ডাউন সিন্ড্রোম: শিশুদের ক্রোমোজমের সমস্যা

0
158

ডাউন সিন্ড্রোম কী?
ডাউন সিন্ড্রোম একটি জীবনব্যাপী জিনের বা ক্রোমোজমের সমস্যা। এটি আমাদের শরীরে অত্যাধিক ক্রোমোজোমের জন্য হয়ে থাকে। একটি স্বাভাবিক শিশু তাঁর শরীরে ৪৬টি ক্রোমোজম নিয়ে জন্মায় যার মধ্যে ২৩টি সে পায় বাবার থেকে ও বাকি ২৩টি তাঁর মায়ের থেকে। কিন্তু ডাউন সিন্ড্রোমের ক্ষেত্রে একটি অতিরিক্ত ২১তম ক্রোমোজম থাকার ফলে মোট সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭টা। এই তারতম্যের জন্য শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যহত হতে পারে যা সামান্য বা মোটামুটি বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই সমস্যাকে ‘ট্রাইসোমি ২১’ ও বলা হয়।

ডাউন সিন্ড্রোমের লক্ষণগুলি কী?
ডাউন সিন্ড্রোমের লক্ষণ প্রত্যেকটি শিশুর ক্ষেত্রে আলাদা হতে পারে। কেউ হয়তো ভালরকম সুস্থ হয় আবার কেউ সাংঘাতিক শারীরিক ও মানসিক সমস্যার শিকার হয়। সাধারণত ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের মানসিক সুস্থ শিশুদের তুলনায় ধীর গতিতে হয়।

ডাউন সিন্ড্রোমে যে উপসর্গগুলি দেখা যায়ঃ
  • চ্যাপ্টা মুখ বিশেষত নাকের অংশটি
  • উপরের দিকে ঢালু চোখ
  • ছোট গলা ও কান
  • সবসময় জিভ বেরিয়ে থাকে মুখ দিয়ে
  • দুর্বল পেশী ও অস্থিসন্ধি
  • চওড়া ছোট হাত এবং তালুতে মাত্র একটি রেখা
  • ছোট আঙ্গুল এবং পায়ের পাতা
  • বামন আকার
  • চোখের মনিতে সাদা দাগ

ডাউন সিন্ড্রোম কেন হয়?
শরীরে ক্রোমোজোমের সংখ্যার অসংগতির জন্যে এই সমস্যা দেখা দেয়। পরিবেশ, জাতি, সংস্কৃতি ও অন্যান্য কোনও কিছুর সাথে এর সম্পর্ক নেই।

নিম্নলিখিত জিনগত বৈষম্য এর কারণ হতে পারেঃ
ট্রাইসোমি ২১ – ৯৫% ক্ষেত্রে ডাউন সিন্ড্রোমের কারণ হয় শরীরে অতিরিক্ত ২১তম ক্রোমোজোমের উপস্থিতি।

মোজাইক ডাউন সিন্ড্রোম– এটি একটি বিরল ক্ষেত্র যেখানে একাধিক কোষে অতিরিক্ত ২১তম ক্রোমোজোমের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। গর্ভসঞ্চারের সময় সেইজন্য সুস্থ কোষের পাশাপাশি একাধিক বিকৃত কোষ জন্ম নেয়।

ট্রান্সলোকেশন ডাউন সিন্ড্রোম– এই ক্ষেত্রে শরীরের ২১তম ক্রোমোজোমটি ভেঙ্গে গিয়ে অন্য আরেকটি ক্রোমোজোমের সাথে জুড়ে যায়। মা বাবার থেকে শিশুর এই রোগটি হবার সম্ভাবনা থাকে। তাঁরা নিজেরা সুস্থ হলেও এই বিকৃতির বাহক হন। পিতা বাহক হলে ৩% এবং মাতা বাহক হলে ১০-১৫% ঝুঁকি থাকে শিশুর ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হবার।

ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হলে কী কী জটিলতা দেখা দিতে পারে?
ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের কিছু জন্মগত বিকৃতি থাকতে পারে যেমন:

  • বধিরতা
  • কানে সংক্রমণ
  • ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি অথবা ক্যাটারাক্ট
  • হৃদপিণ্ডে সমস্যা
  • থাইরয়েড
  • অন্ত্রে সমস্যা
  • রক্তাল্পতা
  • লিউকেমিয়া
  • ওবেসিটি

ডাউন সিন্ড্রোম পরীক্ষার পদ্ধতি
গর্ভাবস্থায় বা শিশুর জন্মের পরই চিকিৎসকদের পক্ষে ডাউন সিন্ড্রোমের পরীক্ষা সম্ভব। কিন্তু গর্ভাবস্থায় পরীক্ষা করানোই শ্রেয়।

ভ্রূণ পরীক্ষাঃ গর্ভাবস্থায় ভ্রূণকে পরীক্ষা করে দেখা হয় যে ডাউন সিন্ড্রোমের কোন সম্ভাবনা আছে কি না।

সদ্যোজাত শিশুর পরীক্ষাঃ  জন্মের পর শিশুকে পরীক্ষা করে দেখা যে তাঁর মধ্যে ডাউন সিন্ড্রোমের লক্ষণ আছে কি না।

ডাউন সিন্ড্রোমের চিকিৎসা
এটি একটি জীবনব্যাপী সমস্যা। কিন্তু দ্রুত চিকিৎসা শুরু করলে, ট্রিটমেন্ট ও থেরাপির সাহায্যে শিশুর জীবনযাত্রার মান উন্নত করা যেতে পারে।

এই চিকিৎসার সময় নিয়মিত পরীক্ষা ও থেরাপির সাহায্যে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করা হয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের চোখ ও কান নিয়মিত পরীক্ষা করানো উচিৎ কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা এই দুটি জড়িত সমস্যায় ভোগেন।

আর্লি ইন্টারভেনশন প্রোগ্রামঃ এই পদ্ধতিতে একাধিক সমস্যার চিকিৎসা যেমন, দৃষ্টিশক্তির উন্নতি বা মোটর স্কিল বৃদ্ধি করতে সাহায্য করা হয়। বিশেষ শিক্ষক, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, ফিজিওথেরাপিস্ট, অক্যুপেশনাল থেরাপিস্টের একটি দল মিলে তাঁকে ভাষা শেখানো, রোজকার কাজকর্ম এবং সমাজে নিজেকে মেলে ধরতে শেখান।

ডাউন সিন্ডোমের শিকার একটি শিশুর যত্ন নেওয়া
বাবা-মা বা অভিভাবকরা শিশুর ডাউন সিন্ড্রোমের কথা জানার পর খুবই ভেঙ্গে পড়েন। কিছুটা সময় নিলেও তাঁরা ঘুরে দাঁড়ান এবং নিজের সন্তানকে একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন দিতে চেষ্টা করেন। সাধারণ লোকজন হয়ত এই মানসিকতাকে বুঝতে পারবেন না।

আপনি নিম্নলিখিত পদ্ধতি গুলির সাহায্য নিতে পারেনঃ
ইন্টারভেনশন প্রোগ্রামঃ একটি নির্ভরযগ্য চিকিৎসকের দলের সাহায্য নিন এবং নিজেও তাঁদেরকে সাহায্য করুন।

সাহায্য নিনঃ অন্যান্য পরিবারের সাথেও কথা বলুন যাঁদের ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত শিশুকে মানুষ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে।

এক উজ্জল ভবিষ্যতের প্রস্ততি নিনঃ অধিকাংশ শিশুরাই রোজকার কাজকর্ম করতে, স্কুলে যেতে, চাকরি করতে সক্ষম হয়।

শিশুর গুণাবলিগুলোতে জোর দিনঃ ডাউন সিন্ড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের বুদ্ধি ও প্রতিভা সাধারণ শিশুদের তুলনায় বেশী হবার সম্ভাবনা থাকে। সে হয়তো সাঁতার, নাচ বা সাইক্লিঙ-এ খুব ভাল হতে পারে, কাজেই তাঁকে সেইগুলোতে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিন।

ডাউন সিন্ড্রোমের ঝুঁকি কেন বেড়ে যায়?
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এখন সঠিক জানেন না যে হঠাৎ ক্রোমোজোমের সংখ্যা কেন বেড়ে যায়। কিন্তু তাঁরা মনে করেন যে কিছু ঘটনার জন্যে এর ঝুঁকি বেড়ে যায়। চিকিৎসকেরা দেখেছেন দেরি করে যারা মা হন (৩৫ বছর বয়সে বা তার পরে) সেইক্ষেত্রে ডিম্বাণুতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রথম শিশুর ডাউন সিন্ড্রোম থাকলে পরবর্তী শিশুর ডাউন সিন্ড্রোম থাকার সম্ভাবনা আরও বেশি। বাবা অথবা মা কেউ অতিরিক্ত ক্রোমোজোমের বাহক হলে শিশুর ডাউন সিন্ড্রোম হতে পারে।

ডাউন সিন্ড্রোম এড়ানো যায় কী?
ডাউন সিন্ড্রোম হওয়া আটকানো যায় না। কিন্তু আপনার শিশুর যদি ডাউন সিন্ড্রোম হবার সম্ভাবনা থাকে তবে পরবর্তি শিশুর জন্মের পরিকল্পনা নেবার আগে একবার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। একজন জেনেটিক কাউন্সেলর আপনাকে এই বিষয়ে বুঝতে সাহায্য করতে পারেন।

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন

Previous articleসম্পর্কে একঘেয়েমি আর অশান্তি এড়াতে
Next articleআমার স্ত্রীকে আমি কিভাবে বুঝাতে পারি?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here