“হ্যালো বাবা, আমি শর্মির (ছদ্মনাম) মা, আমার মেয়ে কথা বলতে পারতেছে। আজ কথা বলছে। টেবিলের উপর মোবাইল ছিলো। ও মোবাইল টা দেখিয়ে বললো, মা মোবাইল টি দাও। ডাক্তার স্যার কে একটা ফোন দিবো। ওর মুখে কথা শুনে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। ও যখন মোবাইল দিচ্ছোনা ক্যানো বলে চিৎকার দিলো, তখনই খুশিতে মন ভরে উঠলো। বাবা আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। অনেক দোয়া করি, আপনার জন্যে বাবা…”
নিতান্ত অসময়ে ফোন দিয়ে এভাবে আবেগে উচ্ছাসে কথা গুলো বলে ভদ্র মহিলা ফুপিয়ে কান্নায় ভেঙে পরলেন।
আমি মনে করতে পারছিলাম না “শর্মি” নামের ঠিক কোন রুগী। কারণ গেলো সপ্তাহে দুজন রোগীনী চেম্বারে এসছিলেন, যাদের লক্ষন ছিলো প্রায় একই। হঠাৎ করে কদিন থেকে কথা বলা বন্ধ হয়ে যাওয়। কাঁচা ভাষায় যাকে বলে “জবান বন্ধ”।
রহস্যময় এক সিমটম। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠার পর থেকে কথাবার্তা বন্ধ। রোগী দুজনেই ছিলেন মহিলা, একজনের বয়স ৩২ আরেকজন ১৭।
ডাক্তারী জীবিনে এরকম হঠাৎ “কথাবন্ধ” রোগ অনেক পেয়েছি। কেউ হয়তো রেফার্ড হয়ে এসছেন আবার কেউবা কবিরাজ, ভন্ড বাবা, সাধু বাবা, পল্লি চিকিৎসক বা চিকিৎসক হতে উপশম না পেয়ে শেষমেশ নিউরোসাইয়াট্রি বা সাইকিয়াট্রিতে এসছেন।
টেলিফোনে ঠিকানা আনুষাঙ্গিক দুএকটা বিষয় জেনে নেবার পর শর্মীর কথা বেশ মনে হলো।
শর্মির বয়স বত্রিশ। স্বামী বিদেশে থাকেন। মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন। এখন মাস দুয়েক আমেরিকায়। ছোট ছোট দু’ছেলে মেয়ে নিয়ে তার সুখের সংসার।
শ্বশুর শাশুড়ী বেঁচে নেই। দেবর ননদ সবাই সবার যার সংসার নিয়ে ব্যাস্ত। তিনি কেবল একাই । প্রায় সময় বাবা মা’য়ের সাথে থাকেন। আজ কয়দিন যাবৎ হঠাৎ করে শর্মিলা কথা বলতে পারছিলো না। সবাই ভয় পেয়ে গেছেন।
কবিরাজ, কোয়াক, ভন্ডপীর, সাধু সন্যাসী সব চিকিৎসাই প্রায় শেষ হয়েছে। বান মারা, যাদু টোনা, উপরি বাতাস এসব কিছুইনা। ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। তিনি প্রথমে কিছু ঔষধ দিয়েছেন তাতে উন্নতি হয়নি বিধায় ব্রেইনস্ট্রোক ভেবে রেফার করেছেন নিউরোমেডিসিন স্পেশালিষ্ট এর কাছে। সেখান থেকে অবশেষে শর্মি সাইকিয়াট্রিস্ট এর চেম্বারে ।
নিউরোমেডিসিন স্পেশালিষ্ট বলেছেন শর্মির কথা বন্ধ হয়ে যাওয়া, হাত পা দূর্বল, সেই সাথে মাঝে মধ্যে সারা শরীর ঝিন ঝিন করা, বার মূর্ছা যাবার মতো হওয়া ইত্যাদি উপসর্গ স্ট্রোক মনে হলেও আসলে শর্মির কথাবন্ধ হওয়াটা ব্রেইনস্ট্রোক জাতীয় কিছু নয়। তার সিটি স্ক্যান ও সম্পূর্ণ নরমাল।
সাইকিয়াট্রি বা নিউরোসাইকিয়াট্রিতে “কনভার্সন ডিজঅর্ডার” নামে একটা রোগ আছে যাতে রোগীর ব্রেইন স্ট্রোকের মতো ‘হঠাৎ কথাবার্তা বন্ধ হয়ে যাওয়া’, ‘দেহ অবস হয়ে যাওয়া’, ‘বার বার মূর্ছা যাওয়া বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া’, ‘খিচুনি মতো উঠা’, ‘শ্বাসকষ্ট এর মতো অনুভব হওয়া বা দ্রুত শ্বাস প্রস্বাস নিতে থাকা’, ‘হাত পা ছুড়াছুড়া করা’, ‘খানিকটা অজ্ঞান অবস্থায় নানান শারিরীক কসরত’ ইত্যাদির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
“কনভার্সন ডিজঅর্ডার” রহস্যময় এক রোগ। চিকিৎসা করেন নিউরো সাইকিয়াট্রি বা সাইকিয়াট্রি বিভাগের বিশেষজ্ঞরা বা ক্ষেত্র বিশেষে কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্টরা।
শর্মির মা ওপাশ থেকে বললেন, “বাবা আপনি শর্মির সাথে দুটো কথা বলেন। ও কথা বলতে চাচ্ছে। দেখুন সে কথা বলতে পারছে…”।
শর্মি অস্পষ্ট স্বরে দু চারটে কথা বললো। তার অসুস্থতার প্রসংগটা পালটিয়ে অন্য আলাপে তাকে ব্যস্ত করায় দেখা গেলো তার কথা গুলো স্পষ্ট হচ্ছে।
শর্মি কনভার্সন ডিজঅর্ডার এ ভুগছে। রোগটি বেশ রহস্যময় । সাধারণত মনের গহীন কোনে কোন কষ্ট লোকানো থাকলেই হয়। সে কষ্ট গুলো এক সময় নানান দৈহিক লক্ষণের মাধ্যমে ফুটে উঠে। রোগী যে ইচ্ছাকৃত ভাবে এসব উপসর্গ তৈরি করেন তেমন টি নয়। অনেকে মৃগী রোগ ভেবে টেগরেটল, সোডিয়াম ভেলপ্রয়েট ঔষধ এডভাইস করেন।
প্রাথমিক সাইকোথেরাপিক সেশনে সময় শর্মির কনভার্সন ডিজঅর্ডার এর মানসিক কারণটি কিছুটা খোলাসা হয়েছিলো। হঠাৎ তার স্বামীর আমেরিকা সেটেল্ড হওয়া এবং তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়ায় তার এই মানসিক সমস্যার উৎপত্তি।
কনভার্সন ডিজঅর্ডার অদ্ভুত এই রোগটির কোন না কোন কারণ থাকে। এই কারণ উদঘাটন করতে না পারলে, এ নিয়ে রোগীর সাথে বিশদ আলোচনা না করলে বা এথেকে উতরানোর উপায় বের করতে সহায়তা করতে না পারলে এ রোগটি কখনোই ভালো হবার নয়। আজীবন থেকেই যায় এবং এ থেকে নানান জটিলতাও তৈরি হয়।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন