না। তবু নিলয় ক্লাস ফাইভের পরীক্ষায় সফল হতে পারেনি। তার বাবা-মা তাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত হয়ে উঠেছিল; দিনে-দিনে নিলয়ের নিজের উপর থেকে বিশ্বাস ও ভরসা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছিল। সে তার সমবয়সি অন্য বাচ্চাদের তুলনায় ক্রমে পিছিয়ে পড়ছিল। সেজন্য তার অভিভাবকরা তাকে একজন শিশু মনস্তত্ত্ববিদের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মনস্তত্ত্ববিদ নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিচার-বিবেচনা করেও নিলয়ের মধ্যে বৌদ্ধিক, বিকাশগত বা শেখার অক্ষমতা খুঁজে পায়নি।
নিলয় সবসময়ে অভিযোগ করত যে অন্যরা তাকে যা বলে তা সে বুঝতে পারে না এবং সেজন্য অন্যের নির্দেশ মেনে কাজ করতে তার অসুবিধা হয়। প্রথম প্রথম সেকথা শুনে তার বাবা-মা ও শিক্ষকরা ভাবত যে এটা নিলয়ের একপ্রকার বদমায়েশি এবং সেজন্য সে শাস্তিও পেয়েছিল। কিন্তু ক্লাস ফাইভে পড়ার সময়ে তারা বুঝতে পেরেছিল যে অন্যের নির্দেশ বা কথা অনুযায়ী নিলয়ের কাজ না করতে পারার পিছনে সত্যিই কিছু কারণ রয়েছে। তখন একজন শিক্ষক তার বাবা-মাকে একজন অডিওলজিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেয়। সেই অডিওলজিস্ট নিলয়কে পরীক্ষা করে বোঝেন যে সে অডিটরি প্রসেসিং ডিসঅর্ডার-এ আক্রান্ত হয়েছে।
অভিভাবক বা শিক্ষকদের এই বিষয়টা সম্বন্ধে ভালোভাবে জানা আছে কি?
অডিটরি প্রসেসিং ডিসঅর্ডারকে (এপিডি) সেন্ট্রাল অডিটরি প্রসেসিং ডিসঅর্ডার বলেও চিহ্নিত করা হয়। এর ফলে বাতাসের মধ্য দিয়ে ভেসে আসা শব্দ আমাদের কানের ভিতর দিয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছতে পারে না। স্কুলে পড়ে এমন বাচ্চাদের ৫ শতাংশ এই সমস্যার শিকার হয়। অথচ এর পিছনে কিন্তু বাচ্চাদের কানের কার্যগত ও গঠনগত কোনরকম দুর্বলতা বা অস্বাভাবিকতা থাকে না।
এপিডি-তে আক্রান্ত শিশুরা শব্দ ও ভাষার মধ্যে কোনও পার্থক্য করতে পারে না, এমনকী শব্দ খুব জোরে ও পরিষ্কার শোনা গেলেও তারা তা বুঝতে পারে না। তাদেরকে অন্যরা কী কথা বলছে তা তারা বুঝতে পারে না। কারণ তাদের কান ও মস্তিষ্কের মধ্যে সংযোগের অভাব থাকে। আসলে তাদের মস্তিষ্কে শব্দ, বিশেষত কথ্যভাষার চিহ্নিতকরণ ও তার সঠিক ব্যাখ্যা কিছু কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এছাড়া একটা শব্দ কোথা থেকে আসছে তা বলার ক্ষেত্রেও তাদের সমস্যা হয়। একটা শব্দের গতিপ্রকৃতি ও তার পরিপ্রেক্ষিত বোঝার ক্ষেত্রেও এইধরনের শিশুদের অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়।
অডিটরি প্রসেসিং ডিসঅর্ডার-এর কী কী লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়?
নীচের লক্ষণ ও উপসর্গগুলো দেখে বাচ্চাদের অডিটরি প্রসেসিং ডিসঅর্ডার চিহ্নিত করা যায়-
- ভাষা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কাজকর্ম ও তা মনে রাখার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেওয়া
- মৌখিক নয় এমন শব্দ, গান প্রভৃতি ব্যাখ্যা বা বোঝার ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা না হওয়া
- ধীর প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়ে চিন্তাভাবনা বা ধারণা গড়ে তোলা এবং সেগুলো ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সমস্যার মুখোমুখি হওয়া
- একইরকম শুনতে লাগা শব্দগুলো ঠিকমতো উচ্চারণ করতে না পারা, সেগুলোর ভুল বানান লেখা,
- অক্ষরবিন্যাসের ক্ষেত্রে ছেদ ঘটানো, একইরকম শুনতে লাগা শব্দগুলো নিয়ে সন্দেহ জাগা (three/free, jab/job, bash/batch etc.)
- ভাবভঙ্গিমূলক কথাবার্তার ক্ষেত্রে ধন্ধে পড়ে যাওয়া (হাসি এবং উপমা)
- অত্যন্ত আক্ষরিকভাবে শব্দের ব্যাখ্যা করা
- চারপাশ থেকে আসা শব্দের ফলে প্রায়শই দিক্ভ্রান্ত হয়ে পড়া
- মৌখিক ভাষা বোঝা বা মনে রাখার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা
- মৌখিক নির্দেশের ভুল ব্যাখ্যা করা বা মনে রাখতে না পারা
- মগ্ন মানুষকে উপেক্ষা করা
- প্রায়শই ‘কী’ বলা হচ্ছে তা অন্যকে জিজ্ঞাসা করা, এমনকী যদি তারা শুনতেও পায় যে তাদের কী বলা হচ্ছে, তাও তা অন্যকে জিজ্ঞাসা করা ।
কী কারণে অডিটরি প্রসেসিং ডিসঅর্ডার হয়?
অডিটরি প্রসেসিং ডিসঅর্ডার (এপিডি)-এর কারণগুলো হল-
- অর্জিত এপিডি- যে কোনও ধরনের ক্ষতি এর কারণ বা সেন্ট্রাল অডিটরি নার্ভাস সিস্টেম বা স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা হারিয়ে গেলে এই সমস্যা দেখা দেয়।
- বংশগত ও জিনগত- এই সমস্যা বংশপরম্পরায় দেখা দিতে পারে বা শিশুর জন্মের সময় কোনও জটিল সমস্যা দেখা দেওয়ার ফলাফল হিসেবেও অডিটরি প্রসেসিং ডিসঅর্ডার হতে পারে।
- বিকাশজনিত এপিডি- এর প্রকৃত কারণ এখনও অজানা এবং এবিষয়ে গবেষণাও চলছে। যদিও বাচ্চাদের শোনার বিকাশজনিত ক্ষমতা শুরু হয় এবং জীবনের প্রথম ধাপে তা বজায়ও থাকে। পরে বিকাশ পিছিয়ে যায় বা তাদের খিঁচুনি হওয়ায় এপিডি দেখা দেয়।
- গ্লু ইয়ার (বদ্ধ কান)/অটিটিস মিডিয়া- জন্মানোর পর বা শৈশবের প্রথম পর্বে যদি বাচ্চাদের গ্লু ইয়ার হয় তাহলে এওপিডি বিকাশ পাওয়ার ঝুঁকি থাকে। যখন মানুষের কানের মধ্য অংশে বিভিন্ন পদার্থ বা বস্তু জমা শুরু হয় তখন গ্লু ইয়ার বা কান বদ্ধ হয়ে যায়। এগুলো জমে গিয়ে শব্দের কম্পন শুরু হয়।
অডিটরি প্রসেসিং ডিসঅর্ডার নির্ধারণ
এটি এমন একটি জটিল সমস্যা যা নির্ধারণ ও চিহ্নিত করা তত সহজ হয় না। তবু অভিভাবক, পরিচর্যাকারী বা শিক্ষক হিসেবে আপনি বা আপনারা বাচ্চাদের লক্ষণ ও উপসর্গ দেখে তাদের অডিওলজিস্টদের কাছে নিয়ে যেতে পারেন। অডিওলজিস্ট নানারকম যন্ত্রপাতি ও বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বাচ্চাদের এপিডি নির্ধারণ করতে সাহায্য করেন।
অনেক বাচ্চা এই দুর্বলতার কারণে লেখাপড়ার দিক থেকে অনেক বাধার মুখোমুখি হয়। এজন্য যত তাড়াতারি সম্ভব এই সমস্যা নির্ধারণ করা জরুরি।
অডিটরি প্রসেসিং ডিসঅর্ডারের চিকিৎসা
যদি আপনি শিক্ষক হন তাহলে ছোট ছোট কিছু কৌশলের সাহায্যে আপনি আপনার এই সমস্যায় আক্রান্ত ছাত্রদের উন্নতি করতে পারবেন-
- ব্যাখ্যার চাইতে তাদের চোখের সামনে কিছু বিষয় তুলে ধরা প্রয়োজন (যেমন- কিছু ছবি, লেখা, উপস্থাপন প্রভৃতি)
- যখন দরকার তখন পারিপার্শ্বিক শব্দের ব্যবহার কমাতে হবে
- ক্লাসে তাদের সামনের দিকে বসাতে হবে বা আপনার কাছে তাদের রাখতে হবে যাতে তারা আপনার কথা ভালোভাবে শুনতে পায়
- বিচ্ছিন্নতা থেকে দূরে তাদের পরীক্ষা বা কাজের ব্যবস্থা করতে হবে
- গলার স্বর ও তার গভীরতার মধ্যে বিভিন্নতা আনতে হবে, শব্দের গতির রদবদল ঘটানো জরুরি, মূল শব্দের উপরে জোর দিতে হবে
- উত্তর দেওয়ার জন্য তাদের ৫-৬ সেকেণ্ড সময় দিতে হবে (এটা তাদের ‘চিন্তার সময়’)
- ছাত্রদের মধ্যে সবসময়ে মৌখিকতার ধারণা গড়ে তোলা, কথা বলার জন্য বেশি করে শব্দের ব্যবহার, নিয়মকানুন প্রভৃতি শেখানো জরুরি।
http://kidshealth.org/en/parents/central-auditory.html
https://ldaamerica.org/types-of-learning-disabilities/auditory-processing-disorder/
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে