মানসিক চাপ: এড়াবেন কীভাবে

মানসিক চাপ: এড়াবেন কীভাবে
জীবনে চাপ থাকবেই। কাজের চাপ, সময়ের চাপ, দেনার চাপ। আছে ব্যর্থতার যন্ত্রণা। হারানোর কষ্ট। এগুলো মানসিক চাপের কারণ হয়ে ওঠে। এই চাপ এড়াবেন কীভাবে? এ চাপ থেকেই কি আদৌ মুক্তি পাওয়া যায়? আসলে মানসিক চাপ থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই। কাজেই একে মোকাবিলা করাটাই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কাজ। কীভাবে মোকাবিলা করবেন চাপ?

 

হাসিখুশি থাকুন
মানসিক চাপ উপশমে হাসির কোনো জুড়ি নেই। মনোবিজ্ঞানী রবার্ট হোল্ডেনের মতে, হাসি পেশিকে শিথিল করে, টেনশন কমায়, রক্তচাপ কমায়,কোষের অক্সিজেন গ্রহণের ক্ষমতা বাড়ায়। বাড়ায় রক্ত চলাচল। স্ট্রেস হরমোন উৎপাদনও কমায়। প্রাপ্তিতে যেমন আনন্দিত হন, পাশাপাশি মেনে নিন অপ্রাপ্তিকেও। কারণ এক জীবনে সব প্রাপ্তি আসে না। মনকে সতেজ রাখুন অফুরন্ত হাসিতে।

চাহিদা থাকুক সীমার মধ্যে
নিজের উপার্জনের ওপর চাহিদার সীমারেখা টানা জরুরি। সাধ যদি সাধ্যের নাগালের বাইরে থাকে, অপ্রাপ্তি হবে প্রতিদিনের সঙ্গী। না পওয়ার যন্ত্রণা থেকে মানসিক চাপ সৃষ্টি হতে পারে। স্ত্রীরা স্বামীর উপার্জনের বিষয়টি বিবেচনা করুন। এতে আপনার স্বামী যেমন মানসিক চাপ থেকে রেহাই পাবেই, আপনার হৃদয়েও থাকবে না অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা। অর্থাৎ- সাধ্যের সীমারেখায় সাধকে ধরে রাখুন। মানসিক চাপ থেকে অনেকটা রেহাই পাবেন।

নিজকে ফুটিয়ে তুলুন
এমন কোনো মানুষ নেই, যার মধ্যে বিশেষ কোনো গুণ নেই। কারও এটি প্রকাশিত থাকে, কারও বা অপ্রকাশিত। আপনার সেই বিশেষ গুণটি আবিষ্কারের চেষ্টা করুন। যদি দেখেন, গানের গলাটি একেবারে মন্দ নয়, সুরের অনুকরণ বেশ করতে পারেন, তাহলে একটি হারমোনিয়াম নিয়ে শুরু করে দিন চর্চা। সংগীত মানুষের অন্তর্গত যন্ত্রণা উপশমে অনেকখানি সহায়ক। অথবা শিল্পাঙ্গনের অন্যান্য দিকে মনোযোগ বাড়ান। নিজেকে বিকশিত করুন বিশেষ মহিমায়। সৃজনশীল কাজ মনের আনন্দ বাড়ায়। মনে আনে শান্তি।

বর্তমান নিয়ে ভাবুন
মনোবিজ্ঞানী জোয়ান বরিসেঞ্চোর মতে, মানুষের দুশ্চিন্তা মূলত অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে। অথচ অতীতকে ফিরিয়ে আনা যায় না, ভবিষ্যৎকেও ধরা যায় না বর্তমানে বসে। অতএব ভাবুন বর্তমান নিয়ে। বর্তমান কর্মই আপনার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। কাজেই, ভবিষ্যতের ভাবনা নিয়ে মানসিক চাপ বাড়ানোর কোনো যুক্তি নেই। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান মুহূর্তকে যথাযথভাবে ব্যবহার করুন। ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবেই।

মেডিটেশন বা প্রার্থনা করুন
বিজ্ঞানীদের মতে প্রার্থনা, ধ্যান বা মেডিটেশন করলে স্ট্রেস হরমোন নরঅ্যাড্রেনালিন ও অ্যাড্রেনলিনের প্রভাব কমে। এতে মানসিক দুশ্চিন্তা হ্রাস পায়।

চাই অবসর
সারাদিনে কাজের ব্যস্ততা কখনো কখনো মানসিক চাপের সৃষ্টি করে। কীভাবে শেষ করবেন সব কাজ তা নিয়ে ভাবনা শুরু হয়। তাই কাজের ছক বা পরিকল্পনা করে নিন এবং সেই অনুযায়ী কাজ করুন। মাঝখানে কাজের ফাঁকে অবসর নিলে অনেকখানি চিন্তা-ভারমুক্ত হওয়া যায়।

সহজভাবে দেখুন জীবনকে
জীবনকে সহজ ভাবলে সহজ, জটিল ভাবলে জটিল। প্রতিটি কাজের মধ্যে সুন্দর দিকটা আগে খুঁজুন। তাহলে কাজটি করতে আগ্রহ বোধ করবেন, আনন্দ পাবেন। এতে মানসিক চাপ কম হবে। অনেকের স্বভাবে আছে, সবকিছুর মধ্যে নেতিবাচক দিক খুঁজে বের করা। অভ্যাসটি ত্যাগ করার চেষ্টা করুন। পৃথিবীটা খুব সুন্দর। অতএব সুন্দরের সন্ধান করুন। পেয়ে যাবেন মধুর সুন্দরের স্বর্ণদ্বার।

ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তুলুন
শরীরচর্চায় দুশ্চিন্তা কমে, বিষণ্ণতা দূর হয়। ১৯৬৮ সালে ডা. কেনেথ কুপার এ তত্ত্ব দিয়েছেন, তিনি অ্যারোবিকস ব্যায়ামকে জনপ্রিয় করেছেন। ঘরেই এই ব্যায়াম করতে পারেন। ক্যাসেট প্লেয়ারে গান ছেড়ে দিয়ে বাজনার তালে তালে নাচতে পারবেন। এই ব্যায়ামকেই অ্যারোবিক ব্যায়াম বলে। এতে আপনার মানসিক চাপ কমতে পারে। তবে অতিরিক্ত ব্যায়াম করা চলবে না। মনে রাখতে হবে ব্যায়াম যেন নিজেই চাপের কারণ না হয়।

ইগো ঝেড়ে ফেলুন
মানুষের ইগো একটি মারাত্মক জিনিস। করণে অকারণে ইগো-কমপ্লেক্সে ভুগবেন না। প্রথমে নিজেকে জয় করুন। নিজের অবস্থানকে বুঝতে চেষ্টা করুন। ইগো-কমপ্লেক্স মানসিক চাপের আরো একটি কারণ। সহজভাবে অন্যের সঙ্গে মেশার মানসিকতা গড়ে তুলুন। অভিযোজন ক্ষমতা বা অ্যাডাপটেশন-পাওয়ার বাড়াতে সচেষ্ট হোন। খেয়াল করুন, আপনার কোনো কাজ বা আচরণ অন্যের মানসিক চাপের করণ হচ্ছে কি না।

মেধা বিনিয়োগ করুন
নিজের মেধা পরের ক্ষতি করার কাজে ব্যয় না করে নিজের উন্নয়নে ব্যয় করুন। দেখবেন, তার ফলাফল আপনাকে আনন্দ দেবে। সুখী করবে। আপনার ভবিষ্যৎ হবে উজ্জ্বল। পরের ক্ষতিতে মেধা ব্যয় করলে তা একসময় নিজেরই মানসিক অশান্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে। শিল্পচর্চায় নিজের মনোযোগ বাড়ান। পাঠাভ্যাস গড়ে তুলুন। এসব আপনার শুধু নিঃসঙ্গতাজনিত মানসিক চাপ দূর করবে না, অনেকের মধ্যে আপনাকে করবে অনন্য।

শেষ কথা
প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই রয়েছে মানসিক চাপ নিরাময়ের অন্তর্গত কৌশল। সেই কৌশলই স্বতঃস্ফূর্তভাবে মোকাবিলা করবে মানসিক চাপের। নিজেকে যেমন বুঝতে হবে, তেমনি অন্যকেও। সমস্যায় ভেঙে না পড়ে, সমস্যার কারণ বুঝে সমাধানের চেষ্টা করুন। কোনো কাজ করতে গিয়ে হাজার জনের পরামর্শের মুখাপেক্ষী না হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজের মতামতের ওপর নির্ভশীলতা বাড়ান। অতি প্রয়োজনে উপযুক্ত মানুষের পরামর্শ নিতে পারেন, বাস্তবমুখী হোন। এ সবই আপনার নিয়ন্ত্রণে। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছার। এই সদিচ্ছা দিয়েই কমিয়ে আনা যায় মানসিক চাপ। সবার আগে প্রয়োজন সুস্থ দেহ। সুস্থ দেহেই থাকে সুস্থ মনের বাস। আর এই সুস্থ মনই পারে মানসিক চাপের মোকাবিলা করতে।

সূত্র:লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleবৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি প্রভাব ফেলছে মানসিক স্বাস্থ্যে
Next articleকর্মক্ষেত্রে মানসিক দৃঢ়তা অর্জনের সহায়ক কৌশল
অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল
প্রাক্তন পরিচালক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here